Advertisement
E-Paper

চাই নতুন, ঠিকঠাক নেতৃত্ব

বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুযায়ী কোনও মেন্টর গ্রুপ এই কাজটি করতে পারে না, তার জন্য থাকে এক্সিকিউটিভ কাউন্সিল বা কোর্ট, তাদের যে নামেই ডাকা হোক।

জহর সরকার

শেষ আপডেট: ১৩ এপ্রিল ২০১৮ ০০:১৪

২০১১ সালে যখন প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের মেন্টর গ্রুপ তৈরি করা হল, সবার মনেই আশা জেগেছিল। প্রেসিডেন্সি নিয়ে অনেক হচ্ছে, নামজাদা অধ্যাপকরা প্রেসিডেন্সিতে আসছেন— সংবাদমাধ্যম এবং জনসাধারণ খুব আগ্রহ নিয়ে এ বিষয়ে খবর রাখতেন। এই গ্রুপটি থেকে কালক্রমে কেউ কেউ বেরিয়ে গিয়েছেন, কেউ কেউ যোগও দিয়েছেন। গ্রুপটি ছ’মাস অন্তর রিপোর্ট দাখিল করত। নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নতির পক্ষে সাড়ে ছ’বছর একটু বেশিই সময়— কোনও প্রতিষ্ঠানের পক্ষেই এত দিন তাগিদটা ধরে রাখা কঠিন। কী কী করা দরকার, সে বিষয়ে মেন্টর গ্রুপের ছ’ভাগে বিন্যস্ত ১৩৪ পাতার রিপোর্টে সুস্পষ্ট পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেগুলি কী ভাবে প্রয়োগ করা হবে, সেটা বলা মেন্টর গ্রুপের দায়িত্ব নয়, সে কাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালকদের। এখানে দু’টি কথা আছে। এক, এই গ্রুপে এক জন ছাড়া অন্য কারওই প্রশাসন চালানোর যথার্থ অভিজ্ঞতা নেই। প্রশাসন বেশ সমস্যাসঙ্কুল কাজ, কেবল সদিচ্ছা দিয়ে সেটা করা যায় না। দ্বিতীয় সমস্যাটি হল, বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুযায়ী কোনও মেন্টর গ্রুপ এই কাজটি করতে পারে না, তার জন্য থাকে এক্সিকিউটিভ কাউন্সিল বা কোর্ট, তাদের যে নামেই ডাকা হোক।

প্রেসিডেন্সির পরিচালকমণ্ডলীর মিটিংয়ের বিবরণী দেখলে মনে হয়, উপাচার্য সেখানে তাঁর মনোমতো সিদ্ধান্ত অনুমোদন করিয়ে নিতে পেরেছেন, কারণ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় এখানকার মিটিংগুলিতে বাইরের সদস্যদের উপস্থিতি খুবই কম। উপাচার্যের এই একক কর্তৃত্বের ধারাটি প্রেসিডেন্সির ২০০ বছর পূর্তি উৎসবের সময় সর্বসমক্ষে প্রকট হয়ে ওঠে, বহু বিশিষ্ট মানুষ মর্মাহত হয়ে দেখেন যে, ঐতিহাসিক প্রতিষ্ঠানটির এমন একটি অনুষ্ঠান এক জন ব্যক্তির ‘গৌরব’ অভিযানে পরিণত হয়েছে। প্রেসিডেন্সির অতুলনীয় সম্পদ তার প্রাক্তনীরা। তাঁদের মধ্যে আছেন অনেক উপাচার্য, আছেন বহু বিচারপতি, লেখক, বুদ্ধিজীবী, আইনজীবী, সাংবাদিক এবং প্রশাসক। তাঁরা সহযোগিতা করতে উন্মুখ ছিলেন, কিন্তু তাঁদের রূঢ় প্রত্যাখ্যানের শিকার হতে হয়। অথচ বর্তমান উপাচার্যের তুলনায় এঁদের অনেকেরই প্রেসিডেন্সির সঙ্গে আত্মিক সংযোগ অনেক বেশি। এঁদের কাছে প্রেসিডেন্সি কেবল একটি কলেজ নয়, সারা জীবনের স্মৃতির ভান্ডার। যেটা তাঁদের সবচেয়ে বেশি পীড়া দিয়েছে, তা হল, এই প্রতিষ্ঠানের অধিপতিরা কারও কথায় কান না দিয়ে তাকে একটি স্থূল বাণিজ্যিক রুচির লীলাভূমিতে পরিণত করেছেন। কেউ ভাবতে পারে যে, নিতান্ত ব্যক্তিগত অভিরুচিতে প্রেসিডেন্সির ঐতিহাসিক গেটটি উপড়ে ফেলে একটা পেল্লায় কুরুচিকর গেট বসিয়ে দেওয়া হল, নষ্ট করে ফেলা হল গেটের সামনের প্রাচীন বটগাছটি, যারা বাংলার ইতিহাসের বহু গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তের সাক্ষী হয়ে থেকেছে! এবং সেখানে তৈরি করা হল একটা বাঁধা গতের রুচিহীন প্রবেশদ্বার। প্রেসিডেন্সি কলেজের বিখ্যাত ‘পোর্টিকো’, যেখানে প্রজন্মের পর প্রজন্ম তর্ক করেছে, বিতর্ক শিখেছে, সেটাকেও কেন যে অত্যন্ত অবহেলায় নষ্ট করে দেওয়া হল, ভগবানই জানেন। ন্যাক এবং এনআইএফআর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মূল্যায়নে জোর দেয় গবেষণার উপর, অথচ সে দিকে মন দেওয়ার বদলে ঐতিহাসিক বেকার ল্যাবরেটরির অসামান্য স্থাপত্য নষ্ট করে দিতে ব্যস্ত হলেন কর্তৃপক্ষ। গবেষণাগারের অমূল্য আসবাব ও ঐতিহাসিক যন্ত্রপাতি, যা কিনা সযত্নে সংগ্রহশালায় রাখার যোগ্য, বিক্রি করে দেওয়া হয় জলের দরে। গ্রন্থাগার এবং গবেষণাগারের উন্নতির কাজে লাগতে পারত যে সরকারি অর্থ, যা কাজে লাগিয়ে রাত্রে সেগুলি অনেক ক্ষণ খোলা রাখা যেত, যেমনটা হয় বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে, সেই টাকা ঠিকাদারদের পাওনা মেটাতে খরচ করা হল। এ দিকে কলেজ হস্টেলের ছাত্রদেরও সমস্যার অন্ত নেই।

বেচারি প্রমোদদা! তাঁর ক্যান্টিন কলেজের ঐতিহ্যের অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছিল বেশ কয়েক দশক ধরে। তাঁকেও হঠাৎ তুঘলকি স্টাইলে কলেজের বাইরে বিদেয় করা হল। আরও প্রশ্ন, কলেজে একটা আখাম্বা ‘শিল্পকৃতি’ খাড়া করার কী দরকার ছিল, যেটিকে দেখলে মনে হয় একখানা পিন-কুশন বসিয়ে রাখা হয়েছে, যার পিনগুলি সব বাঁকা!

এবং এ সব করতে সরকারি কোষাগার থেকে পাওয়া জনসাধারণের অর্থ কী পরিমাণ খরচ করা হয়েছে, সে প্রশ্ন তুললেই জুটবে তীব্র ক্ষুব্ধ তিরস্কার। এমনকী আইন অনুসারে যে আরটিআই (তথ্য জানার অধিকার) সংক্রান্ত ব্যবস্থা চালু করার কথা, তা-ও কার্যকর হয়নি, অন্য বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মতো এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় নানা তথ্য ওয়েবসাইটে দাখিল করার রীতি প্রেসিডেন্সি অনুসরণ করেনি। তথ্য জানতে চাইলে উত্তরে মেলে গভীর নৈঃশব্দ্য।

জানি, এ লেখার প্রতিটি কথাই খুব পীড়াদায়ক। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়টিকে ভবিষ্যতে আরও বড় ক্ষতির হাত থেকে বাঁচানোর জন্য কথাগুলি বলা দরকার। সব কিছু এখনও শেষ হয়ে যায়নি। এক জন নতুন এবং ঠিকঠাক কর্ণধার খুঁজে নিতে পারলে এই দুরবস্থা দূর করে নতুন ভাবে এগোনো সম্ভব। দক্ষতার অভাব মেটানো যায়, কিন্তু সংবেদনশীলতার অভাব দূর করা খুব কঠিন।

(শেষ)

Presidency University Management Excellence
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy