Advertisement
E-Paper

করুণা বিদ্যালয়

কোনও এক কবি বলিয়াছেন, দয়া দিয়া জীবন ধুইতে হইবে, নহিলে জীবনদেবতার চরণ ছুঁইতে পারা যাইবে না। এক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলিয়াছিলেন, একটি রাষ্ট্রের দৃঢ় হইবার জন্য নির্দয় হইবার প্রয়োজন নাই। এক বিশ্বখ্যাত বর্তমান পপ গায়িকা বলিয়াছেন, আত্মনিরাময়ের শ্রেষ্ঠ উপায় হইল দয়া অনুশীলন করা।

শেষ আপডেট: ০৬ অক্টোবর ২০১৯ ০৬:০০
—প্রতীকী ছবি।

—প্রতীকী ছবি।

দয়া শিখাইবার এক শিক্ষায়তন গড়িয়া উঠিল ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফর্নিয়া লস অ্যাঞ্জেলেস-এ। ইহার পূর্বে বেশ কিছু বৈজ্ঞানিক সমীক্ষা প্রমাণ করিয়াছে, একটি দয়ালু কাজ দয়াকারী ব্যক্তির শারীর-মানসিক উন্নতি সাধন করে, ফলে দয়া করিলে দয়া-গ্রহীতার সহিত, দয়াবানেরও উপকার ঘটে। দয়ালু কর্ম করিলে নাকি জিন-এরও ব্যবহার পাল্টাইয়া যায়, হৃদ্‌রোগ, ক্যানসার ও প্রদাহের সম্ভাবনা সৃষ্টিকারী জিন শমিত হয়, সংক্রমণরোধী জিনের কর্মোদ্যোগ বাড়িয়া যায়। বিশ্বে বহু সংস্থায় ইদানীং সুখ বা মানসিক সুস্বাস্থ্যের পাঠ প্রদান হইতেছে, সেইখানে দয়াও হয়তো পাঠ্যক্রমের অঙ্গ, কিন্তু কেবল দয়াকে অবলম্বন করিয়া একটি সমগ্র ‘কাইন্ডনেস ইনস্টিটিউট’ গঠন নিঃসন্দেহে অভিনব ঘটনা। অনেকে মনে করেন, মানুষ স্বতঃস্ফূর্ত ভাবেই দয়ালু, তাহার সেই প্রবণতা খর্ব করিয়া আধুনিক জীবন কী ভাবে এত পরিমাণ নির্দয়তা নিষ্কাশন করিল, তাহা লইয়া গবেষণা প্রয়োজন। আবার কেহ মনে করিতে পারেন, স্বভাবত স্বার্থব্যস্ত মানুষকে অন্যের পরিস্থিতির প্রতি সচেতন করিয়া দয়ার শিক্ষাদান এক প্রয়োজনীয় সংস্কার। উভয় ক্ষেত্রেই, এই সংস্থাটির গুরুত্ব অনুভূত হইবে। সংস্থাটি দয়াসূচক কর্ম, চিন্তা, অনুভূতি ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলির বিশ্লেষণের মাধ্যমে অধিক মানবিক সমাজ নির্মাণে সচেষ্ট হইবে।

কোনও এক কবি বলিয়াছেন, দয়া দিয়া জীবন ধুইতে হইবে, নহিলে জীবনদেবতার চরণ ছুঁইতে পারা যাইবে না। এক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলিয়াছিলেন, একটি রাষ্ট্রের দৃঢ় হইবার জন্য নির্দয় হইবার প্রয়োজন নাই। এক বিশ্বখ্যাত বর্তমান পপ গায়িকা বলিয়াছেন, আত্মনিরাময়ের শ্রেষ্ঠ উপায় হইল দয়া অনুশীলন করা। কিন্তু মহৎ লোকের উপদেশাবলির আকৃতি ও প্রকৃতি চিরকাল একই রকম হইয়া থাকে, আর চিরকালই বাস্তবকে তন্নিষ্ঠ ভাবে লক্ষ করিলে, সেই চিত্রটিকে এই জ্ঞানবাক্যগুলির বিকৃতি বলিয়া বোধ হয়। বিদ্যাসাগর মহা দয়ালু ছিলেন শুনিয়া সভামধ্যে যাহারা করতালিতে ফাটিয়া পড়ে, তাহারা অনেকে হয়তো বাড়ি ফিরিবার পথে গণপ্রহারে শামিল হইয়া হাতের সুখ করিয়া লয়। চতুর্দিকে তাকাইয়া আজ যে পৃথিবী প্রত্যক্ষ করা যাইতেছে, তাহাতে এক সম্প্রদায়ের প্রতি অন্য সম্প্রদায়ের নির্মমতা, এক দেশের প্রতি অন্য দেশের নিষ্ঠুরতা, এক মানসিকতার প্রতি অন্য মানসিকতার তীব্র অসহনশীলতারই জয়জয়কার। উগ্র দক্ষিণপন্থা দিকে দিকে বিজয়কেতন উড়াইতেছে, ‘পুড়াইয়া দাও, তাড়াইয়া দাও’ রণধ্বনিকে লোকে সঙ্গত বীরনির্ঘোষ বলিয়া সমর্থন জানাইয়া উজাড় করিয়া ভোট দিতেছে, যে রাষ্ট্রনায়কেরা এই বিদ্বেষের চাষ করেন তাঁহাদের শক্তিশালী অতিমানব বলিয়া সভায় ও শিল্পে উপাসনা করা হইতেছে। সমাজমাধ্যমে মন্তব্য ও সমালোচনার ফেনায়িত তরঙ্গে নির্দয়তা যে উতরোল কুর্নিশ পাইতেছে, তাহা দেখিয়া দয়ার দেবীর অঞ্চলপ্রান্তে অশ্রু মুছিয়া প্রস্থান ভিন্ন গতি নাই। হুড়মুড় করিয়া রেলছাউনি ভাঙিয়া পড়িলে এবং পিষ্ট শ্রমিকদের উদ্ধারকাজে বিলম্ব হইলে, লোকে প্রতিবাদে ইয়ার্ডমাস্টারকে নির্মম প্রহার করিয়াই ক্ষান্ত হয় না, বস্তা তুলিবার বক্র লৌহ-হুক দিয়া তাঁহাকে ক্ষতবিক্ষত করিয়া ছাড়ে। এক ইংরাজি চলচ্চিত্রে এক নায়ক নায়িকার ললাটে লিখিয়া দিয়াছিল, ‘বি কাইন্ড’। দেখিয়াশুনিয়া সাম্প্রতিক পৃথিবীর ললাটে উহাই সজোরে খচিত করিতে ইচ্ছা করে।

হয়তো সেই প্রয়োজনেই এই নূতন শিক্ষায়তনের প্রবর্তন। কিন্তু এই প্রয়াসের মহত্ত্ব লইয়া অনেকে উচ্ছ্বসিত হইলেও, সত্যই এই শিক্ষালাভে উৎসুক হইবে কি? সুখের পাঠ্যক্রমে বহু ছাত্রছাত্রী মিলিলেও, দয়ার শ্রেণিকক্ষে ভিড় জমিবে? সর্বোপরি, দয়ার ডিগ্রি পাইলে চাকুরি জুটিবে, বসুধায় এমন দয়াশীল পরিস্থিতি জন্মিবে কি? অবশ্য প্রকৃত দয়ার সর্বোচ্চ বৈশিষ্ট্য হইল, ইহা প্রতিদানের আশা না রাখিয়া বর্ষিত হয়, এমনকি দয়া-গ্রহীতার কৃতজ্ঞতাও যাচ্ঞা করে না, সেই ক্রিয়া তাহার স্মৃতিধার্য থাকিবে সেই বাসনাও লালন করে না। যে মানুষ শুভ হরমোন নিঃসরণার্থে বা অন্যের চক্ষে নিজ ভাবমূর্তির উন্নয়নার্থে দয়া করে, সে স্বার্থই চরিতার্থ করিতেছে, কেবল ঘুরপথে। সেই কথা মনে রাখিলে, দয়ার বিদ্যালয় ডিগ্রি বা ডিপ্লোমা দিল কি না আর তাহা লইয়া আত্মবাণিজ্য সম্ভব হইল কি না, অবান্তর প্রশ্ন। কিন্তু আধুনিক কর্কশ বায়ুমণ্ডলে এই কণ্টকগুলিই না পুষ্পের উপযোগিতা বিচারের উপাদান হইয়া দাঁড়ায়।

অষ্টমীই হচ্ছে দুর্গাপুজোর ক্লাইম্যাক্স। সে কথা মাথায় রেখে, আজকের চমকবাজির যুগে, অষ্টমীর দিন বড় বড় পুজোগুলোর বিশেষ কোনও ‘সারপ্রাইজ়’ উন্মোচন করা উচিত। হয়তো এই দিন প্যান্ডেলে তিনটে বাড়তি অসুর দাপাবে, কিংবা সিংহের পাশে গজাবে নতুন বাহন টিরানোসরাস রেক্স। অথবা মা দুর্গা গেয়ে উঠবেন অসুরের প্রতি তিরস্কারগীতি, অনুপম রায়ের সুরে ও ইমনের কণ্ঠে। নইলে, যে-লোক ষষ্ঠীর দিন ঠাকুরটা দেখে গিয়েছে, অষ্টমীর দিন রিপিট করবে কেন?

Kindness Kindness Institute
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy