Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

অবনীন্দ্র-নন্দলাল ধারার পতাকাবাহী

ভারতীয় মহাকাব্য-পৌরাণিক বিষয় নিয়েই ‘বেঙ্গল স্কুল’ ধারার শিল্পীরা চিত্রচর্চা করেছিলেন, এমন কথা শোনা গেলেও তা সর্বাংশে সত্য নয়। সত্যেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবিতে পৌরাণিক বিষয়ের পাশাপাশি গ্রামীণ মধ্যবিত্ত জীবন, শ্রমজীবী মানুষজনও ধরা পড়েছে। লিখছেন জয়দীপ মুখোপাধ্যায় ইতিমধ্যে ১৯১৯-এ শান্তিনিকেতনে ‘দ্বারিক’ নামক ঘরের দোতলায় চার জন ছাত্র নিয়ে কলাভবনের প্রতিষ্ঠা হয়েছে। ১৯২০ সালে সত্যেন্দ্রনাথও কলাভবনে ভর্তি হন।

সত্যেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। চিত্ত দাসের আঁকা। ছবি সৌজন্যে লেখক

সত্যেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। চিত্ত দাসের আঁকা। ছবি সৌজন্যে লেখক

শেষ আপডেট: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০০:৫৯
Share: Save:

শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্যাশ্রম বিদ্যালয়ের সূচনার সময়ে রবীন্দ্রনাথ যাঁদের কাছে পেয়েছিলেন, তাঁদের অন্যতম বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুর লাগোয়া চুয়ামসিনা গ্রামের রাজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। রেলের চাকরি ছেড়ে ১৯০২ সালে আশ্রম বিদ্যালয়ের শিক্ষক তথা অর্থ বিভাগের সহকারি প্রধানের দায়িত্ব নিয়ে তাঁর শান্তিনিকেতনে আসা। তাঁর ছেলে সত্যেন্দ্রনাথের জন্ম ১৮৯৭-এর ১৩ ডিসেম্বর। ১৯২০ সালে বাঁকুড়া ওয়েসলিয়ান (অধুনা খ্রিস্টান কলেজ) কলেজ থেকে বিএ পাশের পরে সত্যেন্দ্রনাথ এমএ পড়তে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। কিন্তু অসহযোগ আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন এবং পড়া অসমাপ্ত রেখে শান্তিনিকেতনে চলে আসেন।

ইতিমধ্যে ১৯১৯-এ শান্তিনিকেতনে ‘দ্বারিক’ নামক ঘরের দোতলায় চার জন ছাত্র নিয়ে কলাভবনের প্রতিষ্ঠা হয়েছে। ১৯২০ সালে সত্যেন্দ্রনাথও কলাভবনে ভর্তি হন। তাঁর কথা বলতে গিয়ে সতীর্থ শিল্পী ধীরেন্দ্রকৃষ্ণ দেববর্মা লিখেছেন, ‘কলাভবনের শুরুতে অল্পসংখ্যক যে কয়েকজন ছাত্র তাঁদের শিল্পশিক্ষার প্রতি নিষ্ঠা, আগ্রহ ও শ্রদ্ধার দ্বারা শিল্পীগুরুদের স্নেহলাভের সৌভাগ্য লাভ করেছিলেন, সত্যেন্দ্রনাথ তাঁদের মধ্যে অন্যতম।

অধ্যক্ষ নন্দলাল কলাভবনে তেল রং, ‘মডেল স্টাডি’ ইত্যাদি পাশ্চাত্য ধাঁচের অঙ্কনশিক্ষা প্রণালী একেবারেই নাকচ করেছিলেন। বদলে তাঁর গুরু অবনীন্দ্রনাথ প্রবর্তিত ‘বেঙ্গল স্কুল’ ধারার চিত্রচর্চা প্রবর্তন করেন। এ ধারায় জল রঙে ‘ওয়াশ’ পদ্ধতিতে ছবি আঁকা হত। সত্যেন্দ্রনাথও সেই পদ্ধতিতে ছবি এঁকেছিলেন। আঁকার মাধ্যম বা প্রথা-প্রকরণ নিয়ে মাথা ঘামাননি। যদিও প্যারিস থেকে আসা শিল্পী আঁন্দ্রে কারপেলস্-এর কাছে তিনি তেল রঙে ছবি আঁকার পদ্ধতি রপ্ত করেছিলেন। এখানেই সত্যেন্দ্রনাথের সঙ্গে বাঁকুড়ার অপর ভূমিপুত্র এবং সতীর্থ রামকিঙ্করের চিত্রানু‌শীলনের তফাৎ। রামকিঙ্করের বিখ্যাত সৃষ্টির অনেকগুলিই তেল রঙে আঁকা। এ নিয়ে গুরু নন্দলালের সঙ্গে তাঁর মন কষাকষিও কম হয়নি। অপর দিকে, সত্যেন্দ্রনাথ ছিলেন অবনীন্দ্র-নন্দলাল ধারার এক নম্র পতাকাবাহী।

ছাত্রাবস্থায় সত্যেন্দ্রনাথকে গুরু নন্দলালের নির্দেশে একটি বিশেষ দায়িত্বও পালন করতে হয়েছিল। ছাত্রদের মধ্যে নন্দনতত্ত্বের জ্ঞান বা শিল্পবোধ বাড়ানোর জন্য রোজ সন্ধ্যায় ইবি হ্যাভেল-সহ অন্য শিল্পতাত্ত্বিকদের লেখা বই পড়ার প্রথা চালু করেছিলেন নন্দলাল। ছাত্র ও শিক্ষকেরা এক সঙ্গে বই পড়তেন। তার পরে চলত পঠিত বিষয় নিয়ে আলোচনা। সত্যেন্দ্রনাথের যেহেতু ইংরেজিতে বেশ দখল ছিল, তাই বই পড়ে শোনানোর দায়িত্ব তাঁকেই দেওয়া হয়েছিল।

রবীন্দ্র-শিক্ষাদর্শ অনুযায়ী কলাভবনে প্রথম যুগে ছাত্রদের কোনও নির্দিষ্ট পরীক্ষা-পদ্ধতি এবং সেই প্রেক্ষিতে ডিগ্রি দেওয়ার প্রচলন ছিল না। ছাত্রেরা যখন বুঝতেন তাঁরা চিত্রবিদ্যায় বেশ পারদর্শী হয়ে উঠেছেন, ইচ্ছে করলে কলাভবন ছেড়ে যেতে পারতেন। টানা ছ’বছর কলাভবনে শিক্ষালাভ করে ১৯২৭ সালে সত্যেন্দ্রনাথ বৃন্দাবন প্রেম মহাবিদ্যালয়ে শিল্প-শিক্ষকের পদে যোগ দেন। পরের বছরে করাচিতে দয়াশ্রমে নিযুক্ত হন। করাচিতে থাকাকালীন তিনি ‘বেঙ্গলি অ্যাসোসিয়শন’-এর পুজোর জন্য সরস্বতী প্রতিমা তৈরি করেছিলেন। ছোটবেলায় চুয়ামসিনার পাশের গ্রামের শিল্পী রাখাল সূত্রধরের কাছে তিনি প্রতিমা তৈরির অনুপ্রেরণা পান। পরে সত্যেন্দ্রনাথ রাখাল সূত্রধরের একটি স্কেচও এঁকেছিলেন।

করাচির পাঠ চুকিয়ে ১৯৩০-এর ডিসেম্বরে সত্যেন্দ্রনাথ বিহারের গোরক্ষপুরে গীতাপ্রেস-এর কাজে যোগ দেন। শেষে ১৯৩২ সালের জুলাইয়ে কলকাতার গর্ভনমেন্ট আর্ট স্কুলে ইন্ডিয়ান পেইন্টিং বিভাগের শিক্ষক নিযুক্ত হন। এই প্রতিষ্ঠানে দীর্ঘ কুড়ি বছর দরদী শিক্ষকরূপে তিনি ভারতীয় চিত্রকলার শিক্ষা দিয়েছিলেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য ছাত্রদের মধ্যে ছিলেন ইন্দু রক্ষিত, হেরম্ব গঙ্গোপাধ্যায়, মৃণালকান্তি দাস, মাণিকলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, ধীরেন্দ্রনাথ ব্রহ্ম, শাম্তিরঞ্জন মুখোপাধ্যায় প্রমুখ।

ভারতীয় মহাকাব্য-পৌরাণিক বিষয় নিয়েই ‘বেঙ্গল স্কুল’ ধারার শিল্পীরা চিত্রচর্চা করেছিলেন, এমন কথা শোনা গেলেও তা সর্বাংশে সত্য নয়। সত্যেন্দ্রনাথের ছবিতে পৌরাণিক বিষয়ের পাশাপাশি গ্রামীণ মধ্যবিত্ত জীবন, শ্রমজীবী মানুষজনও ধরা পড়েছে। তাঁর সহপাঠী শিল্পী ও শিল্পতাত্ত্বিক বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘লোকশিল্প হল এ কালের চাল, কিন্তু সত্যেন্দ্রনাথের কোনও ঝোঁক নেই সেদিকে, অথচ গ্রামের মানুষ এবং তাদের জীবনযাত্রা প্রচণ্ডভাবে আকর্ষণ করে তাঁকে। তাঁর ছবিতে তাদের দেখা যায়। তাদের প্রতি শিল্পীর কী গভীর ভালোবাসা এবং কত দরদ।’

প্রতিকৃতি আঁকাতেও সত্যেন্দ্রনাথের বিশেষ আগ্রহ ও দক্ষতা ছিল। সৌম্যদর্শন, আত্মসমাহিত শিল্পী সত্যেন্দ্রনাথের মতো ছিল তাঁর সৃষ্টিগুলিও। তাই তাঁর শিব সদাশিব, সমাহিত। কালী করালবদনা নন, মাতৃরূপা। বৈষ্ণব রসশাস্ত্রের পরিভাষায় বলা যায়, সত্যেন্দ্রনাথ ছিলেন শান্তরসের শিল্পী। রঙের প্রয়োগেরও ছিলেন সংযতমনা।

জীবনে প্রচুর পুরস্কার পেয়েছেন। সম্মানিতও হয়েছেন। কিন্তু এতটাই প্রচারবিমুখ ছিলেন যে, কখনও নিজের আঁকা ছবি নিয়ে একক প্রদর্শনী করেননি। অবসর নেওয়ার পরে তাঁর ছাত্র মৃণালকান্তি দাসের উদ্যোগে ১৯৬১ সালে সত্যেন্দ্রনাথ ও তাঁর ছাত্রছাত্রীদের আঁকা ছবির একটি প্রদর্শনী হয় কলকাতার অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসে। সংবাদপত্রে প্রকাশ, উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এসে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন, ভারতীয় শিল্পকলা বিশ্বমানবিকতা আবেদনে সমৃদ্ধ।

প্রদর্শনীটির প্রায় আট বছর আগে কর্মজীবন থেকে অবসর নিয়ে শিল্পী সত্যেন্দ্রনাথ তাঁর জন্মস্থান বাঁকুড়ার চুয়ামসিনাতে স্থায়ী ভাবে বসবাস করতে শুরু করেছিলেন। সেখানেই ১৯৭৭-এর ৩১ ডিসেম্বর তিনি প্রয়াত হন। ইচ্ছে করলেই তিনি কলকাতা বা শান্তিনিকেতনে থিতু হতে পারতেন। কিন্তু তিনি তেমন মানুষ ছিলেন না। তাঁর সৃষ্টির মতো তিনিও ছিলেন সত্ত্বগুণের সাধক।

তথ্যসূত্র: রূপতাপস সত্যেন্দ্রনাথ (সম্পাদনা-গিরীন্দ্রশেখর চক্রবর্তী)

লেখক বাঁকুড়ার সাহিত্যকর্মী

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Satyendra Nath Banerjee Painter
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE