ব্র্যাকেটে তৃণমূল। নন্দন থেকে অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টস। ২৮ নভেম্বর, ২০১৪।
অবনঠাকুরের ‘বুড়ো আংলা’য় সুবচনীর যে খোঁড়া হাঁসটি ছিল, সে ব্লগের পাতায় আঁচড় কেটেছিল। সুতরাং রক্তে ভেসে গেল সেই হাঁস: ওয়াশিকুর রহমান। তার আগে একই অপরাধে বিদায় নিয়েছিলেন অভিজিৎ রায়। তারও আগে রাজীব হায়দার। এই যুবাদল মুক্তবুদ্ধির আকাশে পাখা মেলতে চেয়েছিলেন। কলমকে তরবারির চেয়ে শক্তিশালী মনে করার মধ্যে যে ভুল আছে, তা এঁরা জেনে বা না জেনে করে ফেলেছিলেন। এমন ভুল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অধিকৃত প্যারিসে বা স্বস্তিকাখচিত জার্মানিতে বা লাতিন আমেরিকার কদলী প্রজাতন্ত্রসমূহে অনেকেই করেছেন। নিয়তি তাঁদের ন্যায্য মূল্যে কিনে নিয়েছে।
আজ এই চৈত্রপবনে আমরা পশ্চিমের বাঙালিরা অবশ্য এমন অবিমৃশ্যকারিতার দৃষ্টান্ত তৈরি করতে পারি না। আমাদের মন্বন্তর নেই। দাঙ্গা নেই। দেশভাগ নেই। আছে চণ্ডীণ্ডপের সান্ধ্য কোলাহল। আছে একটিই শ্যামের বাঁশি, যার পোশাকি নাম নস্টালজিয়া। বিবেকের পাঁচিলে বসে যুগপৎ দুধ ও তামাক খাওয়ার অপরূপ কৌশল আমাদের আয়ত্তে। অতএব আমাদের খেরোর খাতায় লেখা থাকে কে কোথায় সংখ্যালঘু, কে কোথায় সংখ্যাগুরু। কেন্দ্র-রাজ্যের ভারসাম্য নজর করতে করতে আমরা মাথায় রাখি সংস্কৃতি মন্ত্রকের অনুদান ও জেলা স্তরের রবীন্দ্রজলসা। সুতরাং, তাপসী মালিকের সময় যে মোমবাতির মিছিল, আমাদের ভাবতে হয়, এক সন্ন্যাসিনীর সময় তার পূর্বানুবৃত্তিকে জ্বলন্ত শিল্পের শোভাযাত্রা মনে হবে না তো? তা ছাড়া যা প্রায় সাপ্তাহিক ধারাবাহিকতার অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, লাঞ্ছনার সেই অতিকথাকে স্মৃতির সিলেবাস নথিভুক্তই করে নিয়েছে। যেহেতু বুদ্ধিমান, আত্মসম্মান বন্ধক রেখেছি। সুতরাং, সূর্যাস্তের পর টিভিচর্চায় যে কোনও রাজপুরুষ ও লোকপালিকাকেই মাননীয় বা মাননীয়া বলতে আর হোঁচট খেতে হয় না। প্রত্যেকেই প্রত্যেককে এত সম্মান দিচ্ছে যে বসন্ত এসে গেছে। অতঃপর আমাদের আবৃত্তিসন্ধ্যা আইসক্রিমের মতো মসৃণ হয়ে গলে যাবে। সংস্কৃতির সুগন্ধে ম ম করতে থাকবে পঞ্চায়েত ও মিউনিসিপ্যালিটি। বর্ষশেষ ও বর্ষবরণের সিনেমাটিক ডিজল্ভ দ্ব্যর্থহীন ভাবে জানিয়ে দেবে আমরা কবি; ষড়যন্ত্রকারী নই। অথচ শেষ বারের মতো প্রান্তর তৃণদল দিন ও রাত্রিকে দেখতে দেখতে এক কবি চৈত্র-বৈশাখের অন্তর্বর্তী সংলাপে যে ‘সভ্যতার সংকট’ দেখেছিলেন, সেই সর্বনাশ শুধু প্রিয়তমার চোখে নয়, আমরা বুঝতে পারিনি, ইতিহাসের সর্বাঙ্গে লিপ্ত ছিল।
উনিশ শতকের যে খঞ্জ চেহারাটা পাওয়া যায় উত্তর কলকাতার গলি-উপগলিতে, আজ কলকাতা প্রায় তা-ই। প্রতিমা নেই, তবু মঞ্চ পড়ে আছে, যেন এক গতযৌবনা জনপদবধূ, যে অনেক দীপমালা ও ফুল্লকুসুম দেখেছে। জীবনপ্রভাতে রামমোহন থেকে সত্যজিৎ বুঝেছিলাম। আজ পশ্চিমাং ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর খুঁজতে বলিউড যায়। অচল আধুলিদের কোলাহল পেজ থ্রি আর টক শো ভেদ করে সর্বভারতীয় আঙিনায় পৌঁছয় না। যাঁদের পুরসমাজ বলা হয়েছিল, তাঁরা শিশুতোষ হাম্পটি ডাম্পটির মতোই পতনের পর ভূমিশয্যায়! এঁরা, কামুর অনুকরণেই বলি, স্টেটাস আপডেট করেন ও পরকীয়াকাতর। সুশীল বা বিদ্বজ্জন যে নামেই ডাকুন, মাংসমণ্ডিত কঙ্কালশ্রেণি মেধার বিহনে ক্রমে সমাজে অবান্তর হয়ে গেছে। ‘অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট’, ‘তাহরির চত্বর’, প্রতিবেশী ‘শাহবাগ’ আন্দোলনের পাশে নন্দীগ্রাম-সিঙ্গুর খ্যাত সংস্কৃতি-কর্মীদের এত ম্লান, জীর্ণ লাগে কেন? কারণ হাঙরের দাঁতের ফাঁক দিয়ে তাঁদের দেশান্তরে যেতে হয়নি, নিরালোকে ভূতলবাস করতে হয়নি। প্রকৃত অর্থে যাকে বলে বিপন্নতা, বাঙালি বুদ্ধিজীবীর সঙ্গে তার দেখা হল কই? তার আন্দোলন ও গতিবিধি সবই টি-২০ ক্রিকেটের মতো উত্তেজনামুখর, দ্রুত ছন্দের ও মিডিয়া সমর্থিত।
পিকাসো ‘গুয়ের্নিকা’ এঁকেছিলেন স্পেনের গৃহযুদ্ধে। কী অবর্ণনীয় প্রতিভা! কী অমানুষিক শ্রম! আমাদের শিল্পী চট করে ছবি এঁকে টাঙিয়ে দিলেন নন্দীগ্রামের। স্থানীয় কবি রাতারাতি লোরকা বা এলুয়ার হতে চাইলেন। পথসভায় গিটার হাতে শ্মশ্রুশোভিত বব ডিলান! আবেগ ছিল সন্দেহ নেই, হাততালি ছিল আন্তরিক। কিন্তু স্বতঃস্ফূর্ততা তো সংস্কৃতির চেহারা পালটে দিতে পারে না। অভ্যুত্থানও একটি শিল্প। তাতে তপস্যা ও প্রশিক্ষণ লাগে। ফলে না হল সলিল চৌধুরীর সুর, বিজন ভট্টাচার্যের নাটক, না হল চিত্তপ্রসাদের ছবি, না হল ‘ছোট বকুলপুরের যাত্রী’। তেভাগার সঙ্গে এই আন্দোলনের পার্থক্য সহজেই অনুমান করা যায়। যে ইতিহাস সংলগ্ন বেঁচে থাকা, সার্ত্র যাকে এনগেজমেন্ট বলেন, তার বদলে একটি বিকল্প সরকারের বাসনা এত উদগ্র ও সম্মুখবর্তী হয়ে উঠল যে আমাদের পপুলার ফ্রন্ট একটি রাজনৈতিক দলকে ক্ষমতায় এনেই মুখ থুবড়ে পড়ল। বাঙালিদের প্রকৃতিগত উচ্ছ্বাস বাদ দিলে, আজ প্রমাণিত যে, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকা রাষ্ট্রবিরোধী সাংস্কৃতিক সঙ্গে গণতান্ত্রিক ভারতে একটি অঙ্গরাজ্যে সংসদীয় ভোটের লড়াই কোনও ক্রমেই শিল্প ও স্বাধীনতার সম্পর্কটিকে নতুন মাত্রা দেয়নি। নন্দীগ্রাম-সিঙ্গুর আন্দোলনের ভাষাও, সময়ের উত্তাপ কমে গেলে মনে হয়, আইপিটিএ যুগের অপভ্রংশমাত্র।
উন্নীত চৈতন্য, ভোক্তা ও স্রষ্টার পারস্পরিক স্বাধীনতার প্রয়োগ বা ‘জেনেরসিটি’ এই সাংস্কৃতিক মুহূর্তটিকে পল্লবিত করতে পারত। গত দশকের প্রতিবাদে এমন গভীরতা ছিল না, বরং পার্থিব বাসনা ছিল। ফলে শিল্পীর আমলায় পর্যবসিত হওয়া এত সহজ হল! সকলেই আজ প্রতিষ্ঠান স্থাপত্য— মঠের মোহান্ত বা তীর্থের পাণ্ডা। একের পর এক নট ও লেখক, নির্দেশক ও গায়ক যদি রাজ-পারিতোষিক অথবা চিটফান্ডের আস্থা অর্জন করার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠেন, তবে সমাজের নরকযাত্রায় প্রতিরোধ আর কে গ়ড়বে? আমাদের আপাতযান্ত্রিক রাজনৈতিক রাজধানী তবু অন্তত এক বার একটি হতভাগিনীর সমর্থনে উত্তাল হয়ে প্রমাণ করেছিল মানুষের শরীরের তাপ, মুম্বই বা পুণেও কোনও কোনও সময় সবাক হয়েছে, কিন্তু কুসংস্কারবশত যাকে আমরা অদ্যাবধি সাংস্কৃতিক রাজধানী বলে ভাবি, সেখানে গায়ক বা অভিনেতা ‘বাইট’ দিতে যত তৎপর, পার্কস্ট্রিট বা রানাঘাটে জনতার পথপ্রদর্শনে ততটা নয়। একের পর এক আর্থিক কেলেঙ্কারিতে টলি-অরণ্য নিষ্প্রভ হয়ে এল। চোর যদি বা মুখ খুলেছে সাধু নির্বাক। গ্রামের পুকুরঘাটে পরচর্চার ফাঁকে ফাঁকে সে ভাবে আধঘণ্টার আন্তর্জাতিক খ্যাতির কথা। কিছু একটা করতে চাইছে আজকের কলকাতার লোক। কিন্তু করার ভাষা সে ভুলে গেছে। আশ্চর্য! এই শহরের লেখক, ছাত্র, গৃহবধূ এক সময় ভিয়েতনাম বা আরব দুনিয়ার কথাও ভাবত।
জীবনানন্দের মতো করে বলা যায়, ‘এ রকম কেন হয়ে গেল তবে সব/বুদ্ধের মৃত্যুর পরে কল্কি এসে দাঁড়াবার আগে।’ ঋত্বিক ঘটকের মতো করে বলা যায়, ‘দেশটি ক্রমশ ইতরের দেশ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।’ সমস্যা একটাই। আমাদের রবীন্দ্রনাথ ছিলেন। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের হঠাৎ ঝলকানির পর কেন অন্ধকার থেকে অন্ধকারে তলিয়ে গেলাম? ‘সভ্যতার সংকট’ পড়তে গিয়ে তাই মনে হল, আমরা, তাঁর উত্তরসূরিরা, ‘ইতিহাসের কী অকিঞ্চিৎকর, উচ্ছিষ্ট, সভ্যতাভিমানের পরিকীর্ণ ভগ্নস্তূপ!’ আজকের বঙ্গসংস্কৃতির প্রতিনিধি আসলে বিবেকের বনসাই বা বাঁকু়ড়ার ঘোড়া: দাঁড়িয়ে আছে মধ্যবিত্তের বসার ঘরে। নিজের দেশকে তো আর ইতর বলে দেখানো যায় না। ব্যাপারটা অধার্মিক।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে চলচ্চিত্র বিদ্যার শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy