Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

ঝরা শালপাতার গন্ধ, পাখির ডাক, উদাসী বিভূতিভূষণ

একবার বসন্ত কালে ঝাড়গ্রামে এসে হাজির বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রকৃতির মাঝে পেলেন বিরাট শান্তির পরশ। একবার দেখা হল প্রেমেন্দ্র মিত্রের সঙ্গে। লিখলেন মৃন্ময় হোতাএকবার বসন্ত কালে ঝাড়গ্রামে এসে হাজির বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রকৃতির মাঝে পেলেন বিরাট শান্তির পরশ। একবার দেখা হল প্রেমেন্দ্র মিত্রের সঙ্গে।

নিদর্শন: আবগারি আবাসনের সেই ইঁদারা। নিজস্ব চিত্র

নিদর্শন: আবগারি আবাসনের সেই ইঁদারা। নিজস্ব চিত্র

শেষ আপডেট: ০৫ মার্চ ২০১৯ ০১:০৩
Share: Save:

ভরা বসন্তে ঝাড়গ্রাম এলেন বিভূতিভূষণ। ১৯৪৩ সালের ৪ মার্চ। ডায়েরিতে লিখলেন, ‘বিকেলে একটা নতুন পথে অনেক জঙ্গলের মধ্যে বেড়িয়ে এলুম কিছুদূর। কল্যাণী খুব ভাবছিল। আমায় দেখে খুশি হোল’। বিকেলে কল্যাণীকে নিয়ে একান্তে বেড়াতে যান বাণীভবনের পথে। বাণীভবনের পুকুরে নামার চেষ্টা করেন। ফেরার পথে সাবিত্রী পুকুরের পাড়ে কল্যাণীকে নিয়ে বসে পড়েন। অনেকক্ষণ ধরে পুরনো দিনের গল্প চলল। পরের দিন বাজার-স্টেশন চত্বরে ঘুরতে গিয়েছিলেন। কিছু ছাত্র তাঁকে চিনতে পারেন। প্রিয় লেখককে মেসে নিয়ে গিয়ে চা খাওয়ান তাঁরা। সেদিন সন্ধ্যায় বাসায় ‘ডাকঘর’ নাটক অভিনয় হয়। সকলেরই শুতে অনেক রাত হয়। কল্যাণী স্বামীকে বলেন, ‘আমায় খোকার গল্প কর। তারপর ছেলেমানুষের সুরে ঘুমপাড়ানি গোছের একটি কবিতা বলে– ‘খোকা আমার সাত সাগরের পার...’। বিভূতিভূষণের বেশ লাগে। পঙক্তিটি মনে গেঁথে যায়। পরে বহু জায়গায় এর উল্লেখ আছে। একটি পুত্র সন্তানের কামনা সেই সময়ে তাঁদের হৃদয়ে গভীর হচ্ছিল।

৬ই মার্চ সাবরেজিস্টার কান্তিবাবুর সঙ্গে বাজারে যান, ফেরার পথে মহকুমাশাসক মির্জা সাহেবের সঙ্গে আলাপ হয়। বিকেলে বাণীভবনের রাস্তা ধরে ‘বনে-পাহাড়ে’তে উল্লেখিত সাধুর খানাকুই (পড়ুন খানাকুল) এর আশ্রমে এলেন। উন্মুক্ত প্রান্তর, ঘন শালবন আর ঝরনা দেখে সেখানে বাড়ি তৈরির ইচ্ছে জাগে লেখকের। সাধু বলেন, জমি খুব সস্তা। বিভূতিভূষণ উৎসাহিত। সাধুকে জমি দেখা ও বাড়ি তৈরির দেখাশোনা করে দেওয়ার দায়িত্ব দেন। টাকা পাঠিয়ে দেওয়ার কথা বলেছিলেন। কিন্তু পরে ভুলে যান।

খানাকুই পর্বের কথা ‘বনে-পাহাড়ে’ বিস্তারিত রয়েছে। পরের দিন সকালে কল্যাণী, মায়া ও বেলুকে নিয়ে আবার ওই আশ্রমে যান। বিকেলে ঝরনার টানে শালবনে বসে লিখলেন, ‘শালবনের পথে কতদূর গিয়ে একটা ঝর্ণা পেলুম। চুপ করে বসলুম তার নির্জন তীরে। এক জায়গায় একটা বাঁধানো বাঁধ। সন্ধ্যায় নিবিড় ছায়া নেমেছে শালবনে, শুষ্ক ঝরাপাতার কেমন সুন্দর গন্ধ। উদাস করে মন—ঘন শালবনে ভয়ও হয়—...কতক্ষণ বসে বসে ভাবলুম, পৃথিবীতে এক লক্ষ beauty spot আছে। মানুষ জীবনে পাঁচ হাজার দেখতে পারে।...কি সুন্দর রাত্রির হাওয়া’! সেদিন রাতেই ছিল ব্রহ্মানন্দ হোতার বাড়িতে বিবাহ অনুষ্ঠান। বসন্তের শালবন বিভূতিভূষণের মনকে নিয়ে গিয়েছিল এক কল্পলোকে। পরের দিন সকালে আবার এলেন সেই শালবনে। ডায়েরিতে লিখলেন, ‘মনে অপূর্ব ধ্যানের ভাব আসে।...ঝরা শালপাতার রাশির ওপরে গভীর বনে পাখীর কুজনের মধ্য বসে গায়ত্রী মন্ত্র উচ্চারণ করে যেন মনে হয় বৈদিক যুগে আছি। গভীর শান্তি। ভগবানকে মুখোমুখি পাই। তিনি এই বিরাট শান্তির মধ্যে, নিস্তব্ধ প্রকৃতির কোলে আসন পেতেছেন’। এরকম ভাবে আর কেউ কি ঝাড়গ্রামের সৌন্দর্যকে উপলব্ধি করেছেন? সেদিন বিকেলে স্টেশনে ছাড়তে এসেও কল্যাণী প্রিয় মানুষটিকে বলেন, ‘চল আজ ফিরে যাই’। কিন্তু ডাক এসেছে সিং সাহেবের, মানভূম বেড়ানোর জন্য।

ইতিমধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু। জিনিসপত্রের দামও চড়ছে। বাসায় স্থানাভাব, স্টেশন থেকেও অনেকটা দূর। তাই পুরনো ঝাড়গ্রামের বাসা ছেড়ে ষোড়শীকান্তের পরিবার উঠে এল রেললাইনের কাছে এক মাড়োয়ারির বাড়িতে। তাঁদের ছোট্ট মেয়েটির নাম রেবতী। ২৭ অগস্ট নতুন বাসা খুঁজে আবার ঝাড়গ্রামে এলেন বিভূতিভূষণ। মেজদির বর। তাই সবাই ওঁকে মেজদা বলে ডাকতেন। ছোট্ট রেবতীরও ‘মেজদা’। লেখক মজা পান। তাঁর কোলে চেপে রেবতী পুকুরে স্নানে যায়। পরম মমতায় তিনি তাকে স্নান করান। বুকে যে কন্যা হারানোর দুঃখ। গুণী মানুষটিকে বিরক্ত করার অপরাধে রেবতীর মা তাকে মেরেছিলেন।

ষোড়শীকান্তের প্রথম বাসাটি ছিল পুরনো ঝাড়গ্রামের আবগারি অফিসের চত্বরে একটা ল্যাটেরাইট (মাকড়া) পাথরের বাড়ি। বাইরে টিনের বারান্দা। ওই বাসায় থাকতেন ষোড়শীকান্তের স্ত্রী, দুই পুত্র ও কন্যারা। যার পাশেই ছিল ইনস্পেক্টর অফিস এবং অন্যদের থাকার টিনের ব্যারাক। পাশেই থাকতেন সর্বাধীকারী পরিবার। ঝাড়গ্রামের বর্তমান রাজবাড়ি এঁদের তত্ত্বাবধানে তৈরি। পরের দিনই কল্যাণীর বাক্স নিয়ে বিভূতিভূষণ ঘাটশিলায় ফেরেন শ্বশুরবাড়ির দেশ ঝাড়গ্রামকে শেষ প্রণাম জানিয়ে।

ইতিমধ্যে ঝাড়গ্রামে তৈরি হয়েছে অনেক গুণমুগ্ধ। যেমন মিসেস দাস। যাঁর কথা বারে বারে লিখেছেন। মিসেস দাসের বাড়িতেই ‘ডাকঘর’ অভিনয় উপলক্ষে ১৯ ডিসেম্বর ঝাড়গ্রামে এলেন। তখনও বোধহয় ঝাড়গ্রামের মূল পথটি পাকা হয়নি। ডায়েরিতে লিখছেন, ‘ঝাড়গ্রামের ধূলিধূসর পথে রাজবাড়ী, সাবিত্রী মন্দির, আমার পুরানো শ্বশুরবাড়ী ইত্যাদি ঘুরে রাজবাড়ীর হাট দেখে, দারুচিনি গাছের ডাল ভেঙে নিয়ে এলুম। এসে ভূরিভোজন করা গেল...ডাকঘর হোল। বেশ পরিকল্পনা করেছিল বাড়ীটার’। বাড়ি বলতে এখানে উনি বোধহয় নাটকের সেট বোঝাতে চেয়েছেন। অনেক রাতে রাঁচি এক্সপ্রেস ধরে ঘাটশিলায় ফেরেন।

এই সময়ে বিভূতিভূষণ এক সঙ্গে ‘দেবযান’ ও ‘বনে-পাহাড়ে’ লিখছিলেন। কাজের চাপ ছিল। কিন্তু ঘাটশিলায় থাকলে দ্বিজুবাবুর, দ্বিজেন্দ্রনাথ মল্লিক, বাড়ি যাওয়া চাই–ই-চাই। ওখানেই ২৯ ডিসেম্বর মিসেস দাস-সহ ৪৫ জনের দল ঝাড়গ্রাম থেকে ‘ডাকঘর’এর কল শো করতে আসেন। পরের দিন সেখানে ঝাড়গ্রামের প্রখ্যাত সাহিত্যিক নৃপেন্দ্র মিত্রের সঙ্গে আলাপ ও বহুক্ষণ সাহিত্য আলোচনা করেন। ১৯৪৪, ১৯৪৬, ১৯৪৭, ১৯৪৮, ১৯৪৯ সালের কোনও ডায়েরি পাওয়া যায় না। ১৯৪৫ সালের ডায়েরিতে ঝাড়গ্রামের কথা একবারই আছে। ৩ নভেম্বর মুসৌরি ভ্রমণ করে হাওড়া ফেরেন। তারপর ওখান থেকেই ট্রেন বদলে ঘাটশিলা ফেরেন রাতে। ঝাড়গ্রাম স্টেশনে গাড়ি থামলে দেখেন শহরে দীপাবলির উৎসব চলছে। ১৯৫০ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর শেষবারের মত বিএনআর-এর পথে ঘাটশিলায় আসেন। ডায়েরিতে লিখলেন, ‘খড়গপুর ছাড়িয়ে হঠাৎ ন’মাস পরে আজ সবুজ লতাঘাস, মুক্ত space ও শালবনের দৃশ্য দেখে মন কোথায় উঠে গেল।...রাস্তার দু’ধারে সবুজ বনানী। গিডনি ছাড়িয়েই পাহাড় দেখলুম ন’মাস পরে’।

বিভূতিভূষণের দুই শ্যালিকার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল। তাঁরা হলেন গুজরাতের বরোদা নিবাসী শুভা অধিকারী (শুবু) ও ব্যারাকপুর নিবাসী শ্যামা ভট্টাচার্য (খুকু)। শ্যামাদেবীর ঝাড়গ্রামের কোনও স্মৃতি নেই। কারণ তখন তাঁর এক বছর বয়স। কিন্তু শুভাদেবী ঝাড়গ্রামের অনেক কথাই মনে করে বলতে পারলেন। বললেন, ‘‘বিভূতিভূষণ এলে বেড়াতে যেতাম বাণীভবনের রাস্তায়। তখন আমি বাণীভবনে পড়ি। ছোট ছিলাম বলে বিভূতিভূষণ আমায় খুব রাগাতেন। সেই সময় পাড়ার অনেকে মিলে আমাদের বাসার সামনে ডাকঘর অভিনয় করি। অজিতদা, দীপেন্দুদা ছিলেন। আর আমি করেছিলাম সুধার চরিত্র। যেদিন অভিনয় হয় বিভূতিভূষণ ও প্রেমেন্দ্র মিত্র দেখতে এসেছিলেন।’’ শুভা জানালেন, দীপেন্দুদা (মনোবিদ দীপেন্দু সর্বাধিকারী) ও শান্তিদির বাড়িতে ছিল দুই যমজ ভাই-বোন গোরা (বিখ্যাত রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী গোরা সর্বাধিকারী) ও বাণী। তার পর শুভারা রেললাইনের ওপারে, এখনকার বামদা, এক মাড়োয়ারির বাড়ি ভাড়া নেন। বাড়িওয়ালার ছিল দোকান আর আটা তৈরির কল। ষোড়শীকান্ত ঝাড়গ্রাম থেকে হাওড়ার আমতায় বদলি হলে তাঁরা সেখানে চলে যান। শুভা বলছিলেন, ‘‘রেবতী ছিল আমার খেলার সাথী। মনে হয় একবার যদি শান্তিদি আর রেবতীর সঙ্গে কথা বলতে পারতাম!” শান্তি সর্বাধিকারী ৩০ বছর আগে ব্যাঙ্ককে মারা গেছেন। রেবতীর কোনও খোঁজ পাওয়া যায়নি।

প্রকৃতি প্রেমে মুগ্ধ আনন্দময় পুরুষটি ১৯৫০ সালের ১ নভেম্বর ঘাটশিলায় মারা যান। মাত্র ৫৬ বছর বয়সে। এটা বিভূতিভূষণের জন্মের ১২৫তম বছর। শ্বশুরবাড়ির দেশ ঝাড়গ্রামের মানুষেরা কি মনে রেখেছে বিভূতিভূষণকে? ঝাড়গ্রাম পাল্টেছে অনেকটাই। তাঁর শ্বশুরবাড়ির পুরনো বাসা ও ব্যারাক ভেঙে হয়েছে নতুন কমপ্লেক্স। থেকে গিয়েছে পুরনো ইঁদারা ও শিমূল গাছটা। তাঁর প্রিয় শাল গাছগুলোর কিছু এখনও আছে অনাদরে। তাঁর প্রিয় বাণীভবনের রাস্তাও পাল্টেছে অনেক।

এই পথে একা একা হাঁটতেন ‘পথের কবি’।

লেখক শিক্ষক ও গবেষক

কৃতজ্ঞতা: মিত্রা বন্দোপাধ্যায় (বিভূতিভূষণের পুত্রবধূ), অধ্যাপক তথাগত বন্দোপাধ্যায় (পৌত্র) এবং শুভা অধিকারী (শ্যালিকা)।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE