মঞ্চে বক্তৃতায় নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়।—ছবি রয়টার্স।
শুধু ভারত নহে, কার্যত বিশ্বের যে কোনও দেশের শীর্ষনেতৃত্বকে দেখিলে বিশ্বাস করিতে ইচ্ছা করিবে যে দারিদ্র, অনুন্নয়ন ইত্যাদি সমস্যার সমাধান ইতিমধ্যেই হইয়া গিয়াছে। পড়িয়া আছে শুধু একটিই সমস্যা— কাহাদের ‘অপর’ বলিয়া দাগাইয়া দেওয়া হইবে, কাহাদের মুখের উপর দেশের দরজা বন্ধ করিয়া দেওয়া হইবে। ভারতে নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহরা নাগরিক পঞ্জি আর নাগরিকত্ব বিল লইয়া মাতিয়া রহিয়াছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্পসাহেব দেশসীমান্তে দেওয়াল খাড়া করিতে বলিতেছেন। ব্রিটেনে ব্রেক্সিটের ধাক্কায় অর্থনীতি পথে বসিবার জোগাড়, কিন্তু রাজনীতির তরজা চলিতেছে কাহাকে ব্রিটেনে থাকিতে দেওয়া যাইবে না, তাহা লইয়া। এই তর্কে রাজনীতিকদের বিস্তর সুবিধা— তাঁহারা কী পারেন নাই, পারিবেন না, সেই ফিরিস্তি দিবার বিশেষ দায় থাকে না। আরও সুবিধা, এ-হেন ছদ্ম জাতীয়তাবাদে বেশির ভাগ মানুষও খুব সহজে নাচিয়া উঠেন— ফলে, পেটে ভাত জুটিতেছে কি না, সেই প্রশ্নটি সাময়িক ভাবে হইলেও গৌণ হইয়া যায়। এই ভাবে যখন রাজনীতির কুলার বাতাসে উন্নয়নের বৃহত্তম প্রশ্নটিই আলোচনার পরিসর হইতে বিদায় হইবার জোগাড়, ঠিক সেই সময়েই অর্থনীতির নোবেল পুরস্কার দারিদ্রের প্রশ্নটিকে আলোচনার প্রাণকেন্দ্রে লইয়া আসিল। অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়, এস্থার দুফলো ও মাইকেল ক্রেমারের নোবেলজয় দারিদ্রের প্রশ্নটিকে একেবারে সরাসরি আক্রমণ করিবার সুবাদেই। উগ্র জাতীয়তাবাদ, জনবিদ্বেষের ন্যায় ভয়ানক প্রশ্নগুলিকে দূরে ঠেলিয়া যদি কিছু দিনের জন্যও রাজনীতির পাদপ্রদীপের আলোয় দারিদ্রের প্রশ্নটি থাকিতে পারে, তাহাতে পৃথিবীর উপকার হইবে।
র্যান্ডমাইজ়ড কন্ট্রোল্ড ট্রায়াল বা আরসিটি-কে অর্থনীতি বলা চলিতে পারে কি না, রবিবার স্টকহলমে অভিজিৎ বিনায়কের নোবেল-প্রাপ্তি ভাষণের কেন্দ্রে ছিল সেই প্রশ্নটিই। সেই প্রসঙ্গেই তিনি আরও এক বার স্মরণ করাইয়া দিলেন, দারিদ্রের সমস্যাটিকে তাঁহারা কী ভাবে ভাঙিয়া ভাঙিয়া দেখেন। কী ভাবে প্রশ্ন করেন প্রচলিত ধারণাকে। যেমন, গরিবদের কিছু টাকা এবং যথেষ্ট পরিমাণে উৎসাহ দিলে তাঁহারা যে দারিদ্রের ফাঁদ কাটিয়া বাহির হইতে পারেন, এই কথাটির প্রমাণ তাঁহারা গবেষণায় পাইয়াছেন। অর্থাৎ, গরিবকে টাকা দিলে তাঁহারা আরও অলস হইবেন, অথবা টাকাটি নেশাভাং করিয়া নষ্ট করিয়া ফের দারিদ্রের কোটরে ঢুকিয়া যাইবেন, এই প্রচলিত বিশ্বাসটি প্রকৃত প্রস্তাবে ভিত্তিহীন।
কথাটি রাজনীতির পরিসরে খুবই গুরুত্বপূর্ণ হইতে পারিত। কারণ, অভিজ্ঞতা বলে, রাজনীতি দারিদ্রের প্রশ্নটিকে এই ভাবে দেখিতে শিখে নাই। সরকারের রাজনৈতিক মতবাদের উপর নির্ভর করিয়া হয় গরিবকেই দায়ী করা হয় নিজের দারিদ্রের জন্য; অথবা, তাঁহাদের ভোটব্যাঙ্ক ভাবিয়া টাকা বিলাইয়া দেওয়া হয়, কোনও দায়বদ্ধতার উল্লেখ ছাড়াই। কোনও পথই যে প্রকৃত উন্নয়নের পথ নহে, উল্লিখিত গবেষণা হইতে রাজনীতি তাহা শিখিতে পারে। হয়তো প্রশ্ন উঠিবে, তাঁহাদের এই গবেষণালব্ধ ফলাফল বহু বৎসর যাবৎ গণপরিসরে আছে— এত দিন যদি রাজনীতি সেই পাঠ গ্রহণ না করে, আজই বা করিবে কেন? উত্তরটি জটিল নহে— ঠেকায় পড়িয়া আজ নোবেল পুরস্কারের মাহাত্ম্যের উপর নির্ভর করিতে হইতেছে। আর এক বার যদি পুরাতন মৌলিক প্রশ্নটি মঞ্চকেন্দ্রে ফিরিতে পারে, সেই আশা করিতে হইয়াছে। রাজনীতি শেষ অবধি এই পাঠ গ্রহণ করিবে কি না, না কি উগ্র সঙ্কীর্ণতার পথেই থাকিবে, তাহা ভবিষ্যৎ বলিবে। কিন্তু, যাঁহাদের হাত ধরিয়া দারিদ্রের বিপুল গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি বিশ্বমঞ্চে আলোচনার প্রাণকেন্দ্রে ফিরিয়া আসিল, তাঁহাদের অন্যতম যে এক বঙ্গসন্তান— এই সত্যটি আপাতত বাঙালিকে গর্বিত করিতে পারে। এই আকালে এমন গর্ববোধের সুযোগ সহজ কথা নয়!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy