প্রতীকী চিত্র।
গৃহ হইতে মেয়েরা সাবধান। কারণ আপন গৃহের পরিচিত পরিসরটিই তাহার পক্ষে সর্বাপেক্ষা বিপজ্জনক। এ হেন সাবধানবাণীটি রাষ্ট্রপুঞ্জের প্রদত্ত কিছু পরিসংখ্যানে ধ্বনিত হইয়াছে। পরিসংখ্যানটি ভয়ঙ্কর। ২০১৭ সালে গোটা বিশ্বে যত জন মহিলাকে হত্যা করা হইয়াছে, তাহার মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি ক্ষেত্রে অপরাধী তাহার স্বামী, প্রেমিক অথবা নিকটাত্মীয়। প্রতি ঘণ্টায় বিশ্বের নানা কোণে অন্তত ছয় জন মহিলা নিহত হইতেছেন তাঁহার অত্যন্ত কাছের মানুষটির হাতে। ইহাদের মধ্যে কাহারও সঙ্গে তাঁহার রক্তের সম্পর্ক, কাহারও সঙ্গে আবদারের সম্পর্ক, আবার কাহারও সঙ্গে গাঁটছড়া ভালবাসার। কিন্তু হিংসার সামনে এই সব সম্পর্কই তুচ্ছ হইয়া দাঁড়াইয়াছে।
রিপোর্টটি প্রকাশিত হইয়াছে ২৬ নভেম্বর। দিনটি তাৎপর্যপূর্ণ: মহিলাদের উপর হিংসা রুখিবার আন্তর্জাতিক দিন। সেই দিনেই জানা গেল, বিশ্বময় মেয়েদের উপর হিংসা রুখিতে তাহার সর্বাপেক্ষা নিরাপদ স্থানটিই সর্বাধিক ব্যর্থ। কথাটি নূতন বলা চলে না। নূতনত্ব একমাত্র এইখানে যে, জানা সমস্যাটি পরিসংখ্যানের হাত ধরিয়া এত দিনে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাইল। অতঃপর লিঙ্গ বৈষম্যের প্রেক্ষিতে হরিয়ানার সঙ্গে কেনিয়ার কোনও পার্থক্য রহিল না। এই আন্তর্জাতিকতাবাদের অংশটুকু সরাইয়া লইলে যাহা পড়িয়া থাকে, তাহার নির্যাস— সব দেশে, সব ধর্মে মেয়েদের দুর্ভাগ্যের সূচনাটি নিজ ঘরেই; দেশভেদে এবং প্রগতিশীলতার বিচারে তাহার সংখ্যা কিছু বাড়িতে বা কমিতে পারে। প্রসঙ্গত, রাষ্ট্রপুঞ্জের পরিসংখ্যান তো শুধুমাত্র খুন হওয়া মেয়েদের কথা বলিয়াছে। হেনস্থা, নির্যাতন এবং বঞ্চনার উদাহরণ ধরিলে তো শতাংশের হিসাবে তাহা একশতর ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলিবে। কন্যাসন্তান হইয়া জন্ম লইবার পর হইতে অধিকাংশ মেয়েকেই যে নির্যাতন সহিয়া এবং লড়াই করিয়া নিজের এবং কন্যার প্রাপ্যটুকু আদায় করিতে হয়, তাহা খুন অপেক্ষা কম কিসে? শুধুমাত্র মেয়ে হইবার কারণে তাহার স্থান যে পুরুষদের পিছনে এবং আমৃত্যু তাহাই থাকিবে, ইহার প্রথম পাঠটিও তো সে নিজ ঘরেই শেখে। আত্মীয়-পরিজনের হাতে নির্যাতিত, ধর্ষিত হইয়াও বাহিরে তা প্রকাশ না করিবার শিক্ষাও তাহাকে ‘নিরাপদ’ গৃহকোণটিই দেয়। মনের দিক হইতে ইহাও তো এক রকম হত্যাই। পরিসংখ্যান দিয়া তাহার হদিস পাওয়া দুষ্কর।
প্রকৃতপক্ষে, হত্যার প্রাপ্ত পরিসংখ্যান একটি সামান্য অংশেই আলো ফেলিতে পারে। অন্ধকার আরও অনেক গভীর, অনেক বিস্তৃত। এই অন্ধকারের অনেকটাই— সমস্যা অস্বীকারের। ব্রিটেনের একটি ওয়েবসাইটের দাবি, সম্মান রক্ষার্থে হত্যার ঘটনা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নথিভুক্ত হয় না। কারণ, পরিবারই ইহাকে ‘খুন’ বলিয়া স্বীকার করে না, নিজেদের কর্তব্য বলিয়া মানে। পশ্চিম এশিয়ায় সিরিয়ার মতো কিছু দেশে যেমন সম্মান রক্ষার্থে খুন পরিবারের পুরুষদের পবিত্র কর্তব্য। ভুলিলে চলিবে না, মেয়েদের দুরবস্থার নিরিখে এশিয়ার স্থানই প্রথম দিকে। এই মহাদেশেই ঘনিষ্ঠ মানুষদের হাতে খুন হওয়া মেয়েদের সংখ্যা গত বৎসর সর্বাপেক্ষা বেশি ছিল। রাষ্ট্রপুঞ্জের এই রিপোর্টে যাঁহারা আঁতকাইয়া উঠিতেছেন, তাঁহাদের মনে রাখিতে হইবে, ইহা হিমশৈলের চূড়ামাত্র। হিমশৈলের বাকি অংশটি রহিয়াছে পরিসংখ্যানের নাগালের অতীত বাস্তবের বিরাট বীভৎসতায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy