Advertisement
০১ মে ২০২৪
Sheikh Hasina

নামভূমিকায়: জানুয়ারি ২০২৪

পঞ্চম বার জয়ী হয়ে বিশ্বে দীর্ঘতম কালের নেত্রী। দেশবিদেশে তাঁকে নিয়ে প্রশ্ন অনেক। প্রখর বুদ্ধিতে সব বাধাই পেরোন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

An image of Sheikh Hasina

—ফাইল চিত্র।

অনমিত্র চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৮ জানুয়ারি ২০২৪ ০৮:২১
Share: Save:

বা‌ংলাদেশে ৭ জানুয়ারি সাধারণ নির্বাচনে যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই আবার জয়ী হবেন, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা ছিল না। বিরোধীরা নির্বাচন বয়কট করার পরে তিনি হারবেন কী করে। কিন্তু অনিশ্চয়তা ছিল একটা অন্য বিষয়ে। এমন একটা একপেশে ভোটে মানুষ বুথমুখো না হলে, বয়কটের জয় বলে যে দাবি উঠত, বিলক্ষণ জানতেন তিনি। জানতেন, বিরোধীদের পাশাপাশি আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নও তাঁকে এ নিয়ে আক্রমণ করতে মুখিয়ে রয়েছে।

তিনি জিতলেন। ৪১.৮ শতাংশ ভোট পড়েছে বলে ঘোষণা করল নির্বাচন কমিশন, যার সারবত্তা নিয়ে যদিও প্রশ্ন তুলতে ছাড়ল না বিরোধীরা। কিন্তু শেখ হাসিনা কী রকম নেতা, সেটা আরও এক বার প্রমাণিত হল। অসামান্য দৃঢ়তা ও আত্মপ্রত্যয় নিয়ে এই পঞ্চম বারের জন্য প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পাওয়া জননেত্রী ভোটের ফল বেরোনোর পর নিজের বাসভবনের সাজানো লনে ১১টি দেশ থেকে আসা সাংবাদিক ও নির্বাচনী পর্যবেক্ষকদের দাওয়াত দিলেন। প্রশ্নোত্তর পর্বে আমেরিকার নির্বাচনী পর্যবেক্ষক কিছু বলতে যেতেই তাঁকে পাল্টা প্রশ্নবাণে ফুঁড়ে দিলেন হাসিনা, “কেমন ভোট দেখলেন? লোকে বাধা পেয়েছেন ভোট দিতে গিয়ে? আমাদের ভোট না আমেরিকার ভোট, কোনটা বেশি ভাল লাগল দেখে?” পর্যবেক্ষক বললেন, “বাংলাদেশের ভোট নিয়ে অনেক বেশি প্রশ্ন উঠেছিল...।” হাসিনার জলদি-জবাব, “আপনারা বড় দেশ, শক্তি বেশি বলে কেউ প্রশ্ন তোলে না। আমরা ছোট দেশ তো। তবে মনে রাখবেন, আমাদেরও সার্বভৌমত্ব আছে। যে যা খুশি বলে যাবেন, আমাদের ভাল লাগে না সেটা।” তার পরেই অবশ্য ঠোঁটের কোণে হাসি ঝুলিয়ে জানিয়ে দিলেন, দিল্লিতে জি২০ শীর্ষ বৈঠকে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন তাঁর সঙ্গে কথা বলে কেমন উচ্ছ্বসিত হয়েছিলেন। সকন্যা তাঁকে ডেকে নিজস্বী তুলেছিলেন। নিজের এক্স হ্যান্ডলে সেই ছবি প্রকাশ করে বাংলাদেশকে প্রশংসায় ভরে দিয়েছিলেন।

পঞ্চম বার মহিলা প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথ নিয়ে তিনি এখন ইতিহাসে দীর্ঘতম সময় শীর্ষনেত্রী থাকার রেকর্ড তৈরি করে ফেলেছেন। ইন্দিরা গান্ধী, সিরিমাভো বন্দরনায়ক, মার্গারেট থ্যাচার বা গোল্ডা মেয়ারকে ছাপিয়ে গিয়েছেন। কাজটা সহজ তো নয়ই, বাংলাদেশের রাজনীতি মনে রাখলে বোঝা যায় কতটা কঠিন। বিরাট চ্যালেঞ্জের মুখে তিনি এই দুরূহ কাজ কী ভাবে করলেন, তা বোঝার জন্য সে দিনের এই সভাটি সহায়ক হতে পারে। বোঝা যায়, নেত্রী হিসাবে শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যার বিশেষত্বগুলি কী ধরনের। আরও অনেক কিছুর সঙ্গে তিনি অসামান্য দক্ষ ভারসাম্যের কৌশল রাখতে, দুর্জয় সাহস এবং জনসম্পৃক্ততা তুলে ধরতে।

পশ্চিমি সংবাদমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে হাসিনা আগেও তুলোধোনা করেছেন বাইডেন প্রশাসনকে। বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে ওয়াশিংটন থেকে ঢাকার পুলিশের সমালোচনা হলে সঙ্গে সঙ্গে আমেরিকার বর্ণবৈষম্য, সে দেশের পুলিশের ধুমধাড়াক্কা গুলি চালনার কথা উত্থাপন করতে গলা কাঁপেনি হাসিনার।

প্রত্যাঘাত আসবে জেনেও বিচারের কাঠগড়ায় তুলেছেন একাত্তরে গণহত্যার নায়ক, পাকিস্তানের অনুচর রাজাকার-আল বদর নেতাদের। তাঁদের ফাঁসির আদেশ কার্যকর না করে যাতে মুক্তি দেওয়া হয়, টেলিফোনে চাপ দেন তৎকালীন আমেরিকার বিদেশসচিব হিলারি ক্লিনটন স্বয়ং। পাল্টা প্রশ্ন ছিল হাসিনার, “বিচারবিভাগের উপরে সরকারের হস্তক্ষেপ মেনে নেবেন তো?” তেমন হস্তক্ষেপের হাজারো অভিযোগে হাসিনা বিদ্ধ হলেও, হিলারি ক্লিন্টন সরাসরি সেই পরামর্শ তাঁকে দিতে পারেননি। আবার নয়াদিল্লিতে আমেরিকার প্রেসিডেন্টকে হাতের কাছে পেয়ে উচ্ছ্বাস দেখিয়েছেন অতিমাত্রায়।

এটাই হাসিনার ভারসাম্যের কৌশল। এই কৌশলেই শাহবাগের গণজাগরণের বার্তা পেয়ে গতি আনেন রাজাকারদের বিচারে। আবার সেই আন্দোলনে প্রতিষ্ঠান-বিরোধী গন্ধ পাওয়ামাত্র আন্দোলনকারীদের ‘নাস্তিক’ বাণে বিক্ষত করেন। জামাতে ইসলামিকে ছত্রভঙ্গ করে দিয়েও ‘কওমি জননী’ হয়ে ওঠেন কট্টর মৌলবাদী হেফাজতে ইসলামি-র। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদকে সামনে রেখে আমেরিকা বিকল্প রাজনৈতিক সমীকরণ সাজাচ্ছে বুঝে আন্তর্জাতিক প্রভাবের তোয়াক্কা না করেই আক্রমণ শাণান মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে। বিশ্ব ব্যাঙ্ক পদ্মা সেতু নির্মাণে ঋণ দেওয়া থেকে পিছিয়ে যাওয়ায় ইউনূসেরই ‘নাশকতা’ খুঁজে পান হাসিনা। তার পরে রাষ্ট্রের নিজস্ব তহবিল থেকে ৩৩ হাজার কোটি টাকার সেই সেতু নির্মাণের কথা ঘোষণা করেন।

বাংলাদেশের অর্থনীতির ভোল বদলানোর চাবিকাঠি নিয়ে পদ্মা সেতু চালু হয়েছে ভোটের আগেই। রাজনৈতিক বিরোধী ও সমালোচকদের জেলে ভরা আর সাজানো সংঘর্ষে হত্যাকাণ্ডের অভিযোগের পাহাড় ঠেলে অনুন্নত দেশের তালিকা থেকে বাংলাদেশকে ইতিমধ্যেই হাসিনা পৌঁছে দিয়েছেন মধ্য আয়ের দেশগুলির সারিতে। নির্বাচনে জেতার পর তাঁর লক্ষ্য এখন ২০৪১-এর মধ্যে বাংলাদেশকে উন্নত দেশে উন্নীত করা। আর ইন্দিরা, বন্দরনায়ক, থ্যাচারদের অতিক্রম করে যাওয়া? বিনীত জবাব মুজিব-কন্যার, “তাঁরা বড় বড় মানুষ। আমি নেহাতই সাধারণ। বেশি লেখাপড়ার সুযোগ পাইনি। তবে ছোট বয়সে বাবা-মা, চাচা, তিন ভাই, দুই ভাবীকে একই রাতে হারিয়েছি। খুনিদের ভয়ে পালিয়ে বেড়িয়েছি দেশে দেশে। গরিব মানুষের দুঃখ কী, সেটুকু আমি বুঝি!”

আমেরিকা যা-ই বলুক, শেখ হাসিনা মাঠে নামলে মাঠ তো নগণ্য, নগরী আজও উপচে পড়ে জনতার ঢলে। যে জনতা ভাবে, তিনি বাংলাদেশের গৌরবমুখ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Sheikh Hasina Bangladesh Prime Minister Bangladesh
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE