সবাই স্বাধীন, সবাই সমান, সবাই স্বজন। কুচকাওয়াজ চলছে প্রজাতন্ত্র দিবসে, যেন শব্দগুলোই গটমটিয়ে যাচ্ছে। সংবিধান থেকে নেমে রাজপথ ধরে চলেছে কদম কদম, লিবার্টি, ইকুয়ালিটি, ফ্রেটার্নিটি।— দেখতে দেখতে শুনতে শুনতে শব্দরা হয়ে যায় এক একটা নাম। প্রিয়া রামানি, ঘজ়লা ওয়াহাব, সন্ধ্যা মেনন, নিষ্ঠা জৈন, পল্লবী গগৈ... কাজের জগতে সমান সম্মান চেয়ে দেশটাকে সবার জন্য সমান করতে চাইলেন যাঁরা।
শুনে কুঁচকে যায় অনেক জোড়া ভুরু, সিঁটকে যায় নাক। ‘মি টু’? ও তো স্ক্যান্ডাল! পনেরো বছর আগে কী না কী হয়েছে, তার খেই ধরে মানুষকে বিপদে ফেলা। এত দিন কোন মতলবে চুপ ছিলেন মেয়েগুলো? সম্প্রতি পটনায় ‘মিডিয়াতে মি টু’ নিয়ে আলোচনায় এক ছাত্র প্রশ্ন করলেন, দেশে কি থানা-পুলিশ ছিল না? একটা এফআইআর করলেই হত। এত বছর পরে কী করে প্রমাণ হবে, কে দোষী?
উত্তর দিচ্ছিলেন স্বাতী গৌতম। প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, এক কালের ডাকসাইটে সম্পাদক এম জে আকবরের বিরুদ্ধে যাঁরা মামলা করেছেন, স্বাতী তাঁদের অন্যতম। তিনি বলছিলেন, সহকর্মীদের কাছেই তাচ্ছিল্য পেয়েছেন যে মেয়ে, তিনি পুলিশের কাছে যাবেন কোন সাহসে? বলছিলেন, কেন শিক্ষিত, স্মার্ট মেয়েরাও যৌন নির্যাতনের তৎক্ষণাৎ প্রতিবাদ করতে পারেন না। যখন এক সিনিয়র সহকর্মী হঠাৎ চেপে ধরে, বেমক্কা কুপ্রস্তাব দেন, মনে যেন পক্ষাঘাত হয়। ত্রাসে-অপমানে কুঁকড়ে যায় মন। প্রতিবাদের প্রত্যয় গড়ে উঠতে বহু সময় লাগে।
সর্বোপরি এক তরুণীকে তাড়িয়ে বেড়ায় এই ভয় যে, কেউ তাঁকে বিশ্বাস করবেন না। ‘মি টু’ আন্দোলন সেই ভয় ভাঙল। অনেক মেয়ে মুখ খুলতেই বেরিয়ে পড়ল, অধস্তন মেয়েদের হয়রানির নকশা তৈরি করে রেখেছেন প্রভাবশালী পুরুষরা। একের পর এক মেয়েকে ফেলেছেন সেই নকশায়। রাজি না হলেই মেয়েটির কাজের ত্রুটি ধরা, বরখাস্তের হুমকি, সুযোগ থেকে বঞ্চনা। নানা বয়ান যখন মিলে যেতে লাগল, তখন অভিযুক্তদের আর আড়াল করা গেল না। যে দেশে ধর্ষিতাকে পুলিশ বলে কেস না করে আপসে মিটিয়ে নিতে, সে দেশে স্রেফ মেয়েদের মুখের কথায় সরতে হল মিডিয়ার কিছু রাঘব বোয়ালকে। এমন যে হতে পারে, কে ভেবেছিল? যত খালবিলে যত পদ্ম, দু’হাত ভরে তুলে এনে দিলেও ‘মি টু’ মেয়েদের যথেষ্ট সম্মান করা হয় না।
কোথায় ফুল? খচখচ করছে প্রশ্নের কাঁটা।
কই, সব মেয়ের সঙ্গে তো আর ওই সব হচ্ছে না?
সব ছেলে কি খারাপ? পাজিগুলোকে এড়িয়ে চললেই হয়।
না, হয় না। ‘মি টু’ যদিও কিছু ব্যক্তির উপরে আলো ফেলেছে বেশি, কিন্তু তা আসলে খোলসা করেছে কর্মক্ষেত্রের চেহারাকে। এ দেশের অফিস-কাছারি, স্টাফ রুম, স্টেডিয়াম, স্টুডিয়ো, কিছু পুরুষকে অপরিমিত ক্ষমতা দেয় মেয়েদের হয়রান করার। আর বিচার পাওয়ার আশা সম্পর্কে ধন্দে রাখে মেয়েদের। কথাটা স্পষ্ট করল একটি সমীক্ষা। মহিলা ও শিশু উন্নয়ন মন্ত্রকের অনুদানে ২০১৫ সালে চারটি বড় শহরের চল্লিশটি সংবাদপত্রের দফতরে যান গবেষক শ্রীরূপা সেনগুপ্ত, কথা বলেন দু’শো সাংবাদিকের সঙ্গে। তাঁর রিপোর্ট থেকে মালুম হয়, কর্মক্ষেত্রে মেয়েদের হয়রানি কেন অনায়াসে চলতে পারে। এমনকি মিডিয়ার দফতরে, যেখানে হয়তো অভিযুক্ত পুরুষটি যৌন হয়রানির বিচার চেয়ে রিপোর্ট লেখেন, শিরোনাম লেখেন।
‘কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি টের পাচ্ছেন কি?’ যে শহরের সবচেয়ে বেশি মেয়ে বলেছে ‘হ্যাঁ’, তার নাম কলকাতা (৪৫ শতাংশ)। দ্বিতীয় দিল্লি (৩৫ শতাংশ)। ‘আপনার যৌন হয়রানির অভিজ্ঞতা হয়েছে কি?’ এর উত্তরে দিল্লির ৪৩ শতাংশ মেয়ে ‘হ্যাঁ’ বলেছেন। মুম্বইয়ে ২৬, হায়দরাবাদে ২৩, কলকাতায় ১৪ শতাংশ মেয়ে বলেছেন, যৌন হয়রানি তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা।
এই একটা তথ্যই এ দেশের হাড়ে কাঁপুনি ধরাতে যথেষ্ট। প্রিয়া বা ঘজ়লা পনেরো বছর আগে যা সয়েছেন, আজও মেয়েদের তা-ই সইতে হচ্ছে। কারণ, সে দিনের মতো আজও এই অন্যায় স্রেফ ‘নেই’ হয়ে আছে। দিল্লি, মুম্বইয়ে একশো শতাংশ পুরুষ বলেছেন যে, কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি হচ্ছে বলে তাঁরা মনে করেন না। কলকাতা আর হায়দরাবাদে নব্বই শতাংশেরও বেশি। খবর রাখাই যাঁদের পেশা, তাঁরা কি নিজের দফতরে যৌন হয়রানির খবর রাখেন না? ঠিক তা নয়। গবেষক শ্রীরূপাকে অনেক পুরুষ বলেছেন, এটা কাগজের অফিস, এখানে সতীপনা চলে না।
মেয়েরা মুখ খোলেন না কেন? কারণ আজও তাঁরা নিশ্চিত নন, বিচার মিলবে কি না। যৌন হয়রানি প্রতিরোধ আইন (২০১৩) প্রণয়নের দু’বছর পরেও কলকাতায় তিন জনের এক জন মহিলা সাংবাদিক জানতেন না, যৌন হয়রানির বিচার করার কমিটি রয়েছে কি না তাঁর দফতরে। আরও বেশি পুরুষ বলেছেন ‘‘জানি না।’’ কেন? কারণ দফতর কখনও জানায়নি। কলকাতায় সর্বাধিক (৬৯ শতাংশ) মহিলা বলেছেন, এ নিয়ে দফতর কখনও আলোচনাসভা ডাকেনি। আইন যদিও বলে, অভিযোগ বিচারের জন্য কমিটি তৈরি আর ওয়ার্কশপ করে সে বিষয়ে সকলকে জানানো, দুটোই করা চাই।
কাজে এত ফাঁক। অথচ যখনই ‘মি টু’ নিয়ে কথা ওঠে সাংবাদিকদের মধ্যে, তাঁরা কোনও এক ঘটনার ‘ভিতরের কথা’ ফেঁদে বসেন। সিদ্ধান্ত হয়, ওই মেয়েটাও ধোয়া তুলসীপাতা নয়। বেশ, না-ই হল। তাতে হলটা কী? যৌন হয়রানি যে অপরাধ, তার প্রতিকার করা চাই, সে কথাটাও কি বাতিল হবে? কাজের বেলা তা-ই হচ্ছে। মধ্যপ্রদেশে আকাশবাণীর নয় ঘোষিকা অস্থায়ী চাকরি খুইয়েছেন কর্তাব্যক্তির অসভ্যতার প্রতিবাদ করে।
এই মেয়েরা হয়তো আর রেডিয়োতে খবর পড়বেন না, কিন্তু বড় জরুরি খবর তাঁরা দিয়ে গেলেন। অসম্মানের শর্তে কাজ করতে হয় এ দেশের মেয়েদের। অবিশ্বাস আর উপহাস দিয়ে সহকর্মীরা নিয়ন্ত্রণ করে চলেছেন তাঁদের, আজও। পুরুষতন্ত্রের যা চিরকেলে ফন্দিফিকির। কিন্তু সত্যি জবান যেন ইস্পাতের ফলা। যেই মেয়েরা কথা বলেছেন, অমনি সব নিন্দেমন্দ, দোষারোপ-দুর্নাম ছিঁড়েখুঁড়ে কোথায় কী। আদালতে মামলা চলছে, তদন্ত চলছে দফতরে দফতরে, তা চলুক। কিন্তু সবাই যে সমান, এ সত্যটা অন্তত এক বার মেঘমুক্ত সূর্যের মতো ঝকঝক করে উঠেছে। কাগজ, চ্যানেলও তাকে অবজ্ঞা করতে পারেনি। যা নাকি ‘হয় না’, তা নিয়ে খবর করেছে।
‘মি টু’ মেয়েগুলোর জন্য আর একটু ‘প্রজাতন্ত্র’ হয়ে উঠল এ দেশ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy