Advertisement
E-Paper

জেল থেকে সংশোধনাগার, থমকে থাকা ইতিহাসের অধ্যায়

গোটা দেশের মতো উত্তরেও অতীতের সাক্ষ্য বহন করছে কারাগার। প্রতিটি কারাগারই স্মরণ করিয়ে দেয় গুরুত্বপূর্ণ অনেক কিছুই। লিখছেন সৌরেন বন্দ্যোপাধ্যায়রাজগিরে দেখা যায়, একটি স্থান খুব সুন্দর ভাবে ঘিরে রাখা আছে। লেখা রয়েছে— ‘কংসের কারাগার’।

শেষ আপডেট: ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০০:৩৮

বালুরঘাটের আরণ্যক থেকে পিকনিক করে ফেরার পথে রানা হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে সাগরকে বলল, ‘‘দেখেছিস, প্রাচীরটা কত উঁচু! ওটা পুরনো জেলখানার প্রাচীর। এক সময় কত বন্দি এখানে থাকত।’’ সাগর বলল, ‘‘আরে, এখানেই তো নির্মলদা মাঝে মাঝে বন্দিদের পড়াতে আসে। কত অনুষ্ঠান করিয়েছে কয়েদিদের দিয়ে। জানি না বাবা, তাতে আদৌ কোনও লাভ হয় কি না! দাগি অপরাধী কি নাচ-গান-কবিতায় সংশোধিত হয়? বাইরে বার হলে আবারও অপরাধ করবে! যাই বলো, রানাদা, বালুরঘাটের সঙ্গে কারাগারের কিন্তু একটা নিকট সম্পর্ক আছে!’’ রানা অবাক হয়ে বলল, ‘‘‘কেন রে?’’ সাগর বলল, ‘‘মন্মথ রায় সেই কবে ‘কারাগার’ নাটক লিখে বিখ্যাত হয়েছিলেন আর তার পর দশকের পর দশক বালুরঘাট থেকেই কারামন্ত্রী হয়েছেন বিশ্বনাথ চৌধুরী, শংকর চক্রবর্তী।’’ রানা না হেসে বলল, ‘‘কথাগুলো ভুল বলিসনি। তবে সময়ের সঙ্গে অপরাধ এবং বন্দির ধরন অনেকটাই বদলে গিয়েছে। পরাধীন ভারত আর স্বাধীন ভারতের কারাগার সম্পূর্ণ আলাদা।’’

রাজগিরে দেখা যায়, একটি স্থান খুব সুন্দর ভাবে ঘিরে রাখা আছে। লেখা রয়েছে— ‘কংসের কারাগার’। এই কারাগারের আদৌ কোনও বাস্তব ভিত্তি আছে কি না, জানা নেই। তবে, পৌরাণিক কাহিনি অবলম্বন করে মন্মথ রায় বিশ শতকের প্রথমার্ধের বিপ্লবী তথা স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ছবিই তাঁর ‘কারাগার’ নাটকে তুলে ধরেছিলেন। পুরাণের মোড়কে সমকালকে ধরতে চাওয়ার মধ্যে মুন্সিয়ানা যে আছে, তা অনস্বীকার্য। কংসরূপী ইংরেজ সরকারের অন্ধ কারাগারে জন্ম নিয়ে চলেছে শক্তিশালী প্রতিবাদী বিপ্লবী যুব সমাজ তথা শ্রীকৃষ্ণ। নাট্যকার যেন প্রমাণ করতে চাইলেন ‘তোমারে বধিবে যে, গোকুলে বাড়িছে সে’। মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধী, সুভাষচন্দ্র বসু বা রাসবিহারী বসু? যিনিই হোন না কেন, কারাগার যে আর বেশি দিন বন্দি করে রাখতে পারবে না দেশমাতার সন্তানদের, তারই বার্তা যেন এই নাটক।

আন্দামানের সেলুলার জেল বিশ্বখ্যাত। সেকালের বিপ্লবীদের কালাপানি পার করে দ্বীপান্তরে পাঠানো হত সংশোধনের জন্য নয়, অপরাধের শাস্তির জন্য। দেশের বীর সন্তানেরা দীর্ঘদিন বন্দি থেকে অত্যাচারিত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। জেল থেকে পালাতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন। আজও ‘লাইট অ্যান্ড সাউন্ড’ ব্যবস্থায় দেখানো হয় বীর সাভারকরের কক্ষ, উল্লাসকর দত্তের কক্ষ, আরও অসংখ্য বিপ্লবীদের কক্ষ। ভারতের এমন বহু কারাগার রয়েছে, যেখানে বীর স্বাধীনতা সংগ্রামী, বিপ্লবীদের বন্দি করে রাখা হয়েছিল। করা হয়েছিল অকথ্য অত্যাচার।

কাজী নজরুল ইসলামের মতো অনেক কবি-সাহিত্যিকই জেলে বসে সাহিত্য রচনা করেছিলেন। গান লেখা ও গজলের সুর দেওয়ার কাজের অনেকটাই নজরুল জেলে বসে করেছিলেন। সতীনাথ ভাদুড়ী তাঁর জেলবন্দী জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগালেন ‘জাগরী’ উপন্যাসে। যেখানে অন্দোলন করতে গিয়ে গাঁধীবাদী বাবা ‘আপার ডিভিশনে’ এবং মা ‘আওরতকিতায়’ বন্দি হয়েছেন। নাশকতা ও ধ্বংসাত্মক কাজে ফাঁসির সাজা প্রাপ্ত সোস্যালিস্ট বিলু ফাঁসির সেলে বন্দি, কমিউনিস্ট নীলু জেল গেটে অপেক্ষা করছেন ফাঁসির পর দাদা বিলুর মৃতদেহ নিয়ে যাওয়ার জন্য। আর সমস্ত রাত জেগে প্রতিটি চরিত্রই বিশ্লেষণ করছে অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যতকে চেতনাপ্রবাহ রীতিতে। সকালে জানা যায়, বিলুর ফাঁসির হুকুম রদ হয়েছে।

কারা-উপন্যাসের পটভূমি এবং বর্ণনায় সতীনাথ দারুণ সফল। পরাধীন ভারতের কারাগারের চিত্র এত নিখুঁত আর পাওয়া যায় না। ‘ঢোঁড়াই চরিত মানস’ উপন্যাসে ঢোঁড়াইয়ের জীবনে জেলখানার স্মৃতি এবং রাজনীতির অন্তঃসার শূন্যতায় বিপর্যস্ত হয়ে রামায়ণজি বনে যাওয়ার মধ্য দিয়ে সেই কারাগারের স্মৃতিকেই বহন করেছেন।

স্বাধীন ভারতে কারাগারের চিত্র সমরেশ বসুর ‘মহাকালের রথের ঘোড়া’য় আরও উজ্জ্বল হয়েছে। নকশাল আন্দোলন, অতি বাম আদর্শ-বিশ্বাস, পুলিশি অত্যাচার, কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত হয়ে রুহিতন কুর্মীর বাড়ি ফিরে আসা এবং জীবন না মৃত্যু এমনই পথের অন্বেষণে উপন্যাসের পরিসমাপ্তি। কারাগার জীবনের অসাধারণ চিত্র এখানে চোখে পড়ে। কারাগারের কক্ষ, অত্যাচারী পুলিশ, মানবিক ডাক্তার, বেড়ি পরা বন্দি, চোখে কাপড় বেঁধে নিয়ে যাওয়া, থার্ড ডিগ্রির মতো কম্বল ধোলাই— সব কিছুরই চিহ্ন রয়েছে। পুলিশি তদন্ত এবং বন্দিদের উপর অত্যাচার করে হত্যার ছক কষার নানা কথা উপন্যাসে ছড়িয়ে রয়েছে। রাজনৈতিক বন্দি এবং সাধারণ বন্দির মধ্যে অবশ্যই পার্থক্য আছে। তারাশঙ্করের ‘গণদেবতা’য় সেই ডেটিনির কথাও মনে পড়তে পারে। তারাশঙ্করের ‘পাষাণপুরী’, জরাসন্দের ‘লৌহকপাট’, ‘তামসী’, ‘ন্যায়দণ্ড’, সরোজকুমার রায়চৌধুরীর ‘শৃঙ্খল’ উল্লেখযোগ্য কারা-উপন্যাসগুলিকে আমরা স্মরণ করতে পারি।

তবে, মাঝেমধ্যেই সংবাদপত্রে জানা যায়, কারাগারও অপরাধীদের কাছে কতটা বিলাসবহুল হয়ে উঠছে। নানা বিলাস সামগ্রী, সেলফোন, টিভি থেকে শুরু করে মদ, গাঁজা, চরস, হেরোইন প্রভৃতি মাদক দ্রব্য সবই পাওয়া যাচ্ছে। দুই দল অপরাধীর মধ্যে সংঘাত কিংবা জেলে বসে অপরাধীদের সংগঠন চালানোর কথাও জানা যায়। কারারক্ষীদের চোখে ধূলো দিয়ে (নাকি টাকা দিয়ে) পালানোর ঘটনা বহুদিনই থেকেই ঘটে চলেছে।

পরাধীন ভারতের জেলে এক সময় বহু মহান মানুষ বন্দি ছিলেন। তাঁদের ঐতিহ্য আর আজকের দিনে রাজনীতির মুখোসের আড়ালে তোলাবাজদের জেলে বন্দি হওয়ার মধ্যে অনেক ফারাক। কারাগার জেলখানা, গারদ, ফাটক থেকে সংশোধনাগার— সমস্ত শব্দই এখনও একই ভাবে এই সব স্তরের বিবিধতাকেই প্রমাণ করছে।

(লেখক গৌড়বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার শিক্ষক। মতামত ব্যক্তিগত)

Jail Correctional Home
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy