Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ২

মানবিক

শুধুমাত্র দেখিয়াছিলেন কয়েকটি অসুস্থ কচি মুখ আর তাহাদের পরিবারের অসহায়তা। দেখিবার এই চোখ আর বুঝিবার এই মনই তো মানুষের পরম সম্পদ, আধুনিক সমাজ যাহা হারাইতে বসিয়াছে।

শেষ আপডেট: ১৯ এপ্রিল ২০১৮ ০০:৫৯
Share: Save:

বিপদে পড়িলে মানুষ চেনা যায়। কথাটি বহু ব্যবহারে জীর্ণ হইয়াছে ঠিকই, কিন্তু শব্দ কয়টির অভিঘাত বড় তীব্র, আবেদনও চিরকালীন। সম্প্রতি আরামবাগ মহকুমা হাসপাতাল চত্বরের ঘটনাটি আরও এক বার তাহা প্রমাণ করিয়া দিল। সেখানে বারোটি শিশুকে রক্ত দিয়া নজির গড়িলেন অ্যাম্বুল্যান্স চালকরা। রক্ত দিলেন এমন এক সঙ্কটকালে, যখন ব্লাড ব্যাঙ্কে রক্তের আকাল এবং রক্তের দাবিদাররা সকলে থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত। সুতরাং আকালের সম্ভাব্য পরিণাম সহজে অনুমেয়। এই বিপদের সময় প্রকৃত ‘মানুষ’ হইয়া উঠিলেন কয়েক জন অ্যাম্বুল্যান্স চালক। তাঁহারা ধর্ম দেখেন নাই, স্বার্থও দেখেন নাই। শুধুমাত্র দেখিয়াছিলেন কয়েকটি অসুস্থ কচি মুখ আর তাহাদের পরিবারের অসহায়তা। দেখিবার এই চোখ আর বুঝিবার এই মনই তো মানুষের পরম সম্পদ, আধুনিক সমাজ যাহা হারাইতে বসিয়াছে।

আশ্চর্য যে, সেই অমূল্য সম্পদের হদিশ মিলিল এমন এক শ্রেণির মানুষের কাছে, যাঁহাদের সমাজ ঠিক সোজা চোখে দেখে না। সততা এবং মনুষ্যত্বের অধিকারী বলিয়া এই রাজ্যের অ্যাম্বুল্যান্স চালকদের বিশেষ কোনও সুখ্যাতি নাই। পেশাগত কারণে তাঁহাদেরই প্রকৃত ত্রাতা হইয়া উঠিবার কথা ছিল। দুর্ভাগ্যবশত ঠিক তেমনটি হয় নাই। বরং অভিযোগ, রোগীর সঙ্কটকালেও অনেক সময়ই অ্যাম্বুল্যান্স চালকদের একাংশের অবাঞ্ছিত আচরণ সহ্য করিতে হয় রোগীর পরিবার-পরিজনকে। অতিরিক্ত ভাড়া আদায়, দুর্ব্যবহার, হাসপাতালের সঙ্গে বেআইনি যোগসাজস, প্রশিক্ষিত কর্মীর অভাবে রোগীর প্রাণসংশয়— অভিযোগের তালিকাটি দীর্ঘ এবং ভয়ঙ্কর। সুতরাং, অ্যাম্বুল্যান্স চালকদের সম্পর্কে সাধারণ মানুষের একটা নেতিবাচক ধারণা বহু দিন হইতে প্রচলিত। এমন আবহে তাঁহাদেরই কয়েক জনের রক্ত দানের ঘটনাটি সত্যই অনন্য। কারণ তাঁহারা কিছু শিশুর প্রাণ বাঁচাইবার পাশাপাশি তাঁহাদের সম্পর্কে প্রচলিত ধারণার মূলেও আঘাত করিয়াছেন। ভাবিতে বাধ্য করিয়াছেন, যাঁহাদের সমাজ কিছু বাঁকা চোখে দেখিয়া থাকে, তাঁহারা কি সত্যই সেই দুর্নামের অধিকারী? না কি দীর্ঘ বদ্ধমূল ধারণা মনুষ্যত্বের স্ফুলিঙ্গগুলিকেও আড়াল করিয়া রাখে? আরামবাগের ঘটনায় রাতারাতি হয়তো ধারণাটি বদলাইবে না, কিন্তু গোটা শ্রেণিকে বদনামের ভাগীদার করিবার সহজাত অভ্যাসটি লইয়া ভাবিতে বাধ্য করিবে।

আর বলিবে, মনুষ্যত্ব এখনও মরে নাই। তাহার প্রাণপাখিটি ধুকপুক করিলেও শ্বাস এখনও চলিতেছে। বস্তুত, বিপদগ্রস্ত মানুষ, বিশেষ করিয়া শিশুদের পাশে দাঁড়ানো এবং সাহায্যের হাত বাড়াইয়া দেওয়া— ইহা একমাত্র মানুষই করিতে পারে। সেই কারণেই তাহারা ‘মানুষ’, ইতর প্রাণীবিশেষ নহে। কিন্তু ইদানীং বারংবার মনুষ্যত্বের সেই চিরাচরিত ধারণায় আঘাত আসিতেছে। সাম্প্রতিক ঘটনাবলি দেখিয়া মনে হইতেছে, পৃথিবীতে এক সঙ্গে সকল মানুষ বুঝি বা গত হইয়াছে। বদলে কিছু চরম স্বার্থপর বিকারগ্রস্তের আগমন ঘটিয়াছে, যাহারা শিশুদের আগলাইবার পরিবর্তে তাহাদের ভোগ্যবস্তু মনে করে। বড় মর্মান্তিক এই অনুভূতি। সৌভাগ্য, ইহার মধ্যেও আরামবাগের ন্যায় কিছু ঘটনার কথা শুনা যায়, যাহারা এখনও মনুষ্যত্বের অসীম সম্ভাবনার কথা বলে। ঘোর দুর্দিনেও আশার প্রদীপটিকে জ্বালাইয়া রাখে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Blood Girl Humanity
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE