Advertisement
E-Paper

সর্বজনীন বিকার

একটিই বাঁচোয়া। তেমন ভারতীয় আর বিশেষ অবশিষ্ট নাই। তিন বৎসরের বিজেপি শাসন এই পরিবর্তনটি আনিয়া দিয়াছে। জাতীয়তার নামে অসভ্যতা এখন আর হাতে-গোনা কতিপয় লোকের কাজ নয়।

শেষ আপডেট: ২০ জুন ২০১৭ ০০:০৩

ভারত-পাকিস্তান ক্রিকেট ম্যাচকে কেন্দ্র করিয়া যে তথাকথিত আবেগ দেখা যায়, তাহার মধ্যে নিখাদ ক্রীড়াপ্রীতি তথা বিনোদনপ্রীতি থাকিতে পারে না। থাকা সম্ভব নহে। বিষয়টির মধ্যে অন্য কিছু আছে, যাহা এখনও সমাজমনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের সম্পূর্ণ আওতায় আসে নাই। অনুমান চলিতে পারে: এই ‘অন্য কিছু’টি এক রকম সামাজিক বিকার। নিজেদের বহুমাত্রিক হীনতা ও ন্যূনতা ভুলিয়া, নানাবিধ রাজনৈতিক ও সামরিক সংকট হইতে সাময়িক ভাবে পলাইয়া, একটি খেলার সূত্রে যথাসম্ভব মস্তানি করিয়া লইবার তাড়না। কে জানে, ফাঁক দিয়া যদি সুযোগ গলিয়া যায়, তাহা হইলে আবার এতখানি পেশি-প্রদর্শন দেখানো যাইবে কবে ও কখন। তাই ক্রিকেটের অজুহাতে দেশময় এহেন পৌরুষদৃপ্ত পাগলামির প্রবাহ। সেই অর্থে ভারত-পাকিস্তান ক্রিকেট ম্যাচটিকে নকল যুদ্ধ বলা যায় না, বরং সেই ম্যাচ লইয়া সামাজিক পরিসরে যে বিকারপ্রবাহ, তাহাই যুদ্ধের মহড়ার সহিত তুলনীয়। মাঠে কিন্তু খেলোয়াড়রা যথেষ্ট ভদ্র, পরস্পরের প্রতি প্রীতি-সৌহার্দ্যে পূর্ণ। মাঠের বাহিরেই এই জঙ্গি মানসিকতার বিস্ফোরণ। পাকিস্তানকে ‘পিটাইয়া’ ‘বাবার বাবা’ দেখাইয়া দিবার হুমকিতে দশ দিক বিদারণ। সদ্য-ঘটিত ভারত-পাকিস্তান ম্যাচের আগে মিডিয়া এবং সোশ্যাল মিডিয়া দেখিয়া যে কোনও আত্মমর্যাদাবান ভারতীয়ের মাথা তাই আভূমি হেঁট হইতে বাধ্য।

একটিই বাঁচোয়া। তেমন ভারতীয় আর বিশেষ অবশিষ্ট নাই। তিন বৎসরের বিজেপি শাসন এই পরিবর্তনটি আনিয়া দিয়াছে। জাতীয়তার নামে অসভ্যতা এখন আর হাতে-গোনা কতিপয় লোকের কাজ নয়। ইহাই সর্বজনীন, সর্বব্যাপী, সর্বমান্য। মান্যতার বিষয়টি বিশেষ গুরুতর। মূলস্রোতের সংবাদমাধ্যমের বিবিধ অংশ এখন যে ভাবে কাশ্মীরের বদলা ওভালে লইবার আহ্বান জানায়, সমাজ তাহা যে ভাবে আত্মস্থ করে, কিছু দিন আগেও এতখানি ভাবা যাইত না। মুসলিমবিদ্বেষ ও পাকিস্তানকে ধনেপ্রাণে মারিবার বাসনা— মোদী-শাসনের কল্যাণে এই ‘জাতীয়’ কার্যক্রম আসমুদ্রপর্বত সমাজের, বিশেষত যুবসমাজের, প্রাত্যহিক চেতনার অংশ। এগারো জন ক্রিকেটারকে এগারো জন জঙ্গির মতো ধ্বংস করা উচিত— এই সমরাহ্বান এখন আর ব্যতিক্রমী অপরাজনীতি নহে। ইহাই ভারতীয় সংস্কৃতি। এবং এই সংস্কৃতি দেখিয়া লজ্জায় ঘৃণায় শিহরিয়া উঠিবার মতো নাগরিক ক্রমে বিলুপ্ত প্রজাতির তালিকায়।

সোশ্যাল মিডিয়া এই নূতন দেশগঠনের বিরাট সহায়। অশালীনতার সংস্কৃতি এখানেই তাহার উর্বরতম ভূমিটি পাইয়াছে। ব্যক্তিগত, সামাজিক, রাজনৈতিক, সব বিষয়ে এখানে আক্রমণ ও হিংসাভাবের অবিশ্রান্ত প্রবাহ। এই আশ্চর্য গণতান্ত্রিক অপসংস্কৃতি যে কোনও বিষয়কেই দ্রুত হীনতার নিম্নতম স্তরে নামাইতে পারে। হিংসাবাক্য-উচ্চারণকারী ব্যক্তিগণ পরস্পর-সংযুক্ত হইয়া ছোট হইতে বড়, বড় হইতে বৃহত্তর গোষ্ঠী রচনা করিতে পারে। সুতরাং পাক ক্রিকেটাররা যে ভারতের নিধনযোগ্য শত্রু, এবং ভারতীয় মুসলিমরা যে পাকিস্তানের চর হিসাবে ক্রিকেট হইতে সীমান্তযুদ্ধ সর্বত্রই ভারতের অকল্যাণকামী, বারংবার বলিবার ফলে কথাটি বিশ্বাসযোগ্য ‘সত্যে’ পর্যবসিত হইতেছে। সত্য-উত্তর দুনিয়ায় নূতন গোত্রের সত্য।

Incessant flow Social media Indo-Pak
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy