Advertisement
E-Paper

ক্রোশজুড়ি, এক ক্রোশ জুড়ে ছড়ানো প্রত্নক্ষেত্র

পুরুলিয়ার ইন্দ্রবিল রেলস্টেশন থেকে আট কিলোমিটার দক্ষিণে এবং হুড়া-সোনাথলি রাস্তায় হুড়া থেকে ১৪ কিলোমিটার উত্তরে এই সভ্যতার বিস্তার। মানব সভ্যতার একটি বিশেষ যুগের প্রতিনিধিত্ব করেছিল এই ক্রোশজুড়ি। লিখছেন দিলীপকুমার গোস্বামীএক সময় এক ক্রোশ জুড়ে এই পুরাক্ষেত্রটি বিস্তৃত ছিল, সেই কারণে নাম ক্রোশজুড়ি।

শেষ আপডেট: ৩১ মার্চ ২০১৯ ০১:৩৭
ক্রোশজুড়ি মন্দির। ছবি: লেখক

ক্রোশজুড়ি মন্দির। ছবি: লেখক

সভ্যতার সৃষ্টি এবং তার বিলয়, পরস্পর গভীর ভাবে সম্পৃক্ত। দ্বারকেশ্বর নদের উৎস (পাঞ্জনীয় মৌজা, যুগতেতুল মোড়) থেকে ৩০ কিলোমিটার নিম্ন অববাহিকায় তৈরি হয়েছিল ‘ক্রোশজুড়ি’ প্রত্ন-ক্ষেত্র। কালের নিয়মে তা ধ্বংস হয়েছিল। বিশাল এই পুরাক্ষেত্রের সৃজন, বিলয় ও পুনর্নিমাণ আলোচনার দাবি রাখে।

এক সময় এক ক্রোশ জুড়ে এই পুরাক্ষেত্রটি বিস্তৃত ছিল, সেই কারণে নাম ক্রোশজুড়ি। অবস্থান পুরুলিয়ার কাশীপুর থেকে ১৫ কিমি পূর্বে, ইন্দ্রবিল রেলস্টেশন থেকে আট কিলোমিটার দক্ষিণে এবং হুড়া-সোনাথলি রাস্তায় হুড়া থেকে ১৪ কিলোমিটার উত্তরে। দ্বারকেশ্বর নদের দক্ষিণে ক্রোশজুড়ির অবস্থান। দ্বারকেশ্বর নদ তীরবর্তী সুতাবই গ্রামের ‘গাড়া’ নামক প্রত্ন-ক্ষেত্র, তালাজুড়ি গ্রামের বরুণেশ্বর ধাম (তিন কিলোমিটার উত্তরে) পুরাক্ষেত্র এবং দ্বারকেশ্বরের নিম্ন অববাহিকার ‘বহুলাড়া’ ‘সিদ্ধেশ্বর শিবক্ষেত্র’কে এক বৃত্তে রাখলে বোঝা যাবে ক্রোশজুড়ি সভ্যতা প্রকৃতপক্ষে মানব সভ্যতার একটি বিশেষ যুগের প্রতিনিধিত্ব করেছিল।

দামোদর তীর সংলগ্ন মন্দির-নগরী ‘তৈলকম্প’ এবং হাড়াই নদী তীরবর্তী ‘দেউলভিড়্যা-হোড়োকতোড়’ শৈবক্ষেত্রকে যুক্ত করলে এই সভ্যতার এলাকা হয় প্রায় ২,৫০০ বর্গ কিলোমিটার। এই এলাকার বহু ছোট-বড় সাধনপীঠ (এক্তেশ্বর/সিয়াদা/কেতনকিয়ারি) ওই মহত্তর সৃজনের অংশ ছিল।

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

মন্দির বিশেষজ্ঞেরা ক্রোশজুড়ির নির্মাণকার্য সম্পর্কে একমত নন। কেউ বলেন, পঞ্চম শতাব্দী, কারও মতে অষ্টম শতাব্দী, কেউ আবার বলেন দ্বাদশ শতকের প্রত্ন-ক্ষেত্র এটি। আমরা মনে করি, ক্রোশজুড়ির সৃজন অষ্টম শতাব্দীর।

এক সময় এই বিশাল স্থাপত্যসৃষ্টি ধ্বংস হল। মানুষের স্মৃতি থেকে মুছে গেল ক্রোশজুড়ির হিরণ্ময় সভ্যতা। এ পর্যন্ত এই ধ্বংসের কারণ সম্বন্ধে কোনও সূত্র, কোনও তথ্য আবিষ্কৃত হয়নি। গবেষক-বিশেষজ্ঞেরাও এ সম্বন্ধে বিশেষ আলোকপাত করতে পারেননি।

মানুষের চেতনা সর্বদা ক্রমোন্নতির দিকে এগিয়ে চলে। এই প্রক্রিয়ায় এক সময় মানুষ বিলীয়মান এই সভ্যতা সম্পর্কে সচেতন হয়ে একে আবিষ্কার এবং এর পুনর্নির্মাণে ব্রতী হয়। গত ষাটের দশকে এই প্রত্নক্ষেত্রের পুনরাবিষ্কার/পুনর্নিমাণ শুরু হয়। নিমাইলাল সেনাপতি নামক জনৈক প্রাথমিক শিক্ষক প্রত্ন-ক্ষেত্রটির পুনর্নিমাণ ও সার্বিক উন্নয়নে নেতৃত্ব দিয়েছেন। প্রত্নস্থলটিতে এখনও পর্যন্ত পাঁচটি মন্দিরের ধ্বংসস্তূপ আবিষ্কৃত হয়েছে। সিদ্ধেশ্বর মহাদেব মন্দির, দেউলটাঁড়ে বিষ্ণু/ অবলোকিতেশ্বর মন্দির, কাজলকুড়া পুষ্করিণী পাড়ের শিবমন্দির, শিবটাঁড়ের প্রস্তর নির্মিত এবং ইটের মন্দির।

সিদ্ধেশ্বর মহাদেব মন্দিরটি জঙ্গলে ঢাকা ছিল। স্থানীয় দেশপ্রেমিক নাগরিকবৃন্দের সহযোগিতায় মন্দিরটির পুননির্মাণ (১৯৭৬-৭৭) হয়েছে। এই সময়কালেই প্রত্নস্থলটি রাজ্যস্তরের মন্দির বিশেষজ্ঞদের নজরে আসে। ১৯৭১ সালে ‘স্টেট প্রোটেকটেড মনুমেন্ট’ হিসেবে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের স্বীকৃতি মেলে।

মন্দিরগুলি ছ’ফুট উঁচু ভিত্তিভূমির উপরে স্থাপিত। প্রধান মন্দির সিদ্ধেশ্বর শিবমন্দির পূর্বমুখী। এর উত্তরে একটি ক্ষুদ্র কক্ষে বিষ্ণুর (অবলোকিতেশ্বর) মূর্তি রয়েছে। পূর্ব দিকে ২৫ ফুট দূরে নবপ্রতিষ্ঠিত কালীমেলায় রক্ষিত রয়েছে ব্যতিক্রমী চতুর্ভুজা বামাকালী ও নটরাজ কালভৈরবের মূর্তি। মন্দিরক্ষেত্রের নবনির্মিত সব মন্দিরগুলি দালানরীতির। সিদ্ধেশ্বর মহাদেব মন্দিরটিও দালানশ্রেণির। এর মধ্যস্থলে ডিম্বাকৃতি গম্বুজের চূড়া নির্মিত হয়েছে। চূড়াটি এই মন্দিরের ঐতিহ্যের সঙ্গে মানানসই নয়।

মন্দিরের মূল আকর্ষণ শিব রয়েছেন মন্দির অভ্যন্তরে। কালো কষ্টিপাথরে নির্মিত সুন্দর মসৃণ ১০টি গৌরিপট্ট-সহ বিশালাকার শিবলিঙ্গ। সর্বমোট ১০টি গৌরিপট্ট ক্রমানুসারে সজ্জিত। জেলায় এত বড় শিবলিঙ্গ আর একটি মাত্র রয়েছে। বুঝপুরে। গবেষক সুভাষচন্দ্র মোদকের মতে, বিশালতার নিরিখে বর্ধমানের আলমগঞ্জে ১৯৭২ সালে আবিষ্কৃত শিবলিঙ্গটির পরেই ক্রোশজুড়ির শিবলিঙ্গের স্থান।

পূর্বে সিদ্ধেশ্বর মন্দিরটি ছিল শিখর দেউল। প্রস্তর নির্মিত। পূর্বমুখী। সম্মুখে ছিল পিড়া-রীতির জগমোহন। মন্দির বিশেষজ্ঞদের মতে, শিখর দেউল (‌‌‌‌রে‌খদেউল) ও পিড়া দেউলের সম্পর্ক অতি ঘনিষ্ঠ। অষ্টম শতাব্দী থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দী পর্যন্ত পুরুলিয়ায় অজস্র প্রস্তর নির্মিত শিখর দেউল গড়ে উঠেছিল (পাড়া, ছড়রা, দেউলি, পাকবিড়রা, তেলকূপি, বুধপুর)।

পূর্বতন মন্দিরটির চার ফুট চার ইঞ্চির প্রস্তর-প্রাচীর অক্ষত ছিল। দুধ-সাদা পাথরগুলি লোহার ‘ক্ল্যাম্প’ দিয়ে আটকানো রয়েছে বর্তমানে। মন্দিরের বাইরের মাপ ১৬ বর্গফুট। বর্গাকৃতি গর্ভগৃহ। মন্দিরের উচ্চতা ছিল ৪৮ ফুট। তার উপরে আমলক (‌গোলাকার পাথর), সর্বোপরি পাঁচ ফুট উচ্চতার কলস প্রতিস্থাপিত ছিল। মন্দিরের উত্তর ও দক্ষিণদিকে রক্ষিত আছে দু’টি অনিন্দ্যসুন্দর দ্বারদেশের খণ্ড। দ্বারদেশের একটি খণ্ড রাজ্য প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সংগ্রহশালায় রক্ষিত আছে। গঙ্গা-যমুনা-সহ দ্বারপালের মূর্তির পাশে পদ্মপাপড়ি, পুঁতির সারি, ফুল, মনুষ্য-কৌতুকী উৎকীর্ণ। মন্দিরের দরজা পূর্বমুখী। ক্রোশজুড়ি সিদ্ধেশ্বর মন্দিরে সিংহের মূর্তি এবং ১০-১২টি বীরস্তম্ভের ভাস্কর্য গাঁথা রয়েছে।

বিস্ময়ের বিষয় ১৭৭২ সালে জে ডি বেগলার পুরুলিয়া মন্দিরগুলির সর্বত্র পরিভ্রমণ করে সেগুলি সম্পর্কে বিস্তৃত বিবরণ লিখে গিয়েছেন। কিন্তু তিনি ক্রোশজুড়ি ভ্রমণ করেননি। হয়তো সে সময় ক্রোশজুড়ি প্রত্নস্থল সম্পর্কে মানুষ অজ্ঞ ছিল।

লেখক পুরুলিয়ার লোকসংস্কৃতি ও ইতিহাস গবেষক

Heritage Archaeology Purulia
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy