প্রতীকী ছবি
সে দিন ট্রেনে যেতে যেতে দুই ভদ্রলোক ‘ভদ্র’ ভাষায় ডাক্তারদের তুলোধোনা করছিলেন। এক জনের বক্তব্য, তাঁর ছেলের জ্বর, ‘‘ডেঙ্গি ম্যালেরিয়া টেস্ট না করেই ডাক্তার ওষুধ লিখেছেন।’’ আর অন্য জনের বক্তব্য, তাঁর বৌয়ের মাথায় স্ট্রোক হয়েছে, সেটা ডাক্তার যদি বুঝতেই পারলেন তা হলে ‘‘এত সিটিস্ক্যান-এমআরআই কী দরকার। এত দামি দামি টেস্ট করতে হলে কিসের ডাক্তার, ভাবছি চেন্নাই নিয়ে যাই।’’
আমাকে তাঁদের কথা শুনতে দেখে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললেন ‘‘বুঝলেন তো, ডাক্তারদের জ্বালায় আর পারা যাচ্ছে না।’’ মুচকি হেসে বললাম, ‘‘সেই।’’
আমাদের রাজ্যে ‘ডাক্তার’দের প্রতি অ-ডাক্তারদের এই ক্ষোভ এখন সর্বব্যাপী। দেখে দেখে ভাবছিলাম, কয়েকটা কথা বলা দরকার। আজ চার দিকে ‘ভুল চিকিৎসা’ আর ‘চিকিৎসায় গাফিলতি’র অভিযোগ অনর্গল বয়ে চলেেছ। সকলের হয়তো মনে হচ্ছে যে ডাক্তাররা সহজেই অনেক কিছু পেয়ে গেলেন। সুতরাং পান থেকে চুন খসলেই দাও ডাক্তারকে ঠেঙিয়ে। সে দিন ট্রেনে ওঁরা যেমন বলছিলেন, ‘‘আমাদের পয়সাতেই ডাক্তারি পড়ে এত বাড়াবাড়ি? শুধু এসি গাড়ি বাড়ি হবে, আর কাজ করব না?’’
আচ্ছা, ডাক্তাররা যে কাজ করবেন, তার উপযুক্ত পরিকাঠামো আছে তো? হাসপাতাল চালাতে যে সহযোগী পরিষেবা লাগে, তা আছে তো? তর্কের খাতিরে যদি মানাও হয় যে অডাক্তারদের ট্যাক্সের টাকা ডাক্তারের ডিগ্রির পিছনে আছে, তা হলে অডাক্তাররা যে ট্রেনের ‘মান্থলি’ কেটে কম খরচে যাতায়াত করছেন, তার পিছনেও ডাক্তারদের ট্যাক্সের টাকা আছে! সুতরাং সে যুক্তি অবান্তর।
সরকার আজ জনসাধারণের হিতকামনায় বিনামূল্যে চিকিৎসা করছে। মুশকিল এই যে, তার ফলেই হয়তো মানুষের মনে হতে শুরু করেছে যে, বিনামূল্যের রিপোর্ট ইত্যাদির কোনও মূল্য নেই, ভাঁজ করে, তেলে ভিজিয়ে, বাজারের ফর্দ লিখে, দশ জনের ফোন নাম্বার লিখে তার সদ্ব্যবহার চলতে পারে। ওষুধও যখন ফ্রি, তখন রোগ থাক আর না থাক, ডাক্তারকে ওষুধ দিতেই হবে, ‘‘ওষুধ তো আপনার নয়, এ তো সরকারের।’’ যদি কোনও কারণে মনে হয় যে ডাক্তার প্রয়োজনের চেয়ে বেশি বা কম ওষুধ দিয়েছেন, তবে রোগীই পরামর্শ দেবেন, ভিটামিনটা লিখে দেননি কেন, কিংবা এত ওষুধ কেন খেতে হবে ইত্যাদি।
এক সরকারি হাসপাতালে প্রথম একশো জনকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, তাঁরা কেন এই বিভাগে দেখাতে এসেছেন। বাহাত্তর জন বলেন, তাঁদের পরিচিত বা আত্মীয় ওই হাসপাতালে ভর্তি আছেন, তাই তাঁরাও দেখাতে এসেছেন, এক ঢিলে দুই পাখি। অর্থাৎ প্রয়োজন থাক বা না থাক, তাঁরা ওষুধ নিতে হাসপাতালে আসছেন। এমন পরিস্থিতিকে আশাজনক বলা চলে না।
ডাক্তার যদি রোগ বা চিকিৎসা সম্পর্কে গুগল-এর তথ্যের বাইরে কিছু বলে ফেলেন, তা হলে তো বিরাট সমস্যা। “আপনি বললেন দশ শতাংশ, গুগল-এ তো লেখা আছে এগারো-বারো শতাংশ।’’ সঙ্গে ডাক্তারের দিকে অদ্ভুত চাউনি।
এমন পরিস্থিতিতে যদি রোগীর মৃত্যু হয়? “সকালে তিনটে ইঞ্জেকশন, দুপুরে দুটো, রাতে তিনটে, আর স্যালাইন, এ ছাড়া তো কিছু পেতই না।’’ যেন এগুলি কিছুই না! “কত বার বললাম এটা না দিয়ে ওটা দিতে, তা হলে তো এমন হত না!” সকলেই আজকাল সব জানেন। সকলের মনেই এক জন সুপ্ত-ডাক্তার লুকিয়ে আছে, ইন্টারনেট-এর জলহাওয়া পেয়ে তা বেড়ে ওঠে। এতে আজ কোনও সন্দেহ নেই যে সকলে প্লেন বা ট্রেন চালাতে না জানলেও, ডাক্তারিটা সবাই জানেন। চা-বিস্কুট সহযোগে আড্ডা দিতে বসে চিকিৎসাব্যবস্থা ও চিকিৎসককে তুলোধোনা করাটা তাই সর্বজনীন।
অথচ ডাক্তাররা কিন্তু চান না যে তাঁর রোগীর ‘ক্ষতি’ হোক। রোগী ও তাঁর পরিচিতদের প্রতি সমবেদনা রেখেই বলতে বাধ্য হচ্ছি যে কিছু দায় তাঁদেরও নিতে হবে। সব ডাক্তার সমান নন, সব রোগী বা তাঁর আত্মীয়-পরিজনও সমান নন। বিনামূল্যে চিকিৎসার অধিকার যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনই সেই চিকিৎসাব্যবস্থাকে ন্যূনতম সম্মান দেওয়াটাও জরুরি। ‘প্রাইমারি হেল্থ কেয়ার’-এর সংজ্ঞা অনুযায়ী ‘কমিউনিটি পার্টিসিপেশন’ এতে একটা বড় ভূমিকা পালন করে। পশ্চিমবঙ্গে ডাক্তার-ঠ্যাঙানির মধ্যে আর যা-ই থাক, সেই কমিউনিটি পার্টিসিপেশন নেই।
মনে রাখা ভাল, সব ডাক্তার এসি-বাড়ি-গাড়ি পান না, তাঁরা রাত জেগে রোগী দেখেন, লোকাল ট্রেনে যাতায়াত করেন।
কথাগুলো লিখলাম এটা জেনেই যে অধিকাংশ মানুষই এ লেখা পড়বেন না, পড়লেও একমত হবেন না। সামাজিক দায়বোধ একটা বড় অনুভূতি। কেবল চিকিৎসাব্যবস্থায় নয়, আমাদের রাজ্যে সর্ব ক্ষেত্রেই যে তার অভাব, সহজেই বোঝা যায়।
ইমেল-এ সম্পাদকীয় পৃষ্ঠার জন্য প্রবন্ধ পাঠানোর ঠিকানা: editpage@abp.in
অনুগ্রহ করে সঙ্গে ফোন নম্বর জানাবেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy