Advertisement
E-Paper

পরম্পরা? আদৌ কি তেমন কিছু বহন করছি আমরা

বাঙালিয়ানার গভীরে ঔদার্যের শিকড় রয়েছে, এমনটাই জানতাম আমরা। ছুটন্ত ট্রেনটার জানালায় চোখ পড়ার পরে সে কথা আর বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করছে না। বার বার মনে হচ্ছে, বাঙালি তার অমূল্য রতন খুইয়েছে।

অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৬ মে ২০১৮ ০০:৪৩
জামাল মোমিন ওরফে মনিরুল শেখ।

জামাল মোমিন ওরফে মনিরুল শেখ।

বেশ শ্লাঘা বোধ হল। শ্লাঘনীয় বিষয় তো বটেই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিক্ষাকে পরম্পরায় বহন করছে এ ভূমি— শোনা গেল এমনই শংসাবাক্য। শোনা গেল রবীন্দ্রনাথেরই বিশ্বভারতী থেকে। শোনা গেল বিশ্বভারতীর আচার্য তথা দেশের প্রধানমন্ত্রীর মুখ থেকে।

শ্লাঘার রেশে দিনভর উৎফুল্ল থাকার কথা ছিল। কিন্তু দৃষ্টি তো দিনভর এক দিকে নিবদ্ধ থাকে না। বহু দিশায় ধাবিত হয়। তাই আর উৎফুল্ল থাকা গেল না। দেখা গেল, এ বঙ্গেরই নগর-শহর-জনপদ-গ্রাম-গ্রামান্তর-ময়দান-প্রান্তর ভেদ করে ছুটে যাচ্ছে একটা ট্রেন। চোখ পড়ল সে ট্রেনের একটা জানালায়। সে জানালার ভিতরে অদ্ভুত পরিস্থিতির সম্মুখীন জামাল মোমিন ওরফে মনিরুল শেখ।

মালদহের কালিয়াচকের বাসিন্দা জামাল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর রাজ্যে কাজ করেন। ছুটিতে ফিরছিলেন কালিয়াচকের বাড়িতে। নিজের রাজ্যে এসে যে পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হল, তা সম্ভবত দুঃস্বপ্নেও ভাবেননি তিনি।

ট্রেন ছাড়ার বেশ কিছু আগে জানালার ধারে জায়গা রেখে নীচে নেমেছিলেন জামাল। পরে ট্রেনে উঠে দেখেছিলেন, জায়গা দখল হয়ে গিয়েছে। জায়গা ফেরত চেয়েছিলেন। তাতেই সাত-পাঁচ প্রশ্নের মুখে পড়তে হয় জামালকে। প্রধানমন্ত্রীর নাম কী? মুখ্যমন্ত্রীর নাম কী? জাতীয় সঙ্গীত কোনটি? আরও নানান প্রশ্ন। সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া এক ভিডিয়ো দেখাচ্ছে, প্রায় প্রত্যেক প্রশ্নেই হোঁচট খাচ্ছেন জামাল। আর হোঁচট খেলেই সপাটে চপেটাঘাত হচ্ছে তাঁর গালে। সঙ্গে অকথ্য গালিগালাজ, পাকিস্তানি হিসেবে দাগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা, ধর্মীয় পরিচয় তুলে ধরে কটাক্ষ।

দলবদ্ধ হেনস্থার মুখে নিতান্তই অসহায় দেখাচ্ছিল জামাল মোমিনকে। প্রতিরোধের কোনও উপায়ই ছিল না। আত্মসমর্পণের ঢঙে জামাল জানাচ্ছিলেন— লেখাপড়া বেশি দূর নয়, তাই সব প্রশ্নের জবাব দেওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়, অনেক প্রশ্ন তাঁর বোধগম্যেরও বাইরে। কিন্তু তাতেও নরম হচ্ছিল না উগ্র জাতীয়তাবাদ এবং তীব্র সাম্প্রদায়িকতায় রুক্ষ হয়ে থাকা হেনস্থাকারীদের মন। অপমান, গালিগালাজ, মারধর অবিরত চলছিল।

সম্পাদক অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আপনার ইনবক্সে পেতে চান? সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন

এ দৃশ্য দেখার পরেও বিশ্বাস করব যে, আমরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দেওয়া শিক্ষাকে পরম্পরায় বহন করছি? মনীষী রবীন্দ্রনাথের দেওয়া শিক্ষা বা তাঁর জীবনবোধের কথা ছেড়েই দিলাম। সাধারণ বাঙালিও উদারতায়, সহিষ্ণুতায়, আত্মীয়তায়, বিশ্বজনীনতার চর্চায় গৌরবোজ্জ্বল ছিল শতকের পর শতক ধরে। সে পরম্পরাও কি অবশিষ্ট রয়েছে বিন্দুমাত্র? প্রশ্ন উঠে যায়।

বাঙালিয়ানার গভীরে ঔদার্যের শিকড় রয়েছে, এমনটাই জানতাম আমরা। ছুটন্ত ট্রেনটার জানালায় চোখ পড়ার পরে সে কথা আর বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করছে না। বার বার মনে হচ্ছে, বাঙালি তার অমূল্য রতন খুইয়েছে।

আরও পড়ুন
প্রধানমন্ত্রী কে জানিস না! সপাটে চড়, গালি

জাতীয়তাবাদ কী, বাংলাই শিখিয়েছে পরাধীন ভারতকে। আবার একই সঙ্গে উগ্র জাতীয়তাবাদের বিপদ সম্পর্কে এ বাংলাই দেশকে সচেতন করেছে। সে সতর্কবার্তায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। অদ্ভুত সমাপতন অথবা আশ্চর্যজনক পরিহাস! বিশ্বভারতীতে এসে রবীন্দ্রনাথের সেই শিক্ষা ও জীবনবোধের প্রশাংসায় যে দিন পঞ্চমুখ হচ্ছেন নরেন্দ্র মোদী, সে দিনই ভেসে উঠছে ট্রেনের কামরার দুর্ভাগ্যজনক ছবিটা।

হতেই পারে, এ দৃষ্টান্ত কোনও বিচ্ছিন্ন অবকাশ। হতেই পারে, এ বাংলা এখনও সর্বাংশে এত অসহিষ্ণু, অসংবেদনশীল হয়ে ওঠেনি। তবু বিস্ময়ের ঘোর কাটে না। আমাদের মাটিতেই দেখতে হল এ দৃশ্য? প্রশ্নচিহ্ন পিছু ছাড়তে চায় না।

সতর্ক হওয়ার সময় এসে গিয়েছে। বিপদ আরও ঘনীভূত হয়ে ওঠার আগেই প্রতিরোধের সব বন্দোবস্ত তৈরি রাখতে হবে। না হলে যেটুকু শ্লাঘার অবকাশ আজও অবশিষ্ট রয়েছে, তা-ও খোয়াতে হতে পারে।

Newsletter Anjan Bandyopadhyay Md. Manirul Sheikh National Anthem অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় জামাল মোমিন Jamal Momin
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy