আয়ারল্যান্ড গর্ভপাতকে সমর্থন করিল। স্বস্তি পাইল গোটা বিশ্ব। দক্ষিণপন্থী রক্ষণশীল রাজনীতি গোটা বিশ্বে প্রসার লাভ করিতেছে, তৎসহ শিকড় বিস্তার করিতেছে সামাজিক রক্ষণশীলতা। যাহার অন্যতম উদ্দেশ্য মেয়েদের নিয়ন্ত্রণ। মহিলাদের দেহ, মন ও বুদ্ধি খণ্ডিত করিয়া, তাঁহাদের স্বাতন্ত্র্য খর্ব করিয়া, কোনও এক নৈতিক বা পরমার্থিক অনুশাসনের দাসত্বে বাঁধিতে চাহে রক্ষণশীলতা। তাহার অন্যতম উপায় যোনি ও গর্ভাশয়ের নিয়ন্ত্রণ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট পদে আসীন হইবার পরেই গর্ভপাতের উপর রাশ টানিয়াছে সে দেশের সরকার। মেয়েদের স্বাস্থ্য প্রকল্পগুলিতে ফেডারাল সরকারের অনুদান পাইতে হইলে গর্ভপাত পরিষেবায় নানা শর্ত আরোপ করিতে হইবে, এমনই নিয়ম কার্যকর হইয়াছে সে দেশে। এমনকী আন্তর্জাতিক অনুদানেও এই নীতি আরোপিত হইয়াছে। অর্থাৎ কোনও একটি দেশের রক্ষণশীল নীতি কোনও না কোনও প্রকারে বিশ্বের সকল নারীকে বিপন্ন করে। প্রশ্নটি শুধু রাজনীতি বা স্বাস্থ্যবিজ্ঞানের নহে, ইহা নৈতিক প্রশ্ন। মার্টিন লুথার কিং বলিয়াছিলেন, অন্যায় যেখানেই হউক তাহা সর্বত্র ন্যায়কে বিপন্ন করে। এই কথার সারবত্তা আজ বিশ্বের মেয়েরা অনুভব করিতেছে। সেই কারণেই আইরিশ জনগণের মতামত সকল দেশের সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত হইয়াছে। আয়ারল্যান্ড দেশটি ছোট, কিন্তু তাহার এই সিদ্ধান্তের তাৎপর্য সামান্য নহে। পঁয়ত্রিশ বৎসর পূর্বে যে দেশে অধিকাংশ মানুষ গর্ভপাত নিষিদ্ধ করিবার পক্ষে মত দিয়াছিল, আজ সেই দেশেই দুই-তৃতীয়াংশ মতদাতা সংবিধান সংশোধন করিয়া সেই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করিবার পক্ষে, এই সংবাদ বিশ্বের নিকট পরিবর্তনের বার্তা বহন করে।
তাহাতে বিতর্কের অবসান হইবে না। গর্ভস্থ ভ্রূণে কখন প্রাণ সঞ্চার হয়, কখন চৈতন্যের উদয় হয়, তাহা লইয়া মতভেদ রহিয়াছে। কিন্তু তাহা যে প্রাণের সম্ভাবনা, তাহা তর্কাতীত। ফলে এক পক্ষের প্রশ্ন, অজাত সন্তানের জীবনের অধিকার কি নাই? অপর পক্ষের যুক্তি, গর্ভসঞ্চার যখন দৈহিক, মানসিক বা সামাজিক কারণে একটি মেয়েকে বিপন্ন করে, তখন তাহাকে গর্ভধারণে ও জন্মদানে বাধ্য করা কি অন্যায় নহে? গর্ভপাতে নিষেধাজ্ঞা যে কত অমানবিক হইতে পারে, তাহার নিদর্শন ভারতেরই এক কন্যা, সবিতা হলপ্পনবার। আয়ারল্যান্ডের বাসিন্দা সবিতা গর্ভসঞ্চারের পরে সংক্রমণে আক্রান্ত হইয়াছিলেন। তাঁহার আকুতি সত্ত্বেও আইরিশ চিকিৎসকরা আইনের বাধায় গর্ভপাত করেন নাই, ফলে মৃত্যু হয় সবিতার। ইহা ব্যতিক্রম নহে। যখনই গর্ভপাতের আইন কঠোর হইয়াছে, তখনই অচিকিৎসায় অথবা অপচিকিৎসায় প্রাণ দিয়াছে শত শত মেয়ে। তাহাদের পরিচয় কেহ জানে না, কিন্তু সেই সকল মৃত্যুর দাগ গোপন নাই। অসুরক্ষিত গর্ভপাতে মৃত্যু আজও প্রসূতিমৃত্যুর এক প্রধান কারণ।
নৈতিক বিতর্কের যুক্তি এক, বাস্তব আর এক। ভ্রূণের অধিকার লইয়া দক্ষিণপন্থীরা সরব, কিন্তু শিশুর ভালমন্দ লইয়া তাঁহারা যে অতি উদ্বিগ্ন, তাহার প্রমাণ মিলে নাই। উদ্বাস্তু শিশু নিত্য মরিতেছে, সকল দেশের সরকার উদাসীন। শিশুপাচার, শিশুশ্রম, শিশুদের যৌননিগ্রহের আন্তর্জাতিক চক্র ভাঙিবার কাজে তাঁহারা কতটা তৎপর? সাধারণ অসুখে শিশুমৃত্যু রুখিতে যাঁহারা ব্যর্থ, গর্ভস্থ শিশুর প্রাণরক্ষায় তাঁহারাই গলা ফাটাইতেছেন। ইহা ভণ্ডামি। রক্ষণশীল পুরুষতান্ত্রিক ভোটদাতাকে খোশামোদ করিয়া নেতারা সমর্থন আদায় করিতে চাহেন। সেই কারণে আয়ারল্যান্ডকে অভিনন্দন জানাইলেও, প্রতিবেশী নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডে গর্ভপাতের কঠোর আইন শিথিল করিতে নারাজ ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মে। অস্যার্থ, নারীর গর্ভে নিয়ন্ত্রণের প্রশ্নটি নৈতিক নহে, রাজনৈতিক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy