রাধাগোবিন্দ রায়। ছবি: লেখক
রাধুবাবু সাইকেল চালিয়ে কলেজে চলেছেন। যেতে যেতে তিনি হঠাৎ পাশ কাটাতে গিয়ে উঁচু জমিতে চাকা তুলে দিলেন। পড়ে গেলেন মাটিতে। ছেলেরা ছুটে এসে তাঁকে ধরে তুলে বলল, ‘‘হঠাৎ ঢিবিটায় চাকা তুললেন কেন?’’ প্রথমে চুপ করেই রইলেন। হয়তো কিছু বলার ইচ্ছে ছিল না। শেষে বলে উঠলেন, ‘‘আসলে কী জানিস বাবারা? সাইকেল চালাতে চালাতে দেখি, বেশ কিছু পিঁপড়ে রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। ওদের উপরে দিয়ে চাকা তুলে দিলে বেশ ক’টা মরে যেত, তাই পাশ কাটিয়ে ঢিবিটা দিয়ে যেতে গেছিলাম।’’
এই রাধুবাবু হলেন রাধাগোবিন্দ রায়। বিষ্ণুপুরের অন্যতম রূপকার তথা রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী। ১২৯৭ বঙ্গাব্দের ৬ অগ্রহায়ণ (১৮৯০ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে) বিষ্ণুপুরের গোঁসাইপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন রাধাগোবিন্দবাবু। তাঁর বাবার নাম প্রসন্নকুমার রায়। তিনিই রায়বংশের প্রথম ইংরেজি-শিক্ষিত ব্যক্তি ছিলেন।
১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের পরে বাঁকুড়ার এই কৃতী সন্তান রাজনীতিতে যোগ দেন। তার আগে তিনি ছোটবেলা থেকেই নানা জনহিতকর কাজের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত রেখেছিলেন। অল্প বয়সেই রাধুবাবু বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের শরিক হয়োছিলেন। ১৯১৯ সালে মাত্র ২৯ বছর বয়সে রাঁচীর ব্রহ্মচর্য বিদ্যালয়ের শিক্ষকতা ছেড়ে, গাঁধীর নেতৃত্বে স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দেন। এই সময় বিষ্ণুপুরের আর এক কৃতীপুরুষ রামনলিনী চক্রবর্তীকে সভাপতি ও রাধাগোবিন্দ রায়কে সম্পাদক মনোনীত করে একটি অস্থায়ী কংগ্রেস কমিটি গঠিত হয়।
এই কমিটির উদ্দেশ্য ছিল, ব্রিটিশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বর্জন ও জাতীয় বিদ্যালয় স্থাপন। মাড়োয়ারি ব্যবসায়ী শিবদাস রাঠী বিষ্ণুপুরের মিশন ডাঙার পাশে জমি দান করেন। সেখানে স্বামী বিবেকানন্দের নামে একটি জাতীয় বিদ্যালয় গড়ে ওঠে। তার দায়িত্ব পড়ে রাধাগোবিন্দ রায়ের উপরে। রাধাগোবিন্দ ছিলেন দর্শনশাস্ত্রে এম এ। ১৯২৯-এ তিনি লাহৌর কংগ্রেসের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, আইনসভা থেকে পদত্যাগ করেন। ১৯৩০ সালে লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলনে যোগ দেন এবং কারারুদ্ধ হন। ১৯৩০ সালের ১৪ জুলাই তাঁর নেতৃত্বে বিষ্ণুপুর মহকুমার ইন্দাস ও পাত্রসায়র থানার ট্যাক্স বন্ধ আন্দোলন তীব্রতা লাভ করে।
সুভাষচন্দ্র বসুর সঙ্গে রাধুবাবুর হার্দিক সম্পর্ক ছিল। সুভাষ একাধিকবার তাঁর আতিথ্য গ্রহণ করে তাঁর বড়দির নিমতলার বাড়িতে থাকতেন। দু’জনে এক সঙ্গে একাধিক সভা করেছেন। ভারতবর্ষ ত্যাগের আগে সুভাষচন্দ্র প্রত্যেক বিজয়ায় তাঁকে পত্র পাঠাতেন। এঁদের দু’জনের পাশাপাশি বসে থাকা ছবি কলকাতার নেতাজি রিসার্চ ব্যুরোতে রয়েছে।
বিষ্ণুপুরে এক সময় একটি ব্যাঙ্ক খোলা হয়। নেপথ্যে ছিলেন, রামনলিনী চক্রবর্তী, শ্রীদাম দাশগুপ্ত ও রাধাগোবিন্দ রায়। রাধুবাবু ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিয়ে বাড়ি তৈরি করেছিলেন। পরে ব্যাঙ্কটি ‘ফেল’ করে। তাঁর বিশিষ্ট বন্ধু হরভূষণ মণ্ডলের টাকা ব্যাঙ্কে জমা ছিল। ব্যাঙ্কের টাকা শোধ করার মতো আর্থিক সচ্ছলতা রাধুবাবুর ছিল না। সত্য রক্ষার্থে তিনি তাঁর বাড়িটি হরভূষণবাবুকে লিখে দেন। মাসে মাসে পঞ্চাশ টাকা ভাড়া দিয়ে নিজের বাড়িতেই সপরিবারে আমৃত্যু থেকেছেন রাধাগোবিন্দ রায়।
১৯৩৪ সালে মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধী ব্যক্তিগত সত্যাগ্রহের ডাক দেন। প্রত্যেক জেলাতে সত্যাগ্রহীদের একটি তালিকা পাঠানোর নির্দেশ দেন তিনি। জানান, এঁরাই ব্যক্তিগত সত্যাগ্রহে অংশগ্রহণ করবেন। এক-এক জন ব্যক্তিগত ভাবে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ সুপার, এসডিও-দের পত্র লিখে জানিয়ে নির্দিষ্ট দিনে, নির্দিষ্ট সময়ে, নির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে আইন অমান্য করবেন। সে সময় সত্যাগ্রহী হিসেবে বাঁকুড়া জেলায় যাঁদের নাম পাঠানো হয়েছিল, তাঁদের অন্যতম ছিলেন রাধাগোবিন্দ রায়।
১৯৪৪ খিস্টাব্দে বিষ্ণুপুরের ফ্রেন্ডস ইউনিয়ন ক্লাবের তরফে একটি মিটিং ডাকা হয়েছিল— যার বিষয় ছিল একটি কলেজ স্থাপনা। সাংবাদিক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের নামে সেই কলেজের নামকরণ করার প্রস্তাব দেন রাধুবাবু। উপস্থিত সকলের সম্মতিতে তা গৃহীতও হয়েছিল।
১৯৪৫ সালের ১ জুলাই স্থাপিত হয় রামানন্দ কলেজ। এই কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ হন রাধাগোবিন্দবাবু। সাত বছর তিনি অধ্যক্ষ পদে ছিলেন। অত্যন্ত দক্ষ প্রশাসক ছিলেন। বিশেষ দিনগুলিতে তিনি অধ্যাপক-অধ্যাপিকা ও ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে আলোচনাসভা ডাকতেন। ফলে, সকল শিক্ষকমণ্ডলীকে সচেতন ও সজাগ থাকতে হত নিরন্তর। এর পরে পশ্চিমবঙ্গের তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ের মন্ত্রিসভায় মন্ত্রী পদে যোগ দেন। সে বছর একটি নতুন মন্ত্রক, ‘তফশিলি ও আদিবাসী কল্যাণ বিভাগ’ তৈরি করা হয়। এই বিভাগের মন্ত্রী হন রাধাগোবিন্দ রায়।
১৩৭১ বঙ্গাব্দের ১৩ কার্তিক এই কর্মপ্রাণ ব্যক্তিত্বের জীবনাবসান ঘটে।
লেখক বিষ্ণুপুর রামানন্দ কলেজের শিক্ষক ও সংস্কৃতিকর্মী
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy