Advertisement
E-Paper

ভয়ের কাহিনি

সংক্ষিপ্ত সংলাপগুলি হইতে এই রাষ্ট্র সম্পর্কে ধারণা করা যায়— সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বিপন্ন, বিপন্ন অন্য ভাবনাচিন্তার অভ্যাস। মুহুর্মুহু গাড়ি তল্লাশি হয়, অধ্যাপককে পুলিশের নিকট হইতে ক্লাস লেকচারের নোট লুকাইতে হয়। এই সিরিজ় নির্মাণের সময় ভারাভারা রাও আদি বুদ্ধিজীবীদের আটক করা হয় নাই, কিন্তু জীবন তো প্রায়ই শিল্পকে অনুসরণ করে।

শেষ আপডেট: ০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০১:০৬
রাধিকা আপ্তে।ছবি সৌজন্যে সোশাল মিডিয়া।

রাধিকা আপ্তে।ছবি সৌজন্যে সোশাল মিডিয়া।

নেটফ্লিক্স তৈরি করিল নূতন সিরিজ়: ‘গুল’ (Ghoul)। আখ্যানটি ‘হরর’ ঘরানার, অর্থাৎ ভীতি ও বীভৎস রসের উপর ভিত্তি করিয়া রচিত। সিরিজ়টির মধ্যে সর্বাধিক লক্ষণীয়: এক পিশাচের গল্প বলিবার ছলে ইহা বর্তমান ভারতীয় রাষ্ট্র ও সমাজের এক পৈশাচিক প্রবণতার কথা বলে। প্রথম এপিসোডেই লিখা থাকে, ইহা অদূর ভবিষ্যতের গল্প। এই অদূর ভবিষ্যতে পুলিশ মুসলিম মহল্লায় ঢুকিয়া তাহাদের বইপত্র নির্বিচারে পুড়াইয়া দেয়। সিরিজ়ের নায়িকা (সে-ও মুসলিম) কাজ করে বিশেষ বাহিনীতে, যাহারা কয়েদিদের জেরা করিবার ক্ষেত্রে বিশারদ। তাহাকে সামরিক শিক্ষায়তনে গাড়ি চালাইয়া পৌঁছাইয়া দিবার সময় তাহার পিতা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস সম্পর্কে প্রবল বিতৃষ্ণার কথা জানান। নায়িকা তর্ক করে, তাহার মতে, রাষ্ট্র কখনও বিনা দোষে কাহাকেও আটক করে না, অত্যাচার করে না। নায়িকা দেখিয়া বিস্মিত ও ব্যথিত হয়, বাবা গাড়িতে কিছু বই লইয়া যাইতেছেন। তাহার পরে, পুলিশ গাড়িটির পথ রুদ্ধ করে। বাবার পরিচয়পত্র দেখিয়া, তাঁহাকে নামিতে আদেশ করে। বিশ্রী ভাবে খিঁচাইয়া উঠে: গাড়িতে কী লইয়া যাইতেছিস? অস্ত্র? মাদক? গোমাংস? ইহার পূর্বে নায়িকাকে বাবা বলিয়াছেন, তাঁহার ব্যাগে কিছু ক্লাসে পড়াইবার নোট রহিয়াছে। নায়িকা শিহরিয়া জিজ্ঞাসা করিয়াছে, ‘‘বাবা, তুমি আবার সিলেবাসের বাহিরের কথা পড়াইতেছ?’’ সংক্ষিপ্ত সংলাপগুলি হইতে এই রাষ্ট্র সম্পর্কে ধারণা করা যায়— সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বিপন্ন, বিপন্ন অন্য ভাবনাচিন্তার অভ্যাস। মুহুর্মুহু গাড়ি তল্লাশি হয়, অধ্যাপককে পুলিশের নিকট হইতে ক্লাস লেকচারের নোট লুকাইতে হয়। এই সিরিজ় নির্মাণের সময় ভারাভারা রাও আদি বুদ্ধিজীবীদের আটক করা হয় নাই, কিন্তু জীবন তো প্রায়ই শিল্পকে অনুসরণ করে।

নায়িকা অনেক ভাবিয়া, কর্তৃপক্ষের নিকট বাবাকে ধরাইয়া দেয়। কারণ, দেশের অপেক্ষা বড় আত্মীয় তো কেহ নাই। তাহাকে অবশ্য আশ্বাস দেওয়া হয়, বাবাকে অত্যাচার করা হইবে না, কেবল বুঝাইবার চেষ্টা হইবে। তবে কিনা, বুদ্ধিজীবীদের শিখাইতে একটু অধিক সময় লাগে। তাহার পর দেখা যায়, এক কুখ্যাত উগ্রপন্থীকে কয়েদ করিয়া লইয়া যাওয়া হইতেছে বিশেষ কেন্দ্রে। সেইখানে নায়িকাকেও ডাকা হয়, সন্ত্রাসবাদীটিকে জেরা করিবার জন্য। ক্রমে বুঝা যায় উগ্রপন্থীটি মানুষ নহে, এক পিশাচ, যে কাহাকেও দ‌‌‌ংশন করিলে, তাহার রূপ পরিগ্রহ করিতে পারে। ফলে পিশাচের কবলে পড়িয়া একের পর এক ‘দেশসেবক’ রাষ্ট্রদ্রোহী হইয়া যাইতে শুরু করে (কেন্দ্রের অফিসারদের হত্যা করে, কয়েদিদের পলাইবার সুযোগ করিয়া দেয়)। নায়িকা ক্রমে বুঝিতে পারে, এই কেন্দ্রে যাহাকে আনা হয়, সে আর ফিরিয়া যায় না, তাহাকে রাষ্ট্র নিধন করে, এমনকি সে উগ্রপন্থী নহে, সেই কথা বুঝিলেও। নায়িকার বাবার সহিতই সেই ব্যবহার করা হইয়াছে। পিশাচ সকল গোপন কথা জানে, সে কাহিনিগুলি উন্মোচন করিতে থাকে। জানা যায়, এক নিরীহ চা-বিক্রেতাকে উগ্রপন্থী সন্দেহে কয়েদ করিয়া, স্বীকারোক্তি আদায়ের তাড়নায় তাহার স্ত্রী ও সন্তানকে আনিয়া তাহার সম্মুখে অত্যাচার করা হয়, ক্রমে জেরাকারীদের ক্রোধ ও ঘৃণার ধাপ চড়িতে চড়িতে শিশুসন্তানটিকে হত্যা করিয়া ফেলে এক জন। সকল জানিয়া নায়িকার দেশপ্রেমেও চিড় ধরিতে থাকে। সে বুঝিতে পারে, রাষ্ট্রকে যে কল্যাণময় মূর্তিতে সে পূজা করিত, হয়তো তাহা ভুল।

বিশেষ অনুধাবনীয়: এই দেশে এই সময়ে দাঁড়াইয়া এমন স্পষ্টবাক্ এক প্রতিবাদশিল্প রচিত হইল। হরর-কাহিনির আস্তরণে যে বর্তমান ভারতের রাষ্ট্র-সমর্থিত সাম্প্রদায়িক জিঘাংসার কথা বলা হইতেছে, বুঝিতে কাহারও বাকি থাকিবে না। জেরাকারীদের আক্রোশ ও পক্ষপাত সমগ্র সিরিজ়ে দপদপ করিতে থাকে। এক কর্ত্রী বলে, এক নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের মধ্যে জন্মগত দেশদ্রোহ ঢুকিয়া বসিয়া অাছে। সে নায়িকাকে জিজ্ঞাসাও করে, তাহার মুসলিম পরিচয় তাহার কর্তব্যে গাফিলতি ঘটাইবে কি না। অন্ধকারাচ্ছন্ন আর্তনাদময় এই কেন্দ্রটিতে যেই পিশাচ আসিয়া পড়ে, সকলে নিশি-দুঃস্বপ্নে নিজ নিজ অপরাধের কাহিনিগুলি দেখিতে শুরু করে। তাহাদের (এবং দর্শকদের) সন্দেহ হইতে শুরু করে, এই দেশে তবে কে প্রকৃত সন্ত্রাস বপন ও সঞ্চার করিতেছে। কে প্রকৃত পিশাচ। সম্ভবত এই বার ওয়েব-সিরিজ় সেন্সর করিবার দাবি উঠিবে। ভরসা: চরম নজরদারিতেও কোন শিল্প-সরিষার মধ্যে কেমন করিয়া সদর্থক ভূত ঢুকিয়া পড়ে, দেবা ন জানন্তি।

ব্রিজ ভেঙে পড়েছে, রাস্তাঘাট বন্ধ, অটো-চালকেরা সেই মওকায় কেউ দ্বিগুণ কেউ তিন গুণ ভাড়া হাঁকছেন। এই হল ঈশ্বরের লীলা, যে কোনও সর্বনাশের ও-কূলে অবধারিত গজিয়ে উঠবে অন্যের পৌষমাস। তুমুল বৃষ্টি হয়, অ্যাপ-ক্যাব কোম্পানিরা উন্মত্ত ‘সার্জ’ চাপিয়ে দেয়। ট্রেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে পড়ে, আশেপাশের গ্রামবাসীরা পঞ্চাশ টাকা করে ডিমসেদ্ধ বিক্রি করেন। বিপন্ন লোককে তাই দর্শনঋদ্ধ গভীর শ্বাস নিয়ে ভাবতে হবে, যাক, কেউ না কেউ তো সম্পন্ন হল!

Web Series Netflix Ghoul Terrorism
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy