সংসদের শীত অধিবেশনে হায়ার এডুকেশন কমিশন অব ইন্ডিয়া ২০২৫ (এইচইসিআই) বিলটি পেশ করার পরিকল্পনা নিয়েছে কেন্দ্র। এই আইন ইউজিসি, এআইসিটিই ও এনসিটিই-র মতো সংস্থাগুলিকে অবলুপ্ত করে দিয়ে, উচ্চশিক্ষাকে একটিই সংস্থার নিয়ন্ত্রণাধীন করতে চায়। এত দিন ইউজিসি-র দায়িত্বে ছিল সাধারণ উচ্চশিক্ষা, এআইসিটিই-র হাতে ছিল কারিগরি ও ম্যানেজমেন্ট শিক্ষা এবং এনসিটিই দেখত শিক্ষক শিক্ষণ। এই সমস্তই চলে যাবে প্রস্তাবিত জাতীয় উচ্চশিক্ষা কমিশনের তত্ত্বাবধানে। কেবল মেডিক্যাল এবং আইন থাকবে কমিশনের আওতার বাইরে।
জাতীয় শিক্ষা নীতি ২০২০ (এনইপি)-তে এমন কমিশন গঠনের প্রস্তাব ছিল। তারও আগে ২০১৮ সালে ইউজিসি-কে অবলুপ্ত করার উদ্দেশ্যে জাতীয় উচ্চশিক্ষা কমিশন তৈরির আইন আনতে চেয়েছিল নরেন্দ্র মোদী সরকার। দেশ জুড়ে আপত্তি উঠেছিল, ওই বিল আইনে পরিণত হলে উচ্চশিক্ষায় রাজ্যগুলির, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির স্বাধিকার নস্যাৎ হবে। তখন বিল প্রত্যাহার করলেও, ২০২৫-এ আরও দাঁত-নখ যোগ করে আইনের প্রস্তাব এনেছে কেন্দ্র। প্রথমত, ২০১৮-র বিলে শুধু ইউজিসি বিলোপের প্রস্তাব ছিল, ২০২৫-এ যোগ হয়েছে এআইসিটিই ও এনসিটিই। দ্বিতীয়ত, প্রস্তাবিত জাতীয় উচ্চশিক্ষা কমিশনের হাত থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিকে অর্থ জোগানোর ক্ষমতা ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। এনইপি-২০২০ কিন্তু বলেছিল, উচ্চশিক্ষা কমিশনের অধীনে একটি সংস্থা তৈরি করা দরকার, যা অর্থ মঞ্জুর করবে। কিন্তু তা ঘটেনি।
শিক্ষায় কেন্দ্রীকরণের ফল কী হতে পারে, তা ইউজিসি-র তৈরি পাঠ্যসূচির দিকে তাকালেই বোঝা যায়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে পাঠ্যসূচি প্রস্তুত করে অ্যাকাডেমিক কাউন্সিল, যার সদস্য শিক্ষকরা, বিশেষজ্ঞরা। কেন্দ্র সেই দায়িত্ব ইউজিসি-কে দিয়েছে। গণিত, রসায়ন, বাণিজ্য, অর্থনীতি, ভূগোল, নৃতত্ত্ব, রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এমন সব খসড়া পাঠ্যসূচি পাঠাচ্ছে, তা দেখে অধ্যাপকদের মাথায় হাত। গণিতের পাঠ্যক্রমে ঢুকেছে তিথি, নক্ষত্র এবং শুভ ও অশুভ মুহূর্তের নির্ণয় পদ্ধতি। রয়েছে ‘বৈদিক গণিত’। মোহন ভাগবতের হিন্দু রাষ্ট্র নির্মাণে হয়তো এই পাঠক্রম সহায়ক হবে, কিন্তু শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ কী হবে? গণিতের ৯০০ জন অধ্যাপক ইউজিসি-কে প্রতিবাদপত্র পাঠিয়ে লিখেছেন, পাঠ্যক্রমের অনেকখানি অংশ অবৈজ্ঞানিক, যা আমাদের সভ্যতাকে শত বছর পিছিয়ে দেবে। ছাত্রছাত্রীরা আধুনিক অঙ্কশাস্ত্রে অজ্ঞ থেকে যাবেন। অন্য বিষয়গুলির পাঠ্যক্রমও তথৈবচ।
এনইপি-র সুপারিশে স্নাতক কোর্স তিন বছর থেকে বেড়ে হয়েছে চার বছর। ‘দক্ষতা-বৃদ্ধি’, ‘মূল্য-সংযোজিত’ কোর্সের বাহানায় ‘কোর’ বা মৌলিক বিষয়গুলি পাঠ্যসূচির বাইরে চলে গেছে। পড়তে হচ্ছে, ‘সুখী হওয়ার কৌশল’, ‘ফিট-ইন্ডিয়া’, ‘স্বচ্ছ ভারত’, ‘গরু-কল্যাণ’, ‘ব্রাহ্মণ-কল্যাণ’, যেগুলির যৌক্তিকতা ও প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। শিক্ষার্থীরা কলেজে ভর্তি হচ্ছেন না, বা ভর্তি হয়ে কলেজ-ছুট হচ্ছেন, অথবা কলেজের খাতায় নাম লিখিয়ে ক্লাস-মুখো হচ্ছেন না। এক সময়ের গমগম করা কলেজে পাঁচ-সাত জন পড়ুয়াকে নিয়ে অধ্যাপকরা ক্লাস করাচ্ছেন, এ ছবি সারা দেশের।
এ বছর দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় তিনটি ধাপে ছাত্র ভর্তি করেছে— একটি ‘স্পট রাউন্ড’, দু’টি ‘মপ-আপ রাউন্ড’ ও একটি ‘স্পট মপ-আপ রাউন্ড’। তার পরেও ৬৯টি কলেজে পাঁচ হাজার আসন খালি আছে। অথচ পাঁচ বছর আগেও ভর্তির যোগ্যতা মাপকাঠি ছিল দ্বাদশের বোর্ড পরীক্ষায় অন্তত ৯৮-৯৯ শতাংশ নম্বর। তার পরেও চাহিদার চাপে প্রায় ৩০ শতাংশ বেশি ভর্তি নিত কলেজগুলো। অথচ এখন শূন্যপদ পূরণ করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। ছাত্রী-ভর্তির ছবি ২০২১ সালে ৬১ শতাংশ থেকে বর্তমানে নেমেছে ৫৪ শতাংশে। এখন কেন্দ্রীয় প্রবেশিকা পরীক্ষা (সিইউইটি)-র মাধ্যমে স্নাতক স্তরে ভর্তি করা হয়। পাশ করা কোচিং-নির্ভর, অর্থাৎ ব্যয়সাপেক্ষ। অনেক ছাত্রছাত্রী বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে যাচ্ছেন। অর্থাৎ সিইউইটি বেসরকারি ব্যবস্থার সহায়ক হচ্ছে।
পশ্চিমবঙ্গে সরকার এনইপি চালু করবে না, এমনই দাবি করেছে। অথচ, চার বছরের স্নাতক কোর্স চালু হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলির অ্যাকাডেমিক কাউন্সিল, বা অন্যান্য বিধিবদ্ধ সংস্থা, নতুন স্নাতক কোর্সের গুণগত মান বিচার না করে সরকারি ফরমানে তা চালু করেছে। এ রাজ্যের পড়ুয়া-ভর্তির পরিসংখ্যানও হতাশাজনক। সরকারি কলেজ ও সরকার-সহায়তা প্রাপ্ত কলেজগুলোতে স্নাতকে ৯ লক্ষ ৩৬ হাজার আসন রয়েছে। পোর্টালে নাম নথিভুক্ত করেছিলেন ৪ লক্ষ ২১ হাজার ছাত্রছাত্রী, ভর্তি হয়েছেন মাত্র ২ লক্ষ ৬৯ হাজার, মোট আসনের মাত্র ২৮.৮১ শতাংশ। গত শিক্ষাবর্ষে ৪ লক্ষ আসন পূরণ হয়েছিল। এ বছর ওবিসি-র জন্য সংরক্ষণের মামলার ফল প্রকাশে দেরি হওয়ায় রাজ্যের সরকারি কলেজে পোর্টাল দেরিতে খোলায় বেসরকারি কলেজেই বেশি ছাত্রছাত্রী ভর্তি হয়েছেন।
অর্থাৎ পড়ুয়াদের বেসরকারি ব্যবস্থাপনার উপর নির্ভর করতে বাধ্য করা হচ্ছে— কেন্দ্রেও, রাজ্যেও। এতে উচ্চশিক্ষায় প্রবেশের অধিকার সঙ্কুচিত হচ্ছে। কলেজে না গিয়ে সামান্য কিছু রোজগারের কাজ করার দিকে ঝুঁকছে সবাই। মেধাসম্পদের এই অপচয়ের ফল ভুগতে হবে দেশকে।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)