ভাদু প্রতিমা হাতে নিয়ে এক কিশোরী। ফাইল চিত্র
উৎসবগুলির বেশিরভাগই শস্যকেন্দ্রিক, শস্য উৎসব এবং কৃষি সম্পর্কিত। তার মধ্যে টুসু সর্বাধিক পরিচিত ও প্রসিদ্ধ। ধানের খোসা-তুস থেকে তুসু-টুসুর নামের উৎস বলে সংস্কৃতিবিদের অভিমত সর্বাধিক প্রসিদ্ধ। টুসু গানকে কেন্দ্র করে ফুটে ওঠে মানভূমের জনজীবনের প্রাত্যহিক সুখ-দুঃখ, ব্যথা-বেদনার দৈনন্দিন ঘটনার ঘাত প্রতিঘাতের ছবি। সারা পৌষমাস জুড়ে টুসু গানে মুখরিত হয়ে ওঠে মানভূম।
ভাদু ও ভাদু উৎসব ঘিরে রয়েছে অনেক বিতর্ক। প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, কাশীপুরের কোনও এক রাজার ভাদ্রমাসে এক কন্যাসন্তান জন্মেছিল। যার নাম ছিল ভাদু। তাকে ঘিরেই সূত্রপাত ঘটেছিল ভাদু উৎসবের।
ভাদু উৎসবের সূচনাকাল ঘিরে বিভিন্ন অভিমত এবং জনশ্রুতি রয়েছে। অনেকের মতে, কাশীপুরের রাজা তাঁর বিবাহযোগ্যা কন্যার বিয়ে ঠিক করেছিলেন ভিন্দেশের রাজকুমারের সঙ্গে। বিবাহের রাতে বরযাত্রী-সহ বরবেশে রাজকুমার আসার পথে অসুস্থ হয়ে ভেদ বমি হয়ে মারা যান।
অন্য মতে, আসার পথে জঙ্গলে ডাকাত কর্তৃক বর ও বরযাত্রী আক্রান্ত হয়ে রাজকুমার মারা যান। ঘটনা শুনে মর্মাহত রাজকুমারী সহমরণে যান। এবং জনমানসে সতীলক্ষ্মী কন্যা হিসাবে স্থান লাভ করেন।
কেউ কেউ মনে করেন কাশীপুরের রাজার মেয়ে ভাদু ছোটবেলা থেকেই একটা পুতুল নিয়ে রাতদিন খেলা করত। যাকে সে আদর করে ভাদু বলে ডাকত। ওই পুতুলকে ঘিরে ছিল সাধনা-বন্দনা সবকিছু। ঘটনাপ্রবাহে ওই কন্যাসন্তান অসুস্থ হয়ে মারা যায়। রাজার অন্য কোনও সন্তান ছিল না। স্বাভাবতই তিনি শোকাতর হয়ে পড়েন। জনশ্রুতি অনুযায়ী, ওই মেয়ে রাজাকে স্বপ্ন দেয়, ‘বাবা ভাদু তোমার বাড়িতেই আছে। তুমি তাকে পালন কোরো’। তার পর থেকেই রাজ আদেশ অনুযায়ী শুরু হয় তাঁর মেয়ের স্মৃতিতে ভাদু উৎসব।
অনেকের মতে, রাজা গরুড় নারায়ণের এক মেয়ে ছিল। তার নাম ভাদু। তাকে ঘিরেই শুরু হয়েছিল ভাদু উৎসব। এসব জনশ্রুতির কোনও সময়কাল বা ঐতিহাসিক তথ্যের প্রমাণাদি নেই। জনশ্রুতির শেষ নেই। সুনির্দিষ্ট সূচনাকাল নেই। অনুরূপ ভাবে ভাদুর উৎস সম্পর্কেও সুনির্দিষ্ট তারিখ নেই।
জনশ্রুতি অনেক সময় হয়ে যায় কিংবদন্তী কাহিনি। পরে তা লাভ করে দেব মাহাত্ম্য। যুগ বিবর্তনে ভাদুর ক্ষেত্রেও অনেকাংশে জনমানসে সে স্থান লাভ করলেও আদৌ তা যুক্তিপূর্ণ নয়। কারণ, ভাদু সার্বিক ভাবে আদুরে কন্যা। যার সূত্রপাত হয়েছিল পঞ্চকোট রাজঘরাণায়। ভাদুগানেও তার নিদর্শন মেলে।— ‘‘কাশীপুরের রাজার বিটি, আদরের দুলালী গো।’’
যদিও কাশীপুরের রাজাদের প্রাপ্ত বংশপঞ্জিকায় কোথাও ভাদু/ ভদ্রেশ্বরী নামের কন্যাসন্তানের উল্লেখ নেই। আবার কাশীপুরের রাজবাড়িতে ভাদ্রমাসে ভাদুপূজার সূত্রপাত প্রসঙ্গে সে ধরনের গানেরও সন্ধান মেলে—‘‘কাশীপুরের মহারাজা গো পূজা করে, পথমে/ মনের মত ঘর পাঁয়েছে যা ছিল তার মনে।’’ ভাদ্র মাসে জন্ম ও উৎসব প্রসঙ্গে— ‘‘ভাদর মাসে আল্যে ভাদু/ কিছু ফুল আর ফুটে না/ শালুক ফুলে কউরব্যা পূজা/ ওগো- মনে দুখ্যু কইর্য না।’’
ভাদু কাশীপুরের রাজার মেয়ে হিসাবে জনশ্রুতির বিস্তার থাকলেও টুসুর মতো ভাদু মানভূমে সর্বজনবিদিত ও বন্দিত নয়। মানভূমে টুসু সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে উৎসব হিসাবে প্রতিপালিত হলেও ভাদু উৎসব সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে হয় না।
মানভূমে নিম্ন সম্প্রদায় ও দরিদ্র মানুষের ঘরে ভাদু বেশি সমাদৃত। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে— পঞ্চকোটের রাজারা তাদের রাজ্যে বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষকে বসতি দিয়ে বসবাস করলেও ভাদু নিম্ন সম্প্রদায়ের মানুষের ঘরে বেশি সমাদৃত কেন? বিভিন্ন মতের সন্ধান মেলে। অনেকের মতে, ভাদু অবৈধ সম্পর্কের ফলে নিম্ন সম্প্রদায়ের ঘরে জাত কন্যা বলেই। এ প্রসঙ্গে আদৌ তেমন কোনও যুক্তিনির্ভর তথ্যের সন্ধান নেই।
আবার বাঁকুড়া জেলার সিমলাপালে ব্রাহ্মণ ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের মেয়েরা পালন করেন ভাদু পরব। আবার ছেলেরাও পালন করেন ভাদু পরব। ভাদু-পুংলিঙ্গে ভাদা; অর্থাৎ, ছেলে ভাদু। বর্তমানে লুপ্তপ্রায়।
শ্রুতি-জনশ্রুতি-কিংবদন্তী যাই হোক— ভাদুও টুসুর ন্যায় শস্য উৎসব। মানভূমের অন্যান্য উৎসবগুলির মধ্যে করম, ইঁদ, জাওয়া, ছাতা, বাঁদনা যেমন শস্যকেন্দ্রিক উৎসব তেমন ভাদুও।
ভাদ্র মাসে জাত ফসল যেমন, কদো, গুন্দুল, মাড়োয়া, শ্যাঁওয়া ভাদো, ভাদোই প্রভৃতি; ভাদো বা ভাদোই নামে পরিচিত, সেই ‘ভাদো’ থেকে ভাদু নামের উৎপত্তি। কারণ কাশীপুরের রাজবাড়ির মেয়ে হয়ে জন্মালে তার নাম ভাদু না হয়ে ভদ্রেশ্বরী, ভদ্রাবতী ধরনের কিছু একটা বংশ পরম্পরায় হওয়াটাই স্বাভাবিক ছিল। অথচ, মানভূমে প্রচলিত উৎসব ভাদু হিসাবেই খ্যাত। ভদ্রেশ্বরী-ভদ্রাবতী উৎসব নয়।
ভাদ্র মাসে কৃষি পরিবার বিশেষ করে খেটে খাওয়া দিনমজুর মানুষের কাছে অভাবের মাস। উঁচুনিচু খরাভূমিতে ওই সময় অন্য ফসল হয় না। ডাঙা-তড়া জমিতেও ভাদো উৎপাদন হয়। দরিদ্র, নিম্ন সম্প্রদায়ের খেটে খাওয়া দিনমজুর অভাবের দিনে ভাদো খেয়ে দিন কাটাতেন। তাই এই ফসল তাঁদের প্রিয় ছিল।
স্বভাবতই উৎসবের সূচনাকাল থেকে ভাদু উৎসব প্রতিপালন করেন তাঁরাই বেশি। ভাদু তাঁদেরই কল্পিত শস্য উর্বরতার মানসকন্যা।
টুসুর মতো ভাদুও কন্যা আদরে সমাদৃতা। ভাদু উৎসবের সুনির্দিষ্ট মন্ত্র, পুরোহিত, দর্শন নেই। তবে, উৎসব পালনের প্রথা প্রকরণ নিয়ম অঞ্চল বিশেষে রয়েছে।
ভাদু মূর্তি পিঁড়িতে স্থাপন, শঙ্খধ্বনি, উলুধ্বনি, উপাচার, বন্দনা, আরতি, ভাদ্রসংক্রান্তিতে জাগরণ সব কিছুই রয়েছে। যা হয় ভাদুগানের মধ্যে দিয়েই। শস্য উৎসবের প্রতীকী কুমারী কন্যার সমাদরে—
‘‘সাঁঝ দিলম সন্ধ্যা দিলাম, দিলাম সঙ্গে বাতিগো/ যত দেবতা সন্ধ্যা লাও, মা লক্ষ্মী সরস্বতী গো।।’’
কাশীপুরের রাজবাড়ি হয়ে ওঠে উৎসব মুখর। পিঁড়ির উপর সাজানো হয় ভাদুর প্রতিমা। চারিদিকে ঝলসে ওঠে আলোর ঝলসানি। মুখরিত হয়ে ওঠে ভাদু গানে— ‘‘ঝুনঝুনি পাতা ভাদুর কমরে গাঁথা/ ঝুন করে পড়ে গেল ভাদুর কমরের বিছা।’’
এ ছাড়াও— ‘‘সরু সরু ধান ফুল ভাদুর গলেবিনা সুতায় গাঁথব্য কদমতলে।’’
আবার— ‘‘একবাটি চাল ভিজতে দিলাম/ ভিজে হল্য মুসুরি/ সন্ধ্যাবেলা খবর আল্য/ মরল্য ভাদুর শাশুড়ী।’’ (প্রচলিত)
এ ছাড়াও শোনা যায়, রামায়ণ, মহাভারত কেন্দ্রিক গান। প্রাত্যহিক সুখ-দুঃখ, ব্যথা-বেদনার গান। এমনকি, সাম্প্রতিক কালে জনজীবনের ছবিও। তবে ভাদুকে স্মৃতি উৎসব বা শোক উৎসব হিসাবে মেনে নেওয়ার কোনও যুক্তি নেই।
লেখক আদ্রার সাহিত্যকর্মী
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy