Advertisement
E-Paper

বদলেছে আঙ্গিক, মূল ভাব অক্ষুণ্ণ ফুল্লরা মেলার

খড়ের চালা থেকে প্যান্ডেল হয়েছে, গ্যাসবাতি থেকে ইলেক্ট্রিকের আলো, কেজি দরের রসগোল্লাকে ম্লান করে মেলায় এখন ফাস্টফুডের আধিক্য তবু শতবর্ষ প্রাচীন এ মেলার মূল ভাব অক্ষুন্নই থেকে গিয়েছে। জাতি– ধর্ম–দল– মতের মিলন ক্ষেত্র রূপে ফুল্লরায় এখনও বাজে চিরায়ত সম্প্রীতির সুর। লিখছেন উজ্জ্বল মুখোপাধ্যায়।দেবী ফুল্লরা নিয়ে কত কথা-ই না প্রচলিত। পীঠনির্ণরতন্ত্র অনুযায়ী ওখানে সতীর ওষ্ঠ পড়েছিল— ‘অট্টহাসে চোষ্ঠপাতে দেবীসাফুল্লরাস্মৃতা’।

শেষ আপডেট: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০০:০১
ফুল্লরার মন্দিরে প্রবেশপথ। ছবি: লেখক

ফুল্লরার মন্দিরে প্রবেশপথ। ছবি: লেখক

অতীত স্মৃতির পথ বেয়ে আসুন আমরা পৌঁছে যাই একশো কুড়ি বছর আগে। ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ৫ ফাল্গুন। পড়ন্ত শীতের দুপুরে, বেশ চড়া রোদে গোরুর গাড়িটা এসে থামল কুঁয়ে নদীর পূর্ব পাড়ে। সেই থুপসরা থেকে টানা এক গাড়ি লোক, সঙ্গে যাত্রা দলের মালপত্তর বয়ে এনে বলদ দু’টোরও একটু জিরেন দরকার। আর তো একটুকু পথ। ওই তো, নদীর পশ্চিম পাড়ে লম্বা করে তাকালে দলদলির জলা পেরিয়ে, কূর্মাকৃতির লালচে রুক্ষ মাঠ। ওখানেই বসেছে মেলা।

ফুল্লরা মহাপীঠ মহামেলা।

দেবী ফুল্লরা নিয়ে কত কথা-ই না প্রচলিত। পীঠনির্ণরতন্ত্র অনুযায়ী ওখানে সতীর ওষ্ঠ পড়েছিল— ‘অট্টহাসে চোষ্ঠপাতে দেবীসাফুল্লরাস্মৃতা’। তবে, ও-সব শাস্ত্রের কথা জানে ক’জনা? আর জানার দরকারই বা কী? সবাই এইটুকু জানলেই যথেষ্ট যে, শিব যখন দক্ষযজ্ঞ ভঙ্গ করে যজ্ঞাহুতিতে প্রাণ দেওয়া সতীর দেহ নিয়ে তাণ্ডব নৃত্যে সৃষ্টিকে ধ্বংস করতে বসেছিলেন, তখন বিষ্ণু তাঁর সুদর্শন চক্র দ্বারা সতীর দেহ একান্নটি খণ্ডে ছিন্ন করেন। সতীদেহের সেই একান্নটি অংশ যেখানে যেখানে পড়েছে, সেই স্থানগুলিই সতীপীঠ নামে পরিচিত। ফুল্লরাও তেমন একটি সতীপীঠ। শাস্ত্র কথা, লোককথা, কিংবদন্তি সব মিলিয়ে এই ফুল্লরার মাহাত্ম্যে কাল পরম্পরায় ভক্তবৃন্দ এখানে মাতৃদর্শনে সমাগত হয়। দেবী ফুল্লরার ইতিবৃত্তের নিমগ্ন সন্ধানী প্রণব চট্টোপাধ্যায়ের দেওয়া তথ্য আনুযায়ী, আনুমানিক ৭৪২ খ্রিস্টাব্দে বেদগর্ভ তৎকালীন বঙ্গাধিপতি আদিশূরের কাছ থেকে বটগ্রাম লাভ করেছিলেন এবং তাঁর পুত্র বশিষ্ট লাভ করেছিলেন সিদ্ধল গ্রাম (বর্তমানে শীতল গ্রাম)। বশিষ্টের পুত্র অট্টহাসই ছিলেন এই সতীপীঠের প্রথম সাধক। তাঁর নামানুসারেই তৎকালীন লাভপুরের নাম ছিল অট্টহাস।

এই অট্টহাসের উত্তর পুরুষ, বর্মণ রাজাদের মহাসন্ধিবিগ্রহিক (মিনিস্টার অব ওয়ার অ্যান্ড পিস) ভবদেব ভট্ট (শীতলগ্রামে যাঁর সমাধি আজও বর্তমান) মিথিলা (মতান্তরে কনৌজ) থেকে বিতারিত কয়েক জন বেদানুসারী ব্রাহ্মণকে পিতৃপুরুষের আরাধ্যা দেবী ফুল্লরার পূজারি রূপে নিয়ে আসেন আনুমানিক ১১৭৯ খ্রিস্টাব্দে। তারও প্রায় দুই শতক পরে এই মৈথিল ব্রাহ্মণদের বংশধর দিনমণি মিশ্র বাহাদুর অত্যন্ত প্রভাবশালী রূপে রাজা উপাধি লাভ করেন এবং সামল বর্মার নাম অনুসারে লাভপুর অঞ্চলের (তৎকালীন অট্টহাস) নামকরণ করেন সামলাবাদ। শোনা যায় এই দিনমণি মিশ্র বাহাদুরের আমলেই সামলাবাদ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। ধ্বংস হয়ে যায় ফুল্লরা মন্দিরও।

ঐতিহ্য: শিলাময় মাতৃমূর্তি। ছবি: লেখক

গোরুর গাড়ি থেকে নেমে সবাই ছড়িয়ে পরে। কেউ নদীর পাড়ে বসে, কেউ আবার তিরতিরে ধারায় আঁজলাভর্তি জল পান করেন। দলের আধিকারিক অন্নদাপ্রসন্ন হাজরা নদীর খাড়া ঢালে জাপটে ধরে থাকা শিমুল গাছের শিকড়ে বসে পড়েন থেলো হুঁকোটা নিয়ে। দূরে দেখা যাচ্ছে, ঝোপের আড়ালে বেড়িয়ে আছে ফুল্লরা মন্দিরের শীর্ষে থাকা সিংহ দু’টি। খুব অতীতের কথা নয়। ১৮৯৫ সালে গ্রামের বিত্তবান ব্যক্তি যাদবলাল বন্দ্যোপাধ্যায় প্রতিষ্ঠা করেছেন নতুন মন্দিরটি। অবশ্য ফুল্লরা মন্দিরের আদি ইতিহাস অত্যন্ত গৌরবের। সিয়ান প্রশস্তি থেকে জানা যায় পাল বংশীয় নয়পাল বা তাঁর পুত্র তৃতীয় বিগ্রহ পাল (আনুমানিক ১০২৭-৭০ খ্রিস্টাব্দ) এই অট্টহাস মন্দির নির্মাণ করেন, যার শিখরে থাকা সুবর্ণ কলসের আলোকছটায় মনে হত যেন আকাশে দ্বিতীয় সূর্যের উদয় হয়েছে। এর পরে দিনমণি মিশ্র বাহাদুরের আমলে মন্দির ধ্বংসপ্রাপ্ত হওয়ার পরে কৃষ্ণানন্দ গিরি একটি ছোট্ট মন্দির নির্মাণ করেছিলেন। সে মন্দিরও ভগ্নপ্রায় হয়ে যাওয়ায় যাদবলাল তৈরি করেন সর্বশেষ মন্দিরটি।

মন্দিরের সামনেই বিশাল মাঠে মাঘী পূর্ণিমা তিথি উপলক্ষে বসে বিশাল মেলা। মেলা যে মাঘী পূর্ণিমা তিথি উপলক্ষে শুরু হয়েছিল, তারও কারণ আছে। কথিত, বুদ্ধগয়ার শ্রীমৎশঙ্করাচার্য মঠের সন্ন্যাসী কৃষ্ণানন্দ গিরি সাক্ষাৎ মাতৃদর্শনের আকাঙ্ক্ষায় কাশীধাম থেকে স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে এই মাঘীপূর্ণিমা তিথিতেই লাভপুরে এসে পৌঁছেছিলেন। জঙ্গলে আচ্ছাদিত কূর্মাকৃতির শিলাময় মাতৃমূর্তি তিনি নতুন করে আবিষ্কার করেছিলেন। সেই কারণে প্রতি বছর মাঘী পূর্ণিমা তিথিতে মায়ের বিশেষ পুজো হয়ে থাকে। ফুল্লরা মেলাও তাই প্রতি বছর মাঘী পূর্ণিমায় শুরু। যদিও মেলা ৩ ফাল্গুন থেকে, তথাপি ১ ফাল্গুন থেকেই শুরু হয় হোম-যজ্ঞ। দাঁড়কা নিবাসী তারাদাস ভট্টাচার্য এবং চৌহাট্টা নিবাসী ঈশান ভট্টাচার্যের চণ্ডীপাঠে গমগম করে ওঠে মন্দিরের গর্ভগৃহ।

পিছনে ফিরে তাকানো যাক।

১৩০৬ বঙ্গাব্দের ৩রা ফাল্গুন। বসেছে প্রথম বারের ফুল্লরা মেলা। মেলার মুখ্য উদ্যোক্তা কুমুদীশ বন্দ্যোপাধ্যায়, পঞ্চানন চট্টোপাধ্যায়, শৈবেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, হৃষিকেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, হৃষিকেশ দত্ত প্রমুখ। যে কমিটি তৈরি হয়েছে, তাতে ভাণ্ডারের দায়িত্বে যতীন্দ্র মোহন বন্দ্যোপাধ্যায় ও বিনোদবিহারী বন্দ্যোপাধ্যায়। রান্না ও প্রসাদের দায়িত্বে যোগেন্দ্রনাথ দেবশর্মা। পঞ্চাননবাবু হিসাব রক্ষক। আর পূজা আয়োজনে গিরীশচন্দ্র ভট্টাচার্য। মেলা কমিটি বাঁশ ও খড় দিয়ে প্রথমে দুশো চালা ও পরে আরও একশো চালা বানিয়ে দেয়। বিকিকিনির পসরায় জমে ওঠে মেলা। দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ আসতে শুরু করেন। এই মেলাতেই ৫,৬, ৭ ফাল্গুন— তিন রাত ধরে যাত্রা গানের আয়োজন করা হয়েছে। সেই কারণেই এতদ অঞ্চলের জনপ্রিয় যাত্রা-অধিকারী থুপসরার অন্নদাপ্রসাদ হাজরা তাঁর দলবল নিয়ে গোরুর গাড়ি করে কুঁয়ে নদী পেরিয়ে চলেছেন ফুল্লরা মেলার দিকে । তিন দিনই তাঁর যাত্রা। এমন করে পালা করতে হবে, যেন লাভপুর অঞ্চলের লোকের মন ভরে যায়। অন্নদাপ্রসাদের যাত্রা দলের গোরুর গাড়ি ফুল্লরা মন্দিরে এসে দাঁড়ায়। মন্দিরের সামনে হৃষিকেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাঁধিয়ে দেওয়া পুকুরে স্নান সেরে মায়ের ভোগ সেবা করবে শিল্পীদল। তার পরে জমজমাট মেলায় তিন দিন এমন অভিনয় করতে হবে, যাতে পরের বছর ১৩০৭ বঙ্গাব্দের ২১ শে মাঘ দ্বিতীয় বারের ফুল্লরা মেলায় যাত্রার বায়না পাকা হয়ে যায়।

ইতিকথার অতীত থেকে ফিরে আসি বর্তমানে। এ বছর ১৯ ফেব্রুয়ারি (মঙ্গলবার) অর্থাৎ ৬ ফাল্গুন, মাঘী পূর্ণিমা তিথিতে শুরু হচ্ছে মেলা। ১৩০৬ থেকে ১৪২৫—একশো কুড়ি বছরে পদার্পণ করল বীরভূম জেলার অন্যতম প্রাচীন ও বৃহৎ মহামেলা। সময় পেরিয়েছে অনেক। কালের নিয়মে পরিবর্তন হয়েছে মেলার রূপ ও আঙ্গিকেরও। খড়ের চালা থেকে প্যান্ডেল হয়েছে, গ্যাসবাতি থেকে ইলেক্ট্রিকের আলো, কেজি দরের রসগোল্লাকে ম্লান করে মেলায় এখন মুখোরোচক ফাস্টফুডের আধিক্য, পুতুল নাচ – নন্দনকানন অবলুপ্ত হয়ে গ্রামীণ মেলাতেও আসর জমাচ্ছে জনপ্রিয় টিভি চ্যানেলের শো। তবু শতবর্ষ প্রাচীন ঐতিহ্যময় এ মেলার মূল ভাব অক্ষুন্নই থেকে গিয়েছে। জাতি– ধর্ম–দল– মতের মিলন ক্ষেত্র রূপে ফুল্লরা মহাপীঠ মহামেলার মাঠে ১০ দিন ধরে বেজে ওঠে চিরায়ত সম্প্রীতির সুর।

(লেখক শিক্ষক ও নাট্যকর্মী, মতামত ব্যক্তিগত)

(কৃতজ্ঞতা স্বীকার – প্রণব কুমার চট্টোপাধ্যায়, ইতিহাস শিক্ষক ও আঞ্চলিক গবেষক। )

Ritual Special Event Fullara Mela
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy