স্কুলশিক্ষকদের মূল্যায়ন করিবেন অভিভাবকরা, প্রস্তাব করিয়াছে রাজ্য সরকার। স্কুলের পরিকাঠামো, পরিচ্ছন্নতা, মধ্যাহ্নভোজন-সহ নানা কর্মসূচি এবং সর্বোপরি পঠনপাঠনের মান বিষয়ে অভিভাবকরা সজাগ থাকিবেন, ইহা প্রত্যাশিত। সেই জন্যই শিক্ষার অধিকার আইন অনুসারে স্কুল পরিচালনা কমিটিতে সকল অভিভাবক, কিংবা তাঁহাদের প্রতিনিধিদের থাকিবার কথা। কিন্তু কিছু শিক্ষক সংগঠন অভিভাবকদের মূল্যায়নের বিরোধিতা করিতেছেন। তাঁহাদের আশঙ্কা, শাসক দলের নেতারা অভিভাবকদের প্রভাবিত করিয়া বা সরাসরি মূল্যায়নপত্র হস্তগত করিয়া বামপন্থী তথা অন্যান্য বিরোধী শিক্ষকদের নাকাল করিবেন। এই আশঙ্কা কি সম্পূর্ণ অমূলক? এ রাজ্যে ঘরের দেওয়াল হইতে রাস্তার গাছ, সব কিছুরই গায়ে রাজনৈতিক দলের রঙ লাগিয়া যায়। এখানে কোনও কাজ দলীয় রাজনীতির স্পর্শ ছাড়াই সম্পূর্ণ হইবে, আশা করা কঠিন। কিন্তু সেই আশঙ্কায় পিছাইয়া আসিলে সকল বিষয়েই নাগরিকের মতামত বাতিল করিতে হইবে। স্কুলের মূল্যায়নে দুর্নীতি রুখিতে গিয়া অভিভাবকদের মত অগ্রাহ্য করা চলে না। আর রাজ্য জুড়িয়া লক্ষ লক্ষ অভিভাবকের সকলেই নেতাদের দ্বারা প্রভাবিত হইবেন, এমন কল্পনাও কঠিন। দুর্নীতির ভয় হইতে ভয়ের ছায়া বড় হইয়া ওঠে নাই কি?
সন্দেহ হয়, শিক্ষকদের ঝুঁকি কমাইতে গিয়া শিক্ষার ঝুঁকির কথা শিক্ষক সংগঠনগুলি ভাবে নাই। স্কুলশিক্ষার মানের যে ছবি ক্রমাগত স্পষ্ট হইতেছে, তাহা ভয়াবহ। যে কোনও শ্রেণির এক-চতুর্থাংশ হইতে এক-তৃতীয়াংশ পড়ুয়া সেই শ্রেণির উপযোগী দক্ষতা অর্জন করিতে পারে নাই। বহু ছাত্রছাত্রী পর পর অনেকগুলি বৎসর স্কুলে বসিয়া থাকিয়াও লিখিতে-পড়িতে, অঙ্ক করিতে শিখে নাই। পূর্বে শিক্ষকের অভাব, স্কুলের স্বল্পতা, পরিকাঠামোর দুর্বলতা, শিক্ষার প্রতি দরিদ্র পরিবারের অনাগ্রহ, এমন নানা কারণ দেখাইতেন শিক্ষকেরা। কিন্তু শিক্ষক-ছাত্র অনুপাত এখন যথাযথ, স্কুল ও শ্রেণিকক্ষ প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল নহে। শিক্ষকের ঘাটতি কিছু আছে, কিন্তু তাহা প্রধানত শিক্ষকের পদপূরণে অসমতার ফল। ছাত্রকল্যাণে বিভিন্ন প্রকল্প বহু দরিদ্র ছাত্রকে স্কুলমুখী করিয়াছে। দরিদ্র পরিবারও শিক্ষায় আগ্রহী। তৎসত্ত্বেও শিশুরা ব্যর্থ কেন? তাহাতে স্কুল ও শিক্ষকের কোনও ভূমিকাই কি নাই? কোথায় ত্রুটি, কতটা ত্রুটি, তাহা না বুঝিলে ছাত্রদের ফেল করাইয়া শিক্ষকের কাজ শেষ হইবে।
সত্য এই যে, শিক্ষকের মূল্যায়নের কোনও পদ্ধতিই কাজ করিতেছে না। স্কুলশিক্ষার ভালমন্দ বিচারের প্রধান সরকারি পদ্ধতি, স্কুল পরিদর্শকের রিপোর্ট। কিন্তু পরিদর্শকের স্বল্পতায় পরিদর্শন অনিয়মিত হইতে হইতে প্রায় বন্ধ হইয়াছে। বরং শিক্ষক সংগঠনগুলির চাপে পরিদর্শকেরা নিধিরাম সর্দারে পরিণত হইয়াছেন। শিক্ষকদের কাজের কোনও বার্ষিক রিপোর্টও তৈরি করিবার নিয়ম নাই। অপর দিকে, শিক্ষার অধিকার আইন মানিয়া স্কুল পরিচালন কমিটি এ রাজ্যে গঠিত হয় নাই, ফলে স্কুলের কাজে নজরদারি ও মূল্যায়নের এই উপায়টিও নিষ্ক্রিয় হইয়া আছে। এই পরিস্থিতিতে অভিভাবকদের দ্বারা মূল্যায়ন চালু করিয়া বস্তুত ‘কানা মামা’ আমদানি করিতে চায় রাজ্য। তাহাতেও আপত্তি তুলিয়াছেন শিক্ষকেরা। শিক্ষণীয় বটে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy