Advertisement
E-Paper

জোর করে যদি একবার হেঁটে যেতে, বেঁচে নিতে যদি একবার বড় ভাল হত!

ধর্ষণ-খুনের পরিবেশ খুব চেনা ছবি এ দেশে। সে ছবির ভয়ই তাড়া করে বেড়ায় জীবনভর। লিখছেন রচনা মজুমদারঅনেক কিছুর আগল পড়ল পায়ে। বিট্টু, আকাশ, পাপাইদের সঙ্গে মেলামেশা কমাতে বলা হল। জেঠু বাড়িতে এলে হাঁটু ঢাকতে হল। মাস্টারমশাইয়ের বদলে দিদিমণিরা এলেন। কেন? সে প্রশ্ন করিনি কখনও। কী করে করব? তখন যে ‘ছেলেমানুষ’ থেকে ‘মেয়েমানুষ’ হয়ে গিয়েছি।

শেষ আপডেট: ১৪ ডিসেম্বর ২০১৯ ০৯:০৭

মনে আছে, বেশ ছোটবেলায় বাথরুম যাওয়ার আগে মাকে বলতাম, ‘দাঁড়াবে? ভয় করছে!’ একটু যখন বড়, খেলে ফিরতে ফিরতে সন্ধে হয়ে গেলেও একই কথা বলতাম। বাবাকে— ‘ভয় করছে! গলির মোড়টায় দাঁড়াবে?’ কোথাও একটা জানতাম, দু’টো ভয় এক নয়। আর কী অদ্ভুত ভাবে দু’টো ভয় কাটানোর লোকও আলাদা।

একটার পর একটা বছর পেরতে লাগল। কত কী বদলে গেল! কিন্তু ভয়টা আর পাল্টালো না। কমল না। বরং দিন দিন কুঁকড়ে যাওয়াটা বাড়তে থাকল। যত বয়স বাড়ল, টেপ জামা ছেড়ে ফ্রক, ফ্রক থেকে সালোয়ারে পৌঁছলাম, তত নিজেকে গুটোতে থাকলাম। অনেক কিছুর আগল পড়ল পায়ে। বিট্টু, আকাশ, পাপাইদের সঙ্গে মেলামেশা কমাতে বলা হল। জেঠু বাড়িতে এলে হাঁটু ঢাকতে হল। মাস্টারমশাইয়ের বদলে দিদিমণিরা এলেন। কেন? সে প্রশ্ন করিনি কখনও। কী করে করব? তখন যে ‘ছেলেমানুষ’ থেকে ‘মেয়েমানুষ’ হয়ে গিয়েছি।

একটা ছোট্ট ঘটনার কথা বেশ মনে পড়ে। প্রথম বার অটো করে স্কুলে যাব। একা। নিজেকে বেশ বড় ভাবতে শুরু করেছি। হাতে টাকার ব্যাগ। একা একা ভাড়া দেব। অটোয় উঠলাম। জায়গা হল অটোর সামনে। চালকের পাশে। আমার ভাল লাগছিল না। যত বার অটোটা মোড় ঘুরছিল, চালকের হাত ঘুরছিল, আমার অস্বস্তি হচ্ছিল। স্কুলে গিয়ে কেঁদেছিলাম। ছোটবেলায় মুরগি কাটা দেখে যতটা কাঁদতাম, তার চেয়েও বেশি। মাথায় হাত বুলিয়ে এক বন্ধু বলেছিল, ‘ওরকম হয়। আমারও হয়েছিল একবার, বাসে। শুনবি?’ সেই শোনার তালিকাটা আস্তে আস্তে কত লম্বা হয়ে গিয়েছিল! গোটা টিফিন জুড়ে কত গল্প, কুঁকড়ে থাকার। বাড়ি ফিরে মাকে না বলে জেঠিমাকে বলেছিলাম। শুনে তাঁর উত্তর ছিল, ‘তোকে অটোর সামনে কে বসতে বলেছিল?’ এর পাশাপাশিই জারি হয়ে গিয়েছিল লম্বা ফতোয়া— স্যর পড়াতে এলে মা বসে থাকবে। যে ব্যাচে ছেলেরা থাকবে, সেখানে ওড়না ‘মাস্ট’। জামা যত সম্ভব ঢিলা, তা না হলে ‘যা হয়েছে, তা আবার হবে’।

শুনিনি কথা। আর জোর গলায় বলতেও পারব না যে, ‘কিছুই হয়নি’। বারবার হয়েছে। আমার ‘অসভ্যতামি’র শাস্তি দেওয়া হয়েছে বারবার। কিন্তু আমি কখনও কাউকেই শায়েস্তা করতে পারিনি। বাড়ি ফিরে যেদিন দেখতাম ‘সীতা অউর গীতা’ হচ্ছে, সেদিনই বসতাম টিভির সামনে। দেখতে ভারী ভাল লাগত। একটা মেয়ে সকলকে শায়েস্তা করছে। আমিও বেশ পারতাম! কিন্তু পারিনি। খালি অসহায়ের মতো নীরব দর্শক হয়ে দেখে গিয়েছি। মনে হয়েছে, এতটা তো আমার সঙ্গে হয়নি। বাড়ি ফিরে কম্বলটা মাথা অবধি টেনে নিয়েছি। কিছু দেখতে পেলে পাছে প্রতিবাদ করতে হয়। প্রতিবাদ করলে যদি আমার সঙ্গেও হয়। আমি চুপ করে থেকেছি। শীতের বেলা ছোট হয়ে এসেছে। আমি চুপ থেকেছি। আমাদের চাঁপাগাছে ফুল এসেছে। আমি চুপ করে থেকেছি। আমাদের কাজের পিসির কপালে কালশিটে দেখেছি। আমি চুপ করে থেকেছি। পাড়ার বউদিকে মার খেতে দেখেছি। আমি চুপ করে থেকেছি। রাস্তাঘাটে বারবার অপমানিত হয়েছি। আমি চুপ করে থেকেছি। রিলিজ় করেছে ‘মরদানি’, ‘আকিরা’। আমি চুপ করে থেকেছি। আবার পাখিরা এক সঙ্গে ডেকেছে, আবার সকাল হয়েছে, আমি চুপ করে থেকেছি। আমার মনে হয়েছে আমাকেও যদি একটা রক্তে ভাসা সাদা বিছানায় থাকতে হয়? মনে হয়েছে আমাকেও যদি অভিনয় করে দেখাতে হয়, কী কী হয়েছে? মনে হয়েছে, আমার বাবাকেও যদি জেলে পুড়ে দেওয়া হয়? মনে হয়েছে, আমিও যদি মরে যাই?
আমি এখনও একই রকম চুপ। ন’মাসের শিশুকে ধর্ষণ করা হয়েছে। আমি মুখ বন্ধ করে রেখেছি। কোথাও মেয়েদের জ্যান্ত পোড়ানো হয়েছে, কোথাও গাড়ির চাকায় পিষে দেওয়া হয়েছে, কোথাও শরীর এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিয়েছে রড। আমি চুপ করে থেকেছি। শুয়ে শুয়ে কাটিয়ে দিয়েছি একের পর এক রাত। কোথাও ছাত্রীকে জোর করে ‘পর্ন’ দেখিয়েছে শিক্ষক। আমি চুপ করে থেকেছি, ভেবেছি ‘সামান্য’ই তো। কোথাও প্রতি রাতে ‘স্বামীজি’র থাবার শিকার হয়েছে মেয়েটি। আমি চুপ করে থেকেছি। ভেবেছি যাক, বেঁচে তো আছে। কেউ নাইটক্লাবে ধর্ষিত হয়েছে, আমি রাতে বেরনো বন্ধ করেছি। কাউকে ছুড়ে ফেলা হয়েছে বাস থেকে, আমি ট্রেন ধরেছি। শুনেছি, কেউ টাইট জামা পরার জন্য ধর্ষিত হয়েছে, আমি জামাটা ঠিক করে নিয়েছি বারবার। সদ্যোজাতকেও বাদ দেয়নি ওরা। তখন ভেবেছি, দরকার কী ‘মা’ ডাক শোনার। তার চেয়ে নেটফ্লিক্সে ‘দিল্লি ক্রাইমস’ দেখি।। এ দিকে বিচার পেতে বছরে পর বছর কেটে যাক, রাতারাতি এনকাউন্টার হয়ে যাক, ‘বাবাজি’রা দন্ত বিকশিত করে থাকুক, ‘কী উচিত’ আর ‘কী উচিত নয়’ ভাবতে ভাবতে আমরা পার করে দিই বছরগুলো। খুঁজতে থাকি ‘সঙ্কটদুঃখত্রাতা’। ততদিন অবিশ্বাস করতে থাকি বাবা, ভাই, বন্ধু, প্রেমিক সকলকে। আমার আবারও ভয় করছে, কোনওদিন আমার মাকে কেউ টিভিতে বলতে শুনবে না তো, ‘আমার মেয়েটা কবে বিচার পাবে?’ সেদিনও অবশ্য চুপই থাকব।
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)

Abusement Atrocities Women
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy