Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

স্বপ্নের ভাল বাসার জন্য পা ফেলুন ভেবেচিন্তে

ফ্ল্যাটে ঢুকেও ভোগান্তির শেষ নেই। দেখা গিয়েছে, লিফট চলছে না, নেই জেনারেটর। এমনও ঘটেছে যে, ফ্ল্যাট অসম্পূর্ণ রেখে প্রোমোটারই নিখোঁজ হয়ে গিয়েছেন। লিখছেন অভিজিৎ রায়ফ্ল্যাটে ঢুকেও ভোগান্তির শেষ নেই। দেখা গিয়েছে, লিফট চলছে না, নেই জেনারেটর। এমনও ঘটেছে যে, ফ্ল্যাট অসম্পূর্ণ রেখে প্রোমোটারই নিখোঁজ হয়ে গিয়েছেন।

শেষ আপডেট: ০৫ মার্চ ২০১৯ ০১:৪৮
Share: Save:

মধ্যবিত্ত বাঙালির এক জীবনে একটা বাড়ি বা নিদেনপক্ষে একটা দু-কামরার ফ্ল্যাট নিজ মালিকানায় আয়ত্ত করে উঠতে না পারলে জীবনের অন্য সাফল্যগুলোও ব্যর্থতার তালিকায় চলে আসে। বহরমপুরের মতো মফস্সল শহরের ক্ষেত্রেও এখন বাড়ি করাটা মধ্যবিত্ত বাঙালির পক্ষে প্রায় অসম্ভব। মূল শহরের ভিতরে জমির দাম কাঠা পিছু বারো-চোদ্দো লক্ষ টাকা। কাজেই কাজ চালানোর মতো একটা ছোট বাড়ি করে উঠতে খুব কম করেও ৪০-৪৫ লক্ষ টাকার প্রয়োজন। মধ্যবিত্ত বাঙালির চাকরি নির্ভর আয়ে এত বড় স্বপ্নের ইএমআই জোগানো একেবারেই অসম্ভব। কাজেই একটু একটু করে এই মধ্যবিত্তেরা ঝুঁকলেন ফ্ল্যাটের দিকে।

বহরমপুরে এই ঝোঁকের বাড়াবাড়ি শুরু হল ২০০৯ সালের শুরু থেকে। মানুষের এই চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে ক্রমশ প্রোমোটার তথা ডেভেলপারের সংখ্যাও বাড়তে থাকল। ২০০৯ সালের প্রথম দিকে বহরমপুরের প্রাইম লোকেশানে যেখানে ফ্ল্যাটের দাম ছিল ৮০০ থেকে ৯০০ টাকা বর্গফুট, সেখানেই ২০১৩ সালের প্রথম দিকে দাম গিয়ে দাঁড়াল ২৫০০ থেকে তিন হাজার টাকা বর্গফুট। দাম যত বাড়তে থাকল সাধারণ মানুষও ততই ফ্ল্যাট কেনার দিকে ঝুঁকলেন। কিছুটা প্রয়োজনে, কিছুটা স্বপ্ন হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার ভয়ে, আর কিছুটা বিনিয়োগের চূড়ান্ত রিটার্নের আশায়। প্রোমোটারেরাও একটা ফ্ল্যাট শেষ না করেই অন্য ফ্ল্যাটের জন্য জমি সংগ্রহে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।

ধরা যাক, কোনও প্রোমোটার ২০১১ সালের প্রথম দিকে একটি ফ্ল্যাট তৈরির কাজ শুরু করেছেন। তখন ফ্ল্যাটের বাজারের বাড়বাড়ন্ত। কাজেই ঝটপট বুকিংয়ে তাঁর হাতে বেশ কিছু টাকা চলে এল। সেই টাকা দিয়ে নতুন জমি কিনে রাখলেন। আপনি আপনার কষ্টার্জিত সঞ্চয় থেকে প্রোমোটারকে আপনার ফ্ল্যাটের বুকিং অ্যামাউন্ট দিয়ে দিয়েছেন। তার পরে ব্যাঙ্কের কাছে ঋণের জন্য আবেদনও করে দিয়েছেন।

ফ্ল্যাটটি আবেদনের সময় প্রোমোটার আপনাকে যে নিয়মে টাকা পরিশোধ করতে বলেছেন তা অনেকটা এই রকম— আবেদনের সময় ২০ শতাংশ, প্রতিটি ছাদ ঢালাইয়ের সময় ১০ শতাংশ করে এবং রেজিস্ট্রির সময় ২০ শতাংশ। ফ্ল্যাট আপনার কাছে ফাঁদ হয়ে পড়ল এখানেই। প্রোমোটার ছ’তলা বাড়ির ছাদ ঢালাইয়ের কাজগুলো খুব তাড়াতাড়ি সম্পূর্ণ করে আপনার অথবা আপনার ব্যাঙ্কের কাছ থেকে ফ্ল্যাটের মোট মূল্যের ৮০ শতাংশ পকেটস্থ করে ফেলেছেন।

এ বার আপনার ফ্ল্যাটটি সম্পূর্ণ করার টাকা প্রোমোটারের কাছে তখনই আসবে যখন তাঁর নতুন জায়গায় নতুন ফ্ল্যাটটি আপনার মতো কেউ কেউ বুক করবেন। এ ভাবেই ২০০৯ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ভালই কাটছিল বহরমপুর শহরের প্রোমোটারদের। ২০১৩ সালের এপ্রিল মাসের পরে সারদা কাণ্ডের জেরে রাজ্যের অন্য শহরের মতো সমস্যা দেখা দিল বহরমপুরেও।

এ রাজ্যের চাকুরিজীবীদের জন্য অন্য সমস্যাও আছে। নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের বাজারদর গত তিন বছরে ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ বেড়ে গেলেও মাইনে বেড়েছে মাত্র ১০ শতাংশ। প্রতিদিনের জীবনযাপন পূর্ণ করার পরে স্বপ্নের ফ্ল্যাট কেনার বুকিংয়ের টাকা জোগানো যেমন মুশকিল হয়ে পড়ল, তেমনই মুশকিল হয়ে পড়ল গৃহ-ঋণের ইএমআই মেটানো। নতুন নতুন জমিতে নতুন ফ্ল্যাটগুলি অবিক্রিত অবস্থায় মাথা তুলতে থাকল। ও দিকে যিনি ২০১১ সালে ফ্ল্যাট বুকিং করেছিলেন এবং ব্যাঙ্ক যাঁকে ঋণ দিয়ে ফেলেছে তাঁর নাভিশ্বাস ওঠার জোগাড়। এক দিকে, তিনি বাড়িভাড়া মেটাচ্ছেন, অন্য দিকে ব্যাঙ্কের ইএমআই গুনছেন।

১৮ থেকে ২৮ মাসের মধ্যে ফ্ল্যাট হস্তান্তরের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন প্রোমোটার। আপনিও শর্ত অনুযায়ী সমস্ত টাকা সঠিক সময়ে দিলেও বেশিরভাগ প্রোমোটারের পক্ষ থেকে শর্ত লঙ্ঘিত হয়েছে। কেউ কেউ কিছু সুবিধা বাদ দিয়ে ফ্ল্যাটে ঢুকে পড়লেও ভোগান্তিতে পড়েছেন। দেখা গিয়েছে, লিফট চালু হয়নি কিংবা জেনারেটর বসেনি। এমন ঘটনাও ঘটেছে যে, ফ্ল্যাট অসম্পূর্ণ রেখে প্রোমোটারই নিখোঁজ হয়ে গিয়েছেন।

সুখের চেয়ে শান্তি ভাল— গুরুজনদের এই প্রবাদটি মনে রেখে ফ্ল্যাটের ক্রেতাদের এই বিষয়গুলো খেয়াল রাখাটা জরুরি। আপনি বলতেই পারেন, এত কিছু জেনে আপনার লাভ কী? আপনি তো শুধু একটি স্বপ্নের বাসা কিনতে চেয়েছেন!

কেন্দ্র সরকার যেখানে বলছে, কার্পেট এরিয়ার মাপেই ফ্ল্যাট বেচতে হবে সেখানে রাজ্য সরকার তাদের রেজিস্ট্রেশন পদ্ধতিতে দু’রকমের মাপকেই স্বীকৃতি দিয়েছে। বহরমপুরের ক্ষেত্রে বেশিরভাগ অঞ্চলে এখন যদি ২৫০০ টাকা প্রতি বর্গফুট রেজিস্ট্রেশন ভ্যালু হয় তবে কার্পেট এরিয়া হিসাবে রেজিস্ট্রেশন করতে গেলে সরকার দাম ধরবে ৩৩০০ টাকার মতো। এক্ষেত্রে মধ্যবিত্ত ক্রেতা বিচলিত না হয়ে কার্পেট এরিয়া হিসাবেই রেজিস্ট্রি করালে কিছু সুবিধা পাবেন বইকি! এ ভাবেই মধ্যবিত্তকে সব দিক যাচাই করে ফ্ল্যাট কিনতে হবে। আর, বিনিয়োগ করে ফেলে রাখার মতো রিটার্ন অদূর ভবিষ্যতে ফ্ল্যাটবাড়ি দেবে বলে মনে হয় না।

সেক্ষেত্রে বহরমপুরের বাড়তি দোকানের চাহিদার কথা মাথায় রেখে মধ্যবিত্ত কিছু দোকানঘর কিনে রাখতে পারেন। তা ছাড়া পশ্চিমবঙ্গের কর্মসংস্থানের যে করুণ অবস্থা তাতে ছেলেমেয়েরা চাকরি না পেলে ভবিষ্যতে ছোট, বড়ো ব্যবসা করেও কিছু না কিছু ভাবে নিজেদের গ্রাসাচ্ছদন করে নিতে পারবে।

তা ছাড়া যে কোনও ভাড়ার সুবিধা তো রয়েইছে। ফ্ল্যাটের ক্ষেত্রে কিন্তু ভাড়া পাওয়াও এখন আর খুব বেশি সহজ হচ্ছে না। সব মিলিয়ে যেটা বলা যেতে পারে বহরমপুরের ফ্ল্যাটের বাজার এখনও ঢিলে।

এই অবস্থায় স্বপ্নের বাসা কেনার জন্য তাড়াহুড়ো না করে একটু থেমে পা ফেলুন। নিজেকে ইএমআই দেওয়ার জন্য তৈরি করুন ধীরে ধীরে। আর খুঁজতে থাকুন আরও কম টাকায় আরও ভাল কোনও ফ্ল্যাট আপনি পেতে পারেন বাজেটের মধ্যে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Flat Murshidabad
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE