বিশ্বকাপ ফুটবল শেষ হইতে আর মাত্র কয়েক দিন। অভিজ্ঞ বাঙালি জানিয়া আসিয়াছে— উত্তেজনার পারদ চড়িতে চড়িতে এই শেষ লগ্নে চরমে উঠিবে, অন্তিম সপ্তাহের দিনগুলিতে বাঙালি সব কিছু ভুলিয়া তাহার প্রিয় দেশ এবং প্রিয় তারকাদের লইয়া মশগুল থাকিবে, কেহ কোনও কাজের কথা বলিতে আসিলে উচ্চাঙ্গের ঔদাসীন্যে শুনাইয়া দিবে: ফাইনালের পরে আসিবেন। কিন্তু ২০১৮-য় বাঙালির সেই মহান ঐতিহ্যে গ্রহণ লাগিয়াছে। বিশ্বকাপ ফুটবলের মাহেন্দ্রক্ষণে তাহার আকাশচুম্বী উন্মাদনা অদৃশ্য, অতলস্পর্শী আবেগ বিলুপ্ত। এমনকি সে নাকি এই সপ্তাহেও কাজ করিতেছে! তাহার এই অবাঙালি স্থিতপ্রজ্ঞতার কারণ: শেষ সপ্তাহে তাহার হৃদয়বল্লভ ব্রাজ়িল আর্জেন্টিনা নাই, তাহার তিকিতাকা-স্পেন নাই, এমনকি তাহার মহাবীর জার্মানিও নাই। যাহারা আছে তাহাদের খেলা ভাল হইতে পারে, কিন্তু তাহাদের লইয়া হৃদয়ে এবং চায়ের পেয়ালায় তুফান উঠে না। বাঙালির ভাগ্যাকাশে, অতএব, লন্ডনের ম্লানিমা।
অপার বিষাদে বাঙালি দু’দণ্ড চুপ করিয়াছে, এই সুযোগে একটি পুরাতন প্রশ্ন পেশ করা যায়। বাঙালি যদি এমনই খেলাপাগল, তবে খেলার দুনিয়ায় সে এমন দুর্লভ কেন? যে ফুটবলের জন্য তাহার এত হাসি ও কান্না, এত জ্ঞান ও গরিমা, এত ইলিশ ও চিংড়ি, সেই ফুটবলের বিশ্বে, এমনকি ফুটবলের ভারতেও তাহার অতীতে দুই বা চারি আনা গৌরব ছিল, আজ এক আনাও নাই, কেন? ক্রিকেটার সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়কে লইয়াই এক শতাব্দী পার করিয়া দিতে হইবে? দুই এক জন দীপা কর্মকার, অনির্বাণ লাহিড়ী, ইতি গজ? বাঙালি পারে না কেন? অনুপস্থিত পরিকাঠামো নিশ্চয়ই একটি বড় কারণ। অ্যাকাডেমি, প্রশিক্ষণ, সরঞ্জাম ইত্যাদির কথা ছাড়িয়াই দেওয়া গেল, পাড়ায় পাড়ায় মাঠগুলিও দ্রুত বিলীয়মান। নিয়মিত খেলিবার জায়গা যদি শিশুরা না পায়, খেলায় আগ্রহ তৈয়ারি হইবে কী রূপে? বাঙালি শিশু কিশোর তরুণেরা এখন মাঠে যায় না, তাহার যাবতীয় নড়াচড়া মোবাইল টেলিফোনের পর্দায়। জলে না নামিলে সাঁতার শেখা সম্ভব নহে, ফুটবলে লাথি না মারিলে ফুটবল খেলা যায় না।
কিন্তু খেলিতে চাহিলে বাঁকা উঠানেও পরিকাঠামো তৈয়ারি করা যায়। বাঙালি খেলিতে চাহে না। খেলাকে সে দেখে ভোগের সামগ্রী হিসাবে। সে অতি উত্তম উপভোক্তা। গণপিটুনি হইতে সিনেমা, আম উৎসব হইতে বিশ্বকাপ ফুটবল, সব কিছুই উপভোগ করিতে ভালবাসে। টেলিভিশনের পর্দায় খেলা দেখিয়া আমোদ করিতে ও বড় বড় কথা বলিতে সে অক্লান্ত। এবং, গাড়ি হইতে জামাকাপড়, ঘড়ি হইতে ফুটবল দল বা তারকা— সব বিষয়েই সে এখন বিখ্যাত ব্র্যান্ডের ভক্ত। নিজেদের ব্র্যান্ড নিজেরা তৈয়ারি করিব— সেই আকাঙ্ক্ষা বাঙালির নাই, কারণ তাহার জন্য কঠোর পরিশ্রম করিতে হয়। সুতরাং সে হাতে-গরম বিশ্ব-ব্র্যান্ডগুলিকে আপন করিয়া লয়। বিশ্ব জুড়িয়া তাহার জন্য ব্র্যান্ডগুলি থরে থরে সাজানো— বাঙালির মেসি, বাঙালির নেমার, বাঙালির হ্যারি কেন। তাঁহাদের অবশ্য খেলিতে হয়, পরিশ্রম করিতে হয়। এবং যথেষ্ট ভাল না খেলিলে মহার্ঘতম ব্র্যান্ডকেও বিদায় লইতে হয়। বাঙালির সম্বল তখন কান্না। দর্শকের কান্না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy