Advertisement
E-Paper

বিশ্ববাংলা, নামমাত্র

প্রাথমিক ধাক্কার পরেও কথাটা কি শুধুমাত্র একটি শব্দবন্ধ হয়েই থাকবে, যাকে এই অতি দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বে আমাদের শিকড়-জীবনের সঙ্গে মেলানো শক্ত?

চিন্ময় গুহ

শেষ আপডেট: ২২ অক্টোবর ২০১৭ ০০:২২
প্যারিস: পুরনো দিনের। সেখানেও পৃথিবী এসে তোমার সঙ্গে কথা বলে যেত। তৈলচিত্র

প্যারিস: পুরনো দিনের। সেখানেও পৃথিবী এসে তোমার সঙ্গে কথা বলে যেত। তৈলচিত্র

আমার কানে, স্বীকার করতে বাধা নেই, ‘বিশ্ববাংলা’ শব্দটি বীণার ঝংকারের মতো বাজে। বাঙালি তো সেই উনিশ শতকে সারা বিশ্ব থেকে রস টেনে বিকশিত হতে চেয়েছিল। আমাদের প্রিয় মানুষেরা অনেকেই প্রকৃত অর্থে বিশ্ববাঙালি, এই শব্দবন্ধ তাই আমাদের ধাক্কা দেয়। আমার মনে হয় এই ধাক্কাটার (কারও কারও কাছে বিরক্তির) দরকার ছিল। এক জন নিছক সাধারণ অ-রাজনৈতিক মানুষ হিসেবে বলি, ছোট গর্ত থেকে বেরিয়ে এক বিরাট আকাশের নীচে পৌঁছনোর হয়তো সময় হয়েছে।

এখন প্রশ্ন হল, প্রাথমিক ধাক্কার পরেও কথাটা কি শুধুমাত্র একটি শব্দবন্ধ হয়েই থাকবে, যাকে এই অতি দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বে আমাদের শিকড়-জীবনের সঙ্গে মেলানো শক্ত? বিশ্ববীণারবে বেজে ওঠা তো সহজ নয়। ‘শরীরে মমির ঘ্রাণ আমাদের’, লিখেছিলেন জীবনানন্দ। অষ্টোত্তর শত নামেও আমাদের শরীরে মমির ঘ্রাণ ঘুচবে না, শব্দগুলি মরা শালিখের মতো পড়ে থাকবে, যত ক্ষণ না আমরা নিজেদের মনের বজ্র-কঠিন আঁট খুলে ফেলতে পারি। সেটা শক্ত কাজ, এখুনি হবে বলে মনে করলে মূর্খতা হবে। কিন্তু কিছু অন্য রকম উদ্যোগ নিলে কেমন হয়?

সে পরীক্ষাটা কলকাতাতেই শুরু হতে পারে। ধরা যাক, আমরা অতি তুচ্ছ সাধারণ মানুষ যদি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেদের জিগ্যেস করি, আমরা কতটা বিশ্বনাগরিক? রামমোহন, ডিরোজিয়ো থেকে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ থেকে স্বামী বিবেকানন্দ বা জগদীশচন্দ্রের দেশে আলোকপ্রাপ্তির কী প্রমাণ আমরা দিয়েছি? বিদেশ তো দূরের কথা, পার্শ্ববর্তী রাজ্যের শ্রেষ্ঠ প্রতিভাকেও আমরা কি গ্রাহ্য করি? আমরা কি ফণীশ্বরনাথ রেণুর নাম শুনেছি? একটি গল্প বলি। প্যারিসে আঠারো শতকের বিশিষ্ট দার্শনিক দ্যনি দিদেরো-র নামাঙ্কিত বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দিয়ে বেরিয়ে যে বড় রাস্তায় পড়লাম, তার নাম র‌্যু টোমাস মান, বা টোমাস মান সরণি। ‘ভেনিসে মৃত্যু’-র রচয়িতা জার্মান ঔপন্যাসিকের নামে! এবং সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারলাম বিশ্বফরাসি কাকে বলে। কিন্তু তাদের তকমার প্রয়োজন হয় না, বিশ্ব সেখানে চেতনায় গেছে মিশে।

কয়েক দশক আগে প্যারিসে পদার্পণ করেই একটি বিরাট হোর্ডিং দেখেছিলাম: ‘এখানে পৃথিবী তোমার সঙ্গে কথা বলছে, তুমি পৃথিবীর সঙ্গে কথা বলো।’ পরে বুঝেছি সেটা ছিল ‘ল্য মঁদ’ (পৃথিবী) কাগজের বিজ্ঞাপন। কিন্তু বিজ্ঞাপনকে অতিক্রম করে তা স্পর্শ করেছিল ফ্রান্সের স্নায়ুতট। সে দেশে চার পাশে তার অবিশ্বাস্য সব চিহ্ন। গোটা প্যারিস জুড়ে রাস্তার নাম যেমন আছে ফরাসি সাহিত্যিক মঁতেইন, মলিয়ের, এমিল জোলা, গিয়োম আপোলিনের বা চিন্তক ফুকোর নামে, আছেন ফরাসি দার্শনিক দেকার্ত বা পাসকাল। আছেন অঙ্কবিদরা, তারই পাশে আলেকসাঁদ্‌র্‌ দ্যুমা বা আনাতোল ফ্রাঁস। তারই পাশাপাশি মাথা উঁচু করে আছেন দান্তে, গালিলেয়ো এবং নিউটন, আর লেয়োনার্দো দা ভিঞ্চি। আছেন সিগমুন্ড ফ্রয়েড। একটা জাতি কীভাবে অন্তর থেকে আন্তর্জাতিক হয়ে ওঠে, তা বোঝা যায়।

রাস্তা প্যারিসের, কিন্তু প্যারিস তো পৃথিবীর নাম। ফরাসিরা আমেরিকানদের খুব একটা পছন্দ করে বলে শুনিনি, কিন্তু তাই বলে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের ঐতিহ্যকে সম্মান জানাতে পারব না কেন? ফলে তারা একটি বৃহৎ রাস্তা-সংগমস্থলের নাম প্লাস দে জেতাজ্যুনি (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্থান) দিতে দ্বিধা করেনি। লিংকন, উইলসন বা কেনেডির নামে রাস্তা, ফ্রাংকলিন রুজভেল্টের নামে মেট্রো স্টেশন। ঠিক তেমনই আছে প্লাস দিতালি (ইটালির স্থান)। বেঠোফেন সরণি দিয়ে হাঁটার সময় মনে মনে মহান জার্মান সংগীতকারকে জগৎপারাবারের তীরে ছড়িয়ে পড়তে শুনেছি।

প্যারিসে যে পার্কে রবিবার সকালে পুরনো বই কিনতে ছুটেছি, সেটির নাম আধুনিক যুগের বিশিষ্ট গায়ক জর্জ ব্রাসাঁস-এর নামে উৎসর্গীকৃত। মেট্রো স্টেশনের নাম ভলতের, আলেকসাঁদ্‌র্‌ দ্যুমা, বোবিন্যি-পাবলো পিকাসো। যা কিছু গতানুগতিক তাকে পরিহার করে ফরাসিরা সর্বদাই অভিনবত্ব খুঁজেছে। আইফেল টাওয়ারের মেট্রো স্টেশনটির নাম (আরবি উচ্চারণে) ‘বীর হাকিম’; লিবিয়ার মরুভূমিকে সেখানে এনে ফেলতে ফরাসি বিশ্বনাগরিকের কোনও অসুবিধে হয়নি। একটি মেট্রো স্টেশনের নাম চোদ্দো শতকের বিপ্লবী ও প্রোভস্ট— এতিয়েন মার্সেল (১৩০২/১০-১৩৫৮)। অথবা উনিশ শতকে সমাজবাদী পার্টির গঠনের পেছনে যাঁর মননশীল অবদান সবচেয়ে বেশি সেই লুই ব্লাঁ। একটি প্রধান রাস্তার নাম বুলভার ওসমান, উনিশ শতকের স্থপতি ও ইঞ্জিনিয়ার জর্জ-য়্যজেন ওসমান-এর (Haussemann) নামে, যিনি তৃতীয় নেপোলিয়নের সময় প্যারিসের রাস্তাঘাট, পার্কের আমূল পুনর্নির্মাণ করে আধুনিক রূপ দেন। শুধু প্যারিসের চতুর্দশ পরগনা নয়, ফ্রান্সের একরত্তি ছোট শহর গ্রেৎস-এ রম্যাঁ রলাঁকে দেখে বিমলানন্দ পেয়েছি। এক মুহূর্তের জন্যও মতবাদ সেখানে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি।

সব সময়ই এমন নামভারাক্রান্ত নয় অবশ্য। একটি স্টেশনের নাম ‘জুঁইফুল’! আর একটির নাম ‘সুখবর’! অথবা শুধুই ‘নক্ষত্র’, শাঁজেলিজে-র ওপর সেই ভুবনবিখ্যাত স্টেশন। কিংবা ‘পিরামিড’। একফোঁটা শিশিরবিন্দুর মতো, যার আয়নায় পৃথিবীকে দেখা। প্যারিসে পুস্তক বিপণির নাম আঁদ্রে জিদ-এর স্মরণে দেখেছি ‘শীর্ণ তোরণ’। ভেজলে শহরে দেখেছি রম্যাঁ রলাঁর উপন্যাসের থেকে ধার করা নাম ‘বিমুগ্ধ আত্মা’। (মনে হয়েছে, আমরা কেন অমন করে বইয়ের দোকানের নাম দিতে পারি না ‘নীল নির্জন’, ‘অবনী বাড়ি আছ’, ‘সাতটি তারার তিমির’!) একেই বলে প্রকৃত সৌন্দর্য-চেতনা ও নান্দনিক বোধ, যা আমাদের ভাষাবোধ ও ইতিহাসচেতনার মতোই গোলকায়নের অত্যাচারে দৈনন্দিন জীবন থেকে অদৃশ্য হতে বসেছে। সে দিক থেকে ‘নবান্ন’ নামটি আমার ভাল লাগে।

আমাদের আন্তর্জাতিকতা একেবারে নেই তা নয়, কিন্তু সেটা শেক্সপিয়র, কার্ল মার্ক্স, হো চি মিন আর লেনিন সরণিতেই সীমাবদ্ধ। এই যান্ত্রিকতা এক অনুভূতিহীন যান্ত্রিকতা। কী ভাগ্যে রনাল্ড রস আর লেবেদফ-এর নামেও রাস্তা আছে, চ্যাপলিনের নামে একটি প্রেক্ষাগৃহ ছিল, কিন্তু টোমাস মান-এ পৌঁছতে আমাদের কত শতাব্দী লাগবে জানি না। ক্ষুদিরাম অথবা সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের নামে স্টেশন হয়েছে, খুশি হওয়ার মতো খবর, কিন্তু আর একটু এগিয়ে নামগুলিকে বিশ্বজগতে ছড়িয়ে দিলে কেমন হয়? যেখানে মিশে যেতে পারে মেধা ও ভালবাসা।

আমি চোখ বন্ধ করে ভাবি, এমন হলে কেমন হত যদি ঘুম থেকে উঠে দেখতাম আমাদের এই বাংলায় স্টেশনের নাম ‘প্রবাসী’, মেনুহিন, আলাউদ্দীন, লালন ফকির, অ্যান্টনি কবিয়াল, ‘চোখের বালি’, রামকিংকর, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, সলিল চৌধুরী অথবা বিষ্ণু দে। কিংবা ফাদার দ্যতিয়েন। খিদিরপুর বন্দরের নাম ‘সোনার তরী’। ডাকঘরের নাম ‘পুনশ্চ’। নিউ মার্কেটের নাম, ফাদার দ্যতিয়েন যেমন ভেবেছিলেন, ‘বৌঠাকুরানীর হাট’। বাড়ির সামনের পার্কের নাম জীবনানন্দ। রাস্তার নাম তরু দত্ত বীথি। অগ্যুস্ত কঁৎ কিংবা তলস্তয় সরণি। অথবা প্রেমচন্দ, আর রম্যাঁ রলাঁ বীথিকা।

রবীন্দ্রভারতীতে থাকার সময় গিরিশ পার্ক স্টেশনের নাম দিতে চেয়েছিলাম ‘জোড়াসাঁকো’ (‘গিরিশ পার্ক-জোড়াসাঁকো’)। কর্তৃপক্ষ রাজি হলেও, পাঁচ বছর হতে চলল, এটুকুও করা সম্ভব হয়নি। অথচ জোড়াসাঁকোই তো আমাদের বিশ্বচেতনার অন্যতম সূতিকাগৃহ।

আসলে, যতই নাম দিই, আমাদের নিজেদের অন্তর যত ক্ষণ না সংকীর্ণতা-মুক্ত হচ্ছে, বিশ্বচরাচরে পৌঁছনো সহজ হবে না।

Biswa Bangla Universal
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy