প্রতিস্পর্ধী: গুজরাত নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর বিজয় ঘোষণার পরে ভোটগণনা কেন্দ্রের সামনে কংগ্রেসের সমর্থকরা। অমদাবাদ, ১৮ নভেম্বর। ছবি: পিটিআই
আত্মবিশ্বাস কি দু-এক ইঞ্চি কমে গেল? নতুবা লোকসভায় প্রধানমন্ত্রী নিজে হাজির থাকা সত্ত্বেও গুজরাত নির্বাচনী ফল নিয়ে মুখ খুলতে হল, এখন দলে অনেকটা অপাঙ্ক্তেয়, রাজনাথ সিংহকে বা কিছু পরে নির্মলা সীতারামন বা তার পরে নিতিন গডকড়ী-র মতো দ্বিতীয় সারির নেতাদের! বিকেলে অবশ্য সর্বাধিনায়কের প্রধান সেনাপতি সাংবাদিক সম্মেলনে পর পর ছ’বার গুজরাত মসনদ ধরে রাখার জন্য জনতাকে অশেষ ধন্যবাদও দিলেন, কিন্তু ‘১৫০+’ আসন পাওয়ার আস্ফালন কোথায় গেল? মনে হল, যেন কোনও মতে ম্যাজিক ফিগার (৯২ আসন) পার হয়ে রাজত্ব কায়েম করাটাই ভারতীয় জনতা পার্টির একমাত্র লক্ষ্য ছিল। সারা দিন টি-২০ ম্যাচের উত্তেজনার পর ৯৯-এ পৌঁছেই যেন মোদী-শাহ জুটির দিল খুশ হল— যেন এমনটাই হওয়ার ছিল!
অথচ, গুজরাত নির্বাচনের মাসছয়েক আগেও রাহুল গাঁধীর অতি বড় সমর্থকও ভাবেননি এই ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ নির্বাচনে কংগ্রেস বিজেপির মাইলখানেকের মধ্যেও থাকবে। পর পর তাঁর নেতৃত্বে নির্বাচনে ভরাডুবি, মাঝেমধ্যেই রাজনীতির অঙ্গন ছেড়ে অজ্ঞাতবাসে উধাও হওয়া, সনিয়া-পুত্রের রাজনৈতিক পরিপক্বতা ও ভবিষ্যৎ নিয়ে কংগ্রেসেরও অনেকেই সন্দিহান ছিলেন, আর বিপক্ষের লোকেদের বক্রোক্তিতে তথা সোশ্যাল মিডিয়ায় তো তিনি ক্রমাগত হাসির খোরাক হয়ে উঠছিলেন। কিন্তু আজ এই মুহূর্তে যে কংগ্রেস তার সহযোগীদের নিয়ে অতিপরাক্রান্ত বিজেপির প্রায় ঘাড়ের ওপর নিঃশ্বাস ফেলছে, তার পর দলের সদ্য-নিযুক্ত সভাপতিটির পরীক্ষায় ‘পাশ’ করা নিয়ে বোধহয় খুব সন্দেহ থাকবে না।
যদিও এই নির্বাচন রাহুল তথা কংগ্রেসের পক্ষে বড় সহজ ছিল না। মনে রাখতে হবে, একাদিক্রমে ২২ বছর ক্ষমতার বাইরে থেকে এবং ২০১৪-র পর বাকি সবাইকে ম্লান করে ভারতীয় রাজনীতিতে নরেন্দ্র মোদীর প্রবল উত্থানের অভিঘাতে গুজরাতে কংগ্রেসের সংগঠন বলতে প্রায় কিছু ছিল না। ২০১২-র বিধানসভায় ৬১টি আসন পেলেও পরবর্তী উপনির্বাচনগুলিতে আরও পাঁচটি আসন কংগ্রেস থেকে বিজেপি-র ঝুলিতে চলে যায়। শেষে, এই নির্বাচনের কিছু আগে শঙ্কর সিন বাঘেলা-র মতো একদা-বিজেপি-পরে-কংগ্রেস নেতার ১৩ জন কংগ্রেস বিধায়ককে নিয়ে ফের বিজেপিতে যোগদানে কংগ্রেসের কোমর ভেঙে গিয়েছিল। এই অবস্থায় মাঠে নেমে রাহুল গাঁধী ও কংগ্রেস যে ভাবে গুজরাতের পরিস্থিতি অনুধাবন করেছেন, যে যে রণকৌশল গ্রহণ করেছেন, তার সব ক’টিই অনেকটা এই সাফল্যের দিকে দলকে নিয়ে গিয়েছে।
সংক্ষেপে, গ্রাম-শহরের বিভাজন, কৃষকদের তীব্র অসন্তোষ, জিএসটি নিয়ে ছোট ব্যবসায়ীদের মহলে দারুণ ক্ষোভ এবং সর্বোপরি, সরকারি সংরক্ষণ নিয়ে পাতিদার/পটেল ও অনগ্রসর ক্ষত্রিয়দের আন্দোলন— এই সব কিছু হাতিয়ার করে রাহুল ময়দানে নেমেছিলেন। এবং এই সব ক’টিই ভোটারদের একটা বড় অংশের, বিশেষত তরুণদের মর্মভেদ করেছে। বিপরীতে, দীর্ঘ দিন ক্ষমতাসীন থাকায় অভ্যস্ত বিজেপি এই সব ক্ষোভের বিষয় পাত্তা তো দেয়ইনি, প্রবল আত্মবিশ্বাস ও অহংকারে সামাজিক অসন্তোষ বা কংগ্রেসের প্রশ্ন ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে ‘উন্নয়ন’-এর পুরনো রেকর্ড বাজিয়ে গেছে। যখন বুঝেছে তাতে খুব একটা কাজ হচ্ছে না, তখন তাদের সুপারস্টার প্রচারক নরেন্দ্র মোদীর কাঁধে ভর করে বৈতরণী পেরোতে চেয়েছে। গোটা নির্বাচনে মোদী ৩৪টি জনসভা করেছেন এবং ৪০টির মতো দলীয় কার্যকর্তাদের সভা করেছেন। মোদী ছাড়াও গুজরাত-বিজেপি যোগী আদিত্যনাথসহ আট জন মুখ্যমন্ত্রীদের ময়দানে নামিয়েছে। অমিত শাহ নিজে বড় জনসভা করেননি, কিন্তু প্রতিটি জেলার সাংগঠনিক বৈঠক করেছেন। এই ক’দিনে শাসক দলের এমন হাই-প্রোফাইল প্রচার বলে দেয়, গুজরাত বিজেপির কাছে কত মূল্যবান ছিল।
রাহুল গাঁধীও ৬৯টি মিটিং করেছেন। রাজস্থানের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী অশোক গহলৌত বা গুজরাত কংগ্রেসের প্রধান মুখ আহমেদ পটেলরাও করেছেন। কিন্তু তাঁরা তো ইংরেজিতে বললে ‘আন্ডারডগ’। তাই হাই-প্রোফাইল ও চমকদার (সি-প্লেন-বাহিত মোদীর প্রচারসহ) বিজেপির প্রচার ও সংগঠনের সঙ্গে তার তুলনা হয় না। এই ওজনদার প্রচারে অবশ্য বিজেপি তার তথাকথিত উন্নয়নের ‘মডেল’ নিয়ে বিশেষ রা কাড়েনি। সেই পুরনো বিভাজনের বাচন— কখনও পাকিস্তানের সঙ্গে গুজরাত নির্বাচনের অপ্রাসঙ্গিক ‘গল্প’, কখনও রাহুলকে ‘আওরঙ্গজেব’ বলা, কখনও বা কংগ্রেসের তিন তরুণ তুরকির (হার্দিক, অল্পেশ, জিগ্নেশ) নামের ইংরেজি আদ্যক্ষর নিয়ে ‘হজ’ বনাম বিজেপির ত্রয়ীর (মুখ্যমন্ত্রী রূপাণী, অমিত শাহ ও মোদী) নামের আদ্যক্ষর ‘রাম’-এর লড়াইয়ের কথা বলে গুজরাতি হিন্দু অস্মিতায় ঘা দিতে চেয়েছে। যদিও তাতে যে চিঁড়ে বেশি ভেজেনি, তা পশ্চিমে সৌরাষ্ট্র ও কচ্ছের কৃষিসমাজ ও উত্তরের পাতিদাররা স্পষ্ট করে দিয়েছেন। শাসক দল কতকটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারছে মধ্য ও দক্ষিণ গুজরাতের জন্য, বিশেষত এখানকার উন্নত শহরগুলির অধিবাসীদের কল্যাণে, যাঁরা নব্য উদারনীতি নিয়ন্ত্রিত উচ্চ মূল্যের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের পরিষেবা কিনতে সক্ষম।
নির্বাচন শেষে বিজেপির সেনাপতিরা হিমাচলপ্রদেশে কংগ্রেসকে হারানোর পাশে গুজরাতকে ধরে রাখার সাফল্য দাবি করবেন ঠিকই, তবে ঘরোয়া আত্মসমীক্ষণে অবশ্যই বুঝতে চাইবেন, এই নির্বাচনের বিশেষ তাৎপর্য। প্রথম থেকেই গুজরাতের বিধানসভার ভোট সবার নজর কেড়েছে, কারণ, অমদাবাদের ক্ষমতার সরণিই ২০১৪ সালে দিল্লির মসনদে পৌঁছেছিল। দ্বিতীয়ত, বিদ্বেষ+বিকাশের অনুপানে তৈরি মোদীনির্মিত গুজরাতি মডেলই হয়ে উঠেছিল সমগ্র ভারতের মডেল। তাই, মডেলের কেন্দ্রভূমিটিই টাল খেয়ে গেলে তার অভিঘাত জাতীয় রাজনীতিতে পড়বেই। অনেকেই বলছেন, রাহুলের চেয়েও মাটি কামড়ে পড়ে ছিলেন রাজস্থানের গহলৌত, অল্প কিছু দিনের মধ্যেই যে রাজস্থানে বিধানসভা ভোট, যেখানে জাঠদের সংরক্ষণের আন্দোলন তথা মুখ্যমন্ত্রী বসুন্ধরা রাজে-সরকারের দুর্নীতির বিষয় ইতিমধ্যেই বিজেপির কপালে ভাঁজ ফেলেছে। গুজরাতের প্রভাব যে রাজস্থানে কংগ্রেসের পক্ষে সুপবন বইয়ে আনতে পারে, এমন আশা কংগ্রেসিরা করতে শুরু করেছেন। তার পাশাপাশি মধ্যপ্রদেশ ও ছত্তীসগঢ়ের নির্বাচনও বিজেপির পক্ষে সহজ ওয়াকওভার হবে না। এর সঙ্গে যদি কর্নাটকে কংগ্রেস ক্ষমতা ধরে রাখতে পারে, তবে সভাপতি হিসেবে রাহুলের আত্মবিশ্বাস বাড়বে, ২০১৯-এর লোকসভার লড়াইও খুব একপেশে থাকবে না।
২০১৯ নির্বাচনের আগে গুজরাতের সামাজিক বিন্যাসের সমীকরণ যদি কংগ্রেস— উত্তরপ্রদেশ, বিহার, পশ্চিমবঙ্গ, ওডিশা, অন্ধ্র, তেলঙ্গানার মতো রাজ্যগুলির আঞ্চলিক দলগুলির সঙ্গে সাফল্যের সঙ্গে করতে পারে, তবে ভোটের ফলাফল ঠিক কী দাঁড়াবে, বলা শক্ত। তবে, উত্তরপ্রদেশে বিপুল জয়ে এ রাজ্যে বিজেপির যে ফানুস ফুলেছিল, গুজরাতের ফলে তা খানিকটা চুপসে যাবে নিশ্চয়ই!
বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy