Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
ক্ষমতা দখলে মরিয়া নেতাদের জলসঙ্কট নিয়ে ভাবার সময় নেই

এ বার ‘এক রাষ্ট্র এক দল’?

কী ভাবছেন? আমেরিকার সিলিকন ভ্যালিতে এমন কাণ্ড হতেই পারে না, না?

ঘোড়ারোগ: নিজেদের দলের বিধায়ক ‘ভাঙানো’র প্রতিবাদে বিজেপির বিরুদ্ধে কংগ্রেসের বিক্ষোভ, বেঙ্গালুরু, ১০ জুলাই। পিটিআই

ঘোড়ারোগ: নিজেদের দলের বিধায়ক ‘ভাঙানো’র প্রতিবাদে বিজেপির বিরুদ্ধে কংগ্রেসের বিক্ষোভ, বেঙ্গালুরু, ১০ জুলাই। পিটিআই

প্রেমাংশু চৌধুরী
শেষ আপডেট: ১৭ জুলাই ২০১৯ ০০:০৮
Share: Save:

আমেরিকার প্রেসিডেন্টের গদিতে রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। কিন্তু সিলিকন ভ্যালি যে প্রদেশে, সেই ক্যালিফর্নিয়ার গভর্নর ডেমোক্র্যাট পার্টির গ্যাভিন নিউজ়ম। ধরুন, ওয়াশিংটন থেকে ট্রাম্প সুদূর ক্যালিফর্নিয়ায় বিরোধীদের রাজত্ব মেনে নিতে পারছেন না। ডেমোক্র্যাট নেতাদের ভাঙিয়ে তিনি নিজের পক্ষে আনার চেষ্টা শুরু করলেন। দলছুট ডেমোক্র্যাটরা সে রাজ্যের অ্যাসেম্বলি থেকে পদত্যাগ করে অন্য শহরের হোটেলে আস্তানা নিলেন। বাকি নেতারা ট্রাম্পের কোপ থেকে বাঁচাতে রিসর্টে গিয়ে উঠলেন।

কী ভাবছেন? আমেরিকার সিলিকন ভ্যালিতে এমন কাণ্ড হতেই পারে না, না? ক্যালিফর্নিয়া জুড়ে, বিশেষত সিলিকন ভ্যালিতে এমন রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি হলে তো তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রেরই ক্ষতি! কেউ কি সাধ করে নিজের পায়ে কুড়ুল মারে?

অথচ এ দেশের ‘সিলিকন ভ্যালি’ বেঙ্গালুরুতে এই কাণ্ডটাই ঘটে চলেছে। কর্নাটকের জেডি(এস)-কংগ্রেস সরকারের মন্ত্রী-বিধায়কদের রিসর্টে নিয়ে গিয়ে রাখা হয়েছে। যাতে বিজেপি তাঁদের ভাঙিয়ে নিতে না পারে। যাঁরা তার আগেই দলছুট, তাঁরা কর্নাটক ছেড়ে মুম্বইয়ের হোটেলে গিয়ে আস্তানা গেড়েছেন। গোটা দুনিয়া নজর রাখে ভারতের ‘আইটি হাব’ বেঙ্গালুরুতে। সেই বেঙ্গালুরুর স্থিতি বা শান্তির কথা দিল্লি ভাবছে না।

কর্নাটকে সরকার গড়তে জেডি(এস) ও কংগ্রেস মিলে জোট করলেও দু’দলের বিবাদ কমেনি। পান থেকে চুন খসলেই ঝগড়া শুরু হয়ে যায়। শাসক জোটের বিক্ষুব্ধ নেতাদের ভাঙিয়ে সরকার ফেলার চেষ্টা করছে বিজেপি। ইনফোসিস থেকে ফ্লিপকার্টের আঁতুড়ঘর অবাক হয়ে দেখছে, দিনের আলোয় নেতা-মন্ত্রীদের নিয়ে চলছে ঘোড়া কেনাবেচা।

মুম্বইতে প্রবীণ শিল্পপতি আদি গোদরেজ মনে করিয়ে দিয়েছেন, ক্রমবর্ধমান অসহিষ্ণুতা, সামাজিক অস্থিরতা অর্থনীতির বৃদ্ধিতে ধাক্কা দেবে। কর্নাটকে যে রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা, অস্থিরতা জিইয়ে রাখা হচ্ছে, তাতে যে রাজ্যের রাজধানী বেঙ্গালুরুর তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে ধাক্কা লাগতে পারে, নতুন লগ্নিকারীরা যে সংশয়ে পড়তে পারেন, সে কথা ক্ষমতা দখলে মরিয়া বিজেপি নেতৃত্বের মাথায় নেই।

এ বারই অবশ্য প্রথম নয়। গত বছর কর্নাটকে বিধানসভা ভোটের পর থেকেই এমনটা চলছে। বিজেপি বিধানসভায় সব থেকে বেশি আসন পেলেও সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। জেডি(এস)-কংগ্রেস মিলে সরকার গড়ে ফেলে। বিরোধী আসনে বসতে হয় বিজেপিকে। সেটাই মেনে নিতে পারছেন না বিজেপি নেতারা। তাই সুযোগ পেলেই সরকার ফেলে দেওয়ার চেষ্টা। বাজেটের পর দিন প্রধানমন্ত্রী গিয়েছিলেন বারাণসীতে। বিরোধীরা বাজেটের সমালোচনা করায় নরেন্দ্র মোদী তাঁদের ‘পেশাদার নিরাশাবাদী’ বলে আখ্যা দেন। ওই কথাটাই বোধ হয় আপ্তবাক্য হিসেবে নিয়েছেন কর্নাটকের বিজেপি নেতারা। বিরোধী আসনে বসলেও তাঁরা আশা ছাড়তে রাজি নন। তাই নিরন্তর সরকার ফেলে ক্ষমতায় ফেরার চেষ্টা।

কলকাতা বা শহরতলির যে কোনও পাড়ার অন্তত একটি ছেলে বা মেয়ে বেঙ্গালুরুতে চাকরি-সূত্রে থাকে। শুধু কলকাতা কেন, গোটা দেশের ইঞ্জিনিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রের উদ্যোগপতিদের ভিড় বেঙ্গালুরুতে। এ হেন বেঙ্গালুরুতে এই মুহূর্তে জলের সঙ্কট তীব্র। যেখানে একতলা বাড়ি পর্যন্ত অনুমতি আছে, সেখানে পাঁচতলা বাড়ি তুলে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। নেতা, সরকারি কর্তারা উপরি আয় পকেটে পুরে চোখ বুজে থেকেছেন। ষাট-সত্তরের দশকে বেঙ্গালুরু ছিল ‘এয়ার-কন্ডিশন্ড’ শহর। সারা বছরই বসন্ত। লাগামছাড়া ইট-কংক্রিটের জালে সেই বেঙ্গালুরুতে এখন এসি ছাড়া টেকা মুশকিল। এক সময় শহরের গর্ব যে লেকগুলি, এখন তাদের ৯০ শতাংশ দূষিত। ট্র্যাফিক ব্যবস্থার হাল এমন যে পাঁচ কিলোমিটার যেতেও এক ঘণ্টা। ক্যাব বুক করুন। আধ ঘণ্টার আগে চালক আপনার কাছে পৌঁছতেই পারবেন না। পানীয় জলের সঙ্কট ঠেকাতে আগামী পাঁচ বছর নতুন আবাসন তৈরির অনুমতি দেওয়া হবে না বলে ভাবনাচিন্তা শুরু হয়েছে। কিন্তু ২০২৫-এর পরে বেঙ্গালুরু আর বাসযোগ্য থাকবে কি না, তা নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে। জেডি(এস)-কংগ্রেস সরকারকে এ সব নিয়ে চেপে ধরছে না বিজেপি। বদলে তারা সরকার ফেলতে বেশি মরিয়া।

রাজনীতিকরা কেন ক্ষমতায় আসতে চান? নিজেদের নীতি, পরিকল্পনা অনুযায়ী দেশের উন্নয়ন করবেন বলে। জনগণের সেবা করবেন বলে। অথচ কর্নাটকের সরকার ফেলতে যেমন টাকা ওড়ানো হচ্ছে, তেমনই সরকার টিকিয়ে রাখতেও কম টাকা খরচ হচ্ছে না। এই টাকার খেলা কি জনগণের সেবা করার জন্য? এত টাকা খরচ করে গদিতে বসা মন্ত্রীরা যে পুরোটাই সুদে-আসলে কামিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করবেন, তা বলাই বাহুল্য। না কি পশ্চিমবঙ্গের মতো পরে ‘কাটমানি’ ফেরত দেওয়ার নির্দেশ জারি হবে?

এ বার লোকসভা ভোটে বাংলার বহু মানুষ তৃণমূল কংগ্রেসের উপর ক্ষুব্ধ হয়ে বিজেপিকে ভোট দিয়েছেন। তার একটা কারণ যদি হয় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুসলিম-তোষণ, আর একটি অবশ্যই পঞ্চায়েত ভোটে তৃণমূলের হিংসা। শুধু ভোটাভুটির দিন মারদাঙ্গা নয়। বহু এলাকায় বিরোধী প্রার্থীদের মনোনয়নই জমা দিতে দেয়নি তৃণমূল। লোকসভা ভোটে ইভিএম-এ পদ্মফুলের বোতাম টিপে রাগ মিটিয়েছিলেন গ্রামের মানুষ।

লক্ষ করার মতো, বিজেপি-শাসিত ত্রিপুরায় পঞ্চায়েত নির্বাচনে এ বার বিজেপির বিরুদ্ধে সেই একই অভিযোগ উঠেছে। ভোটের আগেই গ্রামপঞ্চায়েতের ৮৬ শতাংশ আসন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে নিয়েছে বিজেপি। ৬,১১১ গ্রামপঞ্চায়েত আসনের মধ্যে পাঁচ হাজারের বেশি আসন বিরোধীশূন্য। কংগ্রেস শতকরা ১০ ভাগ, সিপিএম ৪ শতাংশ আসনে প্রার্থী দিতে পেরেছে। অভিযোগ, বিজেপির ‘সশস্ত্র গুন্ডাবাহিনী’ মনোনয়ন জমাই দিতে দেয়নি।

বিজেপি-শাসিত আর এক রাজ্য গোয়াতেও একই দৃশ্য। নিশ্চিন্তে বিজেপির সরকার চলছিল। তা সত্ত্বেও কংগ্রেসের ১৫ বিধায়কের মধ্যে ১০ জনকে বিজেপিতে ভাঙিয়ে আনা হল। দল ভেঙে আসা কংগ্রেস-নেতাকে উপ-মুখ্যমন্ত্রী পদে বসানোর সিদ্ধান্ত নিলেন অমিত শাহ।

লক্ষ্যটা স্পষ্ট। সব গেরুয়া রঙে রাঙিয়ে দাও। কোথাও কোনও বিরোধী থাকবে না। এক রাষ্ট্র, এক ভোট-এর মতো— এক রাষ্ট্র, এক দল।

যে কোনও রাজনৈতিক দলই ক্ষমতা দখল ও কুর্সিতে টিকে থাকার চেষ্টা করে। কিন্তু নরেন্দ্র মোদী দেশের ‘বিকাশ’-এর কথা বলেন, ‘মজবুত’ সরকারের কথা বলেন, দীর্ঘ ১৩ বছর যিনি গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রীর গদিতে ছিলেন— তিনি ভালই জানেন, লগ্নিকারীরা রাজনৈতিক অস্থিরতা পছন্দ করেন না। বার বার সরকার বদল হলে সরকারের নীতি বদলে যাওয়ারও আশঙ্কা থাকে। বিদেশি লগ্নিকারীরা তাতে ভয় পান। অর্থনীতির মূল্যায়নকারী রেটিং এজেন্সির খাতায় এতে কম নম্বর ওঠে। নতুন তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা বা স্টার্ট-আপে ইচ্ছুক বিনিয়োগকারীরা এর ফলে পিছিয়ে যেতে পারেন। তাতে আখেরে দেশের ‘সিলিকন ভ্যালি’ বেঙ্গালুরুর গরিমা বিপন্ন হতে পারে, বোঝা কঠিন নয়।

শেষ কথা। বেঙ্গালুরুর ছোট্ট প্রতিফলন বিধাননগর পুরসভাতেও এসে পড়েছে। সেখানে মেয়রকে নিয়েই টানাটানি। সব্যসাচী দত্ত বিজেপির দিকে পা বাড়িয়েছেন, না কি বিজেপি সব্যসাচী দত্তকে তৃণমূল থেকে ভাঙিয়ে বিজেপিতে নিয়ে আসতে চাইছে, সেটা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। কিন্তু এই বিধাননগর পুরসভার অধীনেই সল্ট লেকের সেক্টর ফাইভ। মাপে, দরে সিলিকন ভ্যালি নয়। বেঙ্গালুরুও নয়। তবু বাংলায় তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের প্রথম ঠিকানা। সেই বিধাননগরেও একই দল ভাঙানোর খেলা। বেঙ্গালুরুর আদলেই। কাকতালীয়। কিন্তু সত্যি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

BJP Indian Politics Bengaluru
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE