Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

সংবিধানের আত্মাকে সংসদীয় সংখ্যা দিয়ে নস্যাৎ করা যায়?

কেন নাগরিক পঞ্জি তৈরির নিরিখ, পদ্ধতি এবং প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড এমন হবে যার জন্য মানুষকে ভয়ে ভয়ে থাকতে হবে? কেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এনআরসি বিষয়ক বয়ান আর প্রধানমন্ত্রীর কথা আলাদা হবে? সাহাবুদ্দিন

সাহাবুদ্দিন
শেষ আপডেট: ২৮ ডিসেম্বর ২০১৯ ০২:৫২
Share: Save:

দাদা, ছিল সিএবি, হয়ে গেল সিএএ, ব্যাপারটা ঠিক কী বলুন তো!

এ কথা তথাকথিত শিক্ষিত তাত্ত্বিকদের নয়। গত কয়েক দিনে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন ও জাতীয় নাগরিক পঞ্জি নিয়ে যখন রাজ্য তথা সারা দেশ উত্তাল, তখন গ্রাম-শহর নির্বিশেষে এমন কথা বলতে শুনছি অসংখ্য সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষকে।

ইংরেজি বর্ণমালায় বি থেকে এ-র দূরত্ব অনেকের জানা। কিন্তু যে 'দুর্ভাগা দেশ'-এ স্বাধীনতার সাত দশক পরেও বিল থেকে আইন-এ পরিণত হওয়ার পথের দূরত্ব তথা তফাতটুকু সাধারণ মানুষের অজানা, যে দেশ শিক্ষা তো দূরের কথা, বিশ্বক্ষুধা সূচকে এই মুহূর্তে বিশ্বের ১১৭টি দেশের মধ্যে ১০২তম স্থানে, যে দেশ গত ৪৫ বছরে সর্বাধিক বেকারত্বের মুখ দেখে মুখ লুকোনোর জায়গা খুঁজে পাচ্ছে না, সে দেশে সরকারের মনে হল হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব সংশোধনী ও জাতীয় নাগরিক পঞ্জি তৈরির কথা!

বেশ তো, ধরে নিলাম যে কোনও সভ্য দেশের মতো ভারতেরও জাতীয় নাগরিক পঞ্জি থাকা উচিত। কিন্তু তার জন্য মানুষকে আতঙ্কিত হয়ে আত্মহত্যা করতে হবে কেন? যদি কেউ আতঙ্কিত হয়, সেটা সম্পূর্ণ তার ব্যক্তিগত মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপার বলে দায় এড়ানো যায় কি? বিশেষ করে যখন আতঙ্কিত হওয়ার মতো হরেক উদাহরণ হাজির, যখন অসমে লক্ষ লক্ষ মানুষ নথিপত্র নিয়ে নাজেহাল হয়ে শেষ পর্যন্ত চূড়ান্ত নাগরিক পঞ্জিতে নাম না দেখে দিন কাটাচ্ছেন ঘোর অনিশ্চয়তাকে সঙ্গী করে, তখন দেশের অন্যত্র তার আঁচ লাগবে না? কেনই বা সেই নাগরিক পঞ্জি তৈরির নিরিখ, পদ্ধতি এবং প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড এমন হবে যার জন্য মানুষকে ভয়ে ভয়ে থাকতে হবে? কেন সরকার নাগরিকত্ব প্রমাণের নথি নিয়ে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন বয়ান দেবে, যা শুধু বিভ্রান্তি নয়, রীতিমতো আতঙ্ক ছড়ায়? কেন সংসদে দাঁড়িয়ে বলা মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এনআরসি বিষয়ক বয়ান আর জনসভায় দাঁড়িয়ে বলা একই বিষয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কথা আলাদা হবে? আর কেনই বা সেই বিভ্রান্তি ও গণহিস্টিরিয়ার মধ্যে প্রান্তিক মানুষকে খেপিয়ে তুলে অনেকেই নেমে পড়ার সুযোগ পাবে রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে?

যাঁরা নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের পক্ষে তাঁদের অনেকেই বলছেন, এই আইন নিয়ে মানুষকে ভুল বোঝানো হচ্ছে। তাঁদের কাছে বিনীত প্রশ্ন, মেধাচর্চার আঁতুড়ঘর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী, গবেষক, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ঐতিহাসিক, বিজ্ঞানী, সাহিত্যিক, সংস্কৃতিকর্মী, কৃতী অধ্যাপক সবাই ভুল বুঝছেন? একথা ঠিক যাঁরা সিএএ-এর প্রতিবাদ করছেন তাঁদের বিপ্রতীপে বিরুদ্ধমত থাকতেই পারে।কিন্তু সংবিধানের ১৪ ও ২১ নং ধারার সাম্যের অধিকার এবং খোদ প্রস্তাবনায় উল্লিখিত 'ধর্মনিরপেক্ষ' শব্দটা যদি তাদের মনঃপূত না-ও হয়, তা হলে দেশের বাকি সিংহভাগ মানুষের (যাঁরা গত সংসদীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী ভারতীয়দের ৬০ শতাংশ) মতকে উপেক্ষা করে, সংবিধান প্রণেতাদের ‘সেকুলার’ স্বপ্ন তথা ভারতীয় সংবিধানের আত্মাকে নিছক সংসদীয় সংখ্যার জোরে নস্যাৎ করা যায় কি? যদি ধরেও নিই, সংখ্যার জোরেই বহু বার সংশোধিত হয়েছে সংবিধান, তাই এবারেও করতে ক্ষতি কী, তা হলেও বলব সংশোধন আর মূল স্পিরিটকে অস্বীকার কি এক হল?

জাতীয় নাগরিক পঞ্জির প্রসঙ্গ ভারতীয় রাজনীতিতে নতুন কিছু নয়। নতুন যা তা হল নাগরিক সংশোধনী আইন। মূলত অসম চুক্তির (১৯৮৫) সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে অসমের জন্য যে এনআরসি তা ইতিমধ্যেই বহু আলোচিত। তাই এ নিয়ে নতুন করে বিশেষ কিছু বলছি না। যেটা বলার তা হল, এন আর সি তো ছিলই, আবার সিএএ কেন? উত্তর খুব সোজা। অসমে বাদ যাওয়া ১৯ লক্ষ মানুষের মধ্যে ১২ লক্ষই হিন্দু। স্বভাবতই অসম মডেল বাংলায় চালু হলে লক্ষ লক্ষ হিন্দুর নাগরিক পঞ্জি থেকে বাদ যাওয়ার ভয় রয়েছে।

এন আর সি-র তালিকা তৈরির আগেই নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন। এই আইনের বলে বাংলাদেশ থেকে আসা অসমের হিন্দুরা যেমন নাগরিকত্ব পাবেন, তেমন বাংলার মতুয়া-সহ অন্য হিন্দু যাঁরা বাংলাদেশ থেকে এসেছেন তাঁদের নাগরিকত্ব পাওয়ার পথও মসৃণ হবে। রাজনীতির জাঁতাকলে পড়ে সে পথ আদৌ কতটা মসৃণ হবে সে প্রশ্ন যদিও থেকেই যায়, তবু ওঁদের কাছে মসৃণ হওয়ার বার্তাই দেওয়া হচ্ছে। অনেকেই তা বিশ্বাস করছেন এবং এর তারিফও করছেন। শুধু তাই নয়, যাঁরা এর বিরুদ্ধে তাঁদেরকে হাস্যকর ভাবে দেশদ্রোহীর তকমাও দেওয়া হচ্ছে। এর পিছনে কী যুক্তি? না, নাগরিক সংশোধনী আইন হল নাগরিকত্ব দেওয়ার আইন, কেড়ে নেওয়ার নয়। কথাটা শুনতে সত্যিই সুন্দর, হৃদয় ছুঁয়ে যায়।

কিন্তু মস্তিষ্ক? সে বড় বালাই। সে প্রশ্ন করে, যে আইন গ্রহণ করার (inclusive), বাদ দেওয়ার (exclusive)নয়, তার মধ্যে ভারতীয় সংস্কৃতির মূল চিহ্ন 'সর্বগ্রাহিতা' নেই কেন? কেন দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম জনগোষ্ঠী মুসলমানরা বাদ? পাল্টা যুক্তি,তাদের জন্য মুসলিম -অধ্যুষিত দেশ তো আছেই।

তখন প্রশ্ন দাঁড়ায়, মুসলিম -অধ্যুষিত দেশে কি শুধু অমুসলিমরা নিগৃহীত হন? পাকিস্তানে সংখ্যালঘু আহমদিয়া, বালুচ ও সিন্ধি মুসলিম-নিগ্রহ, বাংলাদেশে উদারপন্থী, প্রগতিশীল মুসলিম ব্লগার হত্যা কোন সত্যকে সামনে আনে?

কী বলছে এই সিএএ নামধারী পক্ষপাতদুষ্ট আইন?২০১৪-র ৩১ ডিসেম্বরের আগে পাকিস্তান আফগানিস্তান বাংলাদেশ থেকে ধর্মীয় উৎপীড়নের কারণে আগত হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, শিখ, খ্রিস্টান, পার্শি সবাই শরণার্থীর মর্যাদা পাবেন, ও ছ’বছর এ দেশে একনাগাড়ে থাকলে আবেদন মাফিক নাগরিকত্ব পাবেন। শুধু মুসলমান ও ইহুদি বাদ। বাদ অন্য প্রতিবেশী দেশ নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা ও মায়ানমারের নাম। বিশেষত মায়ানমার, যা কিনা ১৯৩৭-এ ভারতের মানচিত্রে চিহ্নিত যে মায়ানমার (বার্মা), সেখান থেকে বৌদ্ধদের হাতে উৎপীড়িত হয়ে রোহিঙ্গা মুসলমানদের অতি সম্প্রতি সাতপুরুষের ভিটেমাটি ছেড়ে চলে আসার মর্মান্তিক নজির রয়েছে। নজির রয়েছে শ্রীলঙ্কা থেকে তামিল শরণার্থীদের চলে আসার। সর্বোপরি, আছেন অনেক প্রগতিশীল সেই সব উদারপন্থী মুসলমান যাঁরা প্রতিবেশী দেশের রক্ষণশীল ধর্মীয় আবহ থেকে মুক্তির খোঁজে আশ্রয় নিয়েছেন ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক আবহে। নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন এঁদের বিষয়ে নীরব কেন?

তা ছাড়া, কোন যুক্তিতে বলা যায় যে প্রতিবেশী মুসলিম-অধ্যুষিত দেশ থেকে অমুসলিম আসা মানেই ধর্মীয় উৎপীড়নের জন্যই আসছে? যে সব কারণে (শিক্ষা, অর্থনীতি ইত্যাদি) ভারত ছাড়া অন্য দেশে তাঁরা বসতি গড়েছেন, সে কারণগুলি ভারতের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে না এমন নিশ্চয়তা কোথায়?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

CAA Spirit of Constitution Anti CAA movement
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE