Advertisement
E-Paper

দ্বন্দ্বটি রাজনীতির

দ্বন্দ্বটি অতএব ধনতন্ত্র বনাম পরিবেশের নহে। দ্বন্দ্ব রাজনীতির সহিত। সেই রাজনীতি যে পুঁজির দ্বারা প্রভাবিত, তাহাতে সংশয় নাই। ট্রাম্প সাহেব যখন প্যারিস চুক্তি হইতে সরিয়া দাঁড়াইবার পণ করেন, তখন সেই সিদ্ধান্তের পিছনে বাণিজ্যিক লবির প্রভাব অতি প্রকট।

শেষ আপডেট: ১২ অক্টোবর ২০১৮ ০০:০০
বেইরুটের সমুদ্রসৈকত। ছবি: এএফপি।

বেইরুটের সমুদ্রসৈকত। ছবি: এএফপি।

সমাপতন? যে দিন নোবেল পুরস্কার পাইলেন উইলিয়াম নর্ডাউস, ঠিক সে দিনই ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (আইপিসিসি) জানাইল যে বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রভাব যতখানি বলিয়া এত দিন অনুমান ছিল, প্রকৃত প্রস্তাবে ভয়াবহতা তাহার ঢের বেশি। এখনই সতর্ক না হইলে আর মাত্র বারো বৎসরের মধ্যেই দুনিয়া বিপর্যস্ত হইবে। ধনতন্ত্রের উল্লেখ ব্যতীত বিশ্ব উষ্ণায়নে মানুষের অবদানের আখ্যানটির বয়ান অসম্ভব। মূলত যাহার জোরে মানবসভ্যতা গত এক শতকাধিক কালে অভূতপূর্ব গতিতে বিকশিত হইয়াছে, মহাপ্রলয়ও আসিতেছে তাহার ডানাতেই ভর করিয়া। নিয়তির পরিহাস? নর্ডাউস বলিবেন, না। ধনতন্ত্র পরিবেশকে কী ভাবে ব্যবহার করিবে, তাহা নির্ধারণের দায়িত্ব শুধু বাজারের হাতে ন্যস্ত থাকিলে এই বিপর্যয়ই অমোঘ পরিণতি। বাজার আপন লাভ-ক্ষতির হিসাব কষে। কোন বিনিয়োগে কতখানি লাভ, বাজারের অঙ্কে সেই সমীকরণ ব্যতীত আর কিছুর সন্ধান পাওয়া যায় না। এক্সটার্নালিটি বা অতিক্রিয়ার দায়িত্ব যে বাজার লইতে পারে না, তাহা অর্থনীতির তাত্ত্বিক পরিসরে যেমন তর্কাতীত ভাবে প্রমাণিত, ঠিক তেমনই স্পষ্ট বাস্তবের মাটিতেও। বিশেষত পরিবেশ সংক্রান্ত অতিক্রিয়ার ক্ষেত্রে এই কথাটি আরও বেশি সত্য, কারণ সেই অতিক্রিয়া দেশের গণ্ডিতেও সীমাবদ্ধ নহে, কালের গণ্ডিতেও নহে।

ধনতন্ত্রের লোভের দোহাই দেওয়া অতএব অনর্থক। এমনকি শিকাগো স্কুলও সম্ভবত এখন আর দাবি করিবে না যে বাজার থাকিলেই যথেষ্ট, তাহার উপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখিবার প্রয়োজন নাই। অতিক্রিয়া নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের, এবং পরিবেশের ন্যায় প্রশ্নে আন্তর্জাতিক সংগঠনের, হাতে রাশ থাকা জরুরি। উৎপাদন চাই, তাহার বৃদ্ধিও অতি বাঞ্ছনীয়, কিন্তু প্রকৃতিকে কতখানি ব্যবহার করিলে তাহা পুষাইয়া যায়, আর কোন সীমা অতিক্রম করিলে ফিরিবার পথ থাকে না, সেই লক্ষ্মণরেখা টানিবার দায়িত্বটি নিয়ন্ত্রকদেরই। রাষ্ট্রপুঞ্জ চেষ্টা করিয়াছে। কিয়োটো প্রোটোকল হইতে প্যারিস চুক্তি, সেই চেষ্টার গতিপথ স্পষ্ট। কিন্তু আইপিসিসি-র বর্তমান ঘোষণা বলিতেছে, পরিবেশ রক্ষার কাজে সেই চেষ্টা যথেষ্ট হয় নাই, তাহাতে খামতি ছিল। তবে, সেই খামতির দায় রাষ্ট্রপুঞ্জের ঘাড়ে চাপাইলে খানিক অবিচার হইবে। স্বতন্ত্র দেশগুলির সদিচ্ছা ব্যতীত রাষ্ট্রপুঞ্জও নাচার। এবং, বিশ্বের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ দেশের ক্ষমতার শীর্ষে যদি ডোনাল্ড ট্রাম্প অধিষ্ঠিত হন, তবে পরিবেশকে তাহার প্রাপ্য গুরুত্ব দেওয়ার উপায় কী?

দ্বন্দ্বটি অতএব ধনতন্ত্র বনাম পরিবেশের নহে। দ্বন্দ্ব রাজনীতির সহিত। সেই রাজনীতি যে পুঁজির দ্বারা প্রভাবিত, তাহাতে সংশয় নাই। ট্রাম্প সাহেব যখন প্যারিস চুক্তি হইতে সরিয়া দাঁড়াইবার পণ করেন, তখন সেই সিদ্ধান্তের পিছনে বাণিজ্যিক লবির প্রভাব অতি প্রকট। কিন্তু, সেই লবি আর ধনতন্ত্র সমার্থক নহে। ঘরের কাছের উদাহরণ লইলে, যে শিল্পপতিদের মন রাখিতে ভারতের পরিবেশবিধি যথেচ্ছ লঙ্ঘিত হয়, তাঁহারা ক্ষমতাশালীদের কাছের মানুষ হইতে পারেন, বিপুল বিনিয়োগের মালিক হইতে পারেন, কিন্তু তাঁহারা ধনতন্ত্রের প্রতীক নহেন। তাঁহারা সাঙাত-তন্ত্রের প্রতিভূ। দায়িত্বশীল হওয়ার পরিবর্তে রাজনৈতিক আনুকূল্য আদায় করিয়া নিজেদের লাভের ঝুলি ভরানোতেই তাঁহাদের আগ্রহ। এই সাঙাত-তন্ত্রকে নিয়ন্ত্রণ করাই আপাতত বৃহত্তম চ্যালেঞ্জ। তাঁহাদের ক্ষুদ্রস্বার্থ যাহাতে রাজনীতিকে চালিত না করিতে পারে, জাতীয়তাবাদের সিংহচর্মাবৃত হইয়া সেই রাজনীতি যাহাতে পরিবেশের প্রশ্নটিকে অবজ্ঞা না করিতে পারে, তাহা নিশ্চিত করাই এখন লক্ষ্য হওয়া বিধেয়। ধনতন্ত্র আর পরিবেশ একই সঙ্গে বাঁচিতে পারে। সাঙাত-তন্ত্র নহে।

Environment IPCC Capitalism Politics
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy