E-Paper

সম্পাদক সমীপেষু: শুধুই দিবাস্বপ্ন

ঠিক সেই একই সমীকরণে বিহারে এনডিএ-র জয় এসেছে। বাংলা দখলের স্বপ্নে বিভোর বিজেপিকে এ কথা মাথায় রাখতে হবে।

শেষ আপডেট: ২০ ডিসেম্বর ২০২৫ ০৫:২৩

সাম্প্রতিক বিধানসভা নির্বাচনে বিহারের সাফল্যে বিজেপি বাংলা দখলের যতই স্বপ্ন দেখুক না কেন, আজকের দিনে এই রাজ্যে তাদের ছন্নছাড়া অবস্থা দেখে বলা যেতে পারে, সেটা দিবাস্বপ্ন ছাড়া আর কিছুই নয়। এই প্রসঙ্গে প্রেমাংশু চৌধুরীর প্রবন্ধ ‘শূন্য থেকেই শুরু’ (২০-১১) খুবই সময়োচিত। রাজ্যের বর্তমান শাসক দলের প্রধান শক্তি তাদের সাংগঠনিক অবস্থান। প্রবন্ধে সঠিক ভাবেই উল্লেখ করা হয়েছে, ভোটে শাসক দলের জয়ে বরাবরই দেশ বা রাজ্যের যাবতীয় সমস্যা আড়ালে চলে যায়। বাংলায় শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থান একেবারে তলানিতে ঠেকলেও, হাতে তাৎক্ষণিক অনুদান প্রাপ্তি সব ভুলিয়ে দিয়েছে বেশ কিছু সংখ্যক মানুষকে। তাই তাঁরা গত বিধানসভা নির্বাচনে উজাড় করে ভোট দিয়েছেন শাসক দলকে। শাসক দলও সেটি ভাল ভাবেই অনুধাবন করতে পারছে বলে এই অনুদানকেই সামাজিক উন্নয়নের প্রধান মাপকাঠি বলে স্থির করে নিয়েছে।

ঠিক সেই একই সমীকরণে বিহারে এনডিএ-র জয় এসেছে। বাংলা দখলের স্বপ্নে বিভোর বিজেপিকে এ কথা মাথায় রাখতে হবে। এ ছাড়াও বিজেপি যে ভাবে পরিযায়ী বাংলাভাষীদের হেনস্থা করেছে বিনা কারণে, যে ভাবে বাংলার ধর্মীয় সংস্কৃতিকে ছাপিয়ে আমিষ-নিরামিষ নিয়ে বিতর্ক তুলছে এবং রাজ্যের বাঙালি-বিজেপি নেতারাও হিন্দি বলয়ের নেতাদের সেই সব কথার বিরোধিতা করা দূরে থাক, উল্টে সমর্থন করছেন, তাতে স্বাভাবিক ভাবেই বাঙালি হিন্দু ও মুসলমান, উভয় সম্প্রদায়ের ভোটের অধিকাংশ তাঁদের বিরুদ্ধে যাবে। প্রবন্ধকার এই বিষয়গুলি নিয়ে বিস্তৃত ভাবেই আলোচনা করেছেন, যদিও তাঁর একটি বক্তব্য খানিক দ্বন্দ্বে ফেলে আমাদের। তিনি এক জায়গায় বলেছেন, সামাজিক উন্নয়নের মাপকাঠিতে দেশের ২৮টি রাজ্যের মধ্যে বিহার একেবারে পিছনের সারিতে। আবার অপর জায়গায় উল্লেখ করেছেন, নীতীশ সরকারের আমলে বিশেষত সামাজিক উন্নয়নে যথেষ্ট কাজ হয়েছে। দু’টি বক্তব্য পাশাপাশি রাখলে পরস্পরবিরোধী মনে হওয়াই স্বাভাবিক। তবে সামাজিক উন্নয়নের সংজ্ঞার অর্থ যে সাধারণ মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও সামগ্রিক মানোন্নয়ন, তা আমরা ভুলতে বসেছি তাৎক্ষণিক লাভের আশায়। ঠিক সেই কারণেই কিছু ক্ষেত্রে বাম আমলের নৈরাজ্যকে পিছনে ফেলে দিলেও, রাজ্য শাসক দল জানে, এই বিজেপির পক্ষে আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে প্রাপ্ত আসনসংখ্যা চমক জাগাবে না। এই অবস্থায় যে বাম-সহ অন্য দলগুলি নতুন পথের সন্ধান দিতে পারত, তারা এখনও অবধি ব্যর্থ নিজেদের মানুষের সামনে তুলে ধরতে।

অশোক দাশ, রিষড়া, হুগলি

এক নয়

প্রেমাংশু চৌধুরীর ‘শূন্য থেকেই শুরু’ প্রবন্ধ প্রসঙ্গে বলি, বিহারের নির্বাচনে বিজেপি জোটের জয় উল্লেখযোগ্য, নিঃসন্দেহে। নীতীশ কুমার একটানা বেশ কয়েক বার জিতে মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন। অর্থাৎ, সে রাজ্যে প্রতিষ্ঠান-বিরোধী হাওয়া সেই অর্থে নেই। থাকলেও বিরোধী দল সেটাকে তাদের অনুকূলে নিয়ে আসতে পারেনি। দেশের রাজ্যগুলির মধ্যে বিহার বিভিন্ন মাপকাঠিতে পিছনের সারিতে রয়েছে। তা সত্ত্বেও বিরোধী দল সেটাকে কাজে লাগাতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হল। অপর দিকে, পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে শাসক দল বিগত কয়েক বছর ধরে দুর্নীতি-সহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে জেরবার। এর পরও বিভিন্ন ভোটে শাসক দল ভোটের মার্জিন বাড়িয়েছে। বিহার ও পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি এক নয়। বিহারে জাতপাত এখনও সমান তালে বিদ্যমান, পশ্চিমবঙ্গে জাতপাতের প্রভাব তেমন বেশি নয়। এ রাজ্যের রাজনীতিতে বিরোধী দলের সংগঠন তুলনামূলক ভাবে দুর্বল। তা ছাড়া সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের মধ্যেও তাঁরা খুব বেশি প্রভাব বিস্তার করতে পারেননি। বাংলার নিজের সংস্কৃতি, মূল্যবোধের প্রতি নিষ্ঠা ও ভালবাসা অন্য রাজ্যের থেকে আলাদা। বাংলার মন জয় করতে হলে অবশ্যই আগে বিরোধী নেতৃবৃন্দকে বাঙালি-মনষ্ক হয়ে উঠতে হবে। তার থেকে এখনও দূরে রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল।

সৈয়দ সাদিক ইকবাল, সিমলা, দক্ষিণ ২৪ পরগনা

সীমান্তের দাগ

প্রত্যেক বছরের শেষের দিকে এসে মনে হয়, কত ঘটনার ঘনঘটা গজিয়েছে এতগুলো দিনে। আমি এখন দশম শ্রেণিতে পড়ি। তাই এত সব ভেবে কিছু করার লাইসেন্স পেতে আমার আরও দুটো বছর লাগবে।‌ কিন্তু ‘ভাবা প্র্যাকটিস করা’ তো যেতেই পারে। দেশের রাজনীতিতে এখন সর্বাধিক আলোচিত এসআইআর। প্রথমে বুঝতে পারছিলাম না, যোগ্য-অযোগ্য ভোটার ব্যাপারটা কী? ভারতের মাটিতে যাঁরা স্থায়ী ভাবে ঘর-সংসার পেতে থাকেন, তাঁরাই তো ভারতীয়। যাঁদের আমরা ‘বিদেশি’ ভাবি, তাঁরাও তো কত প্রজন্ম ধরে এখানে আছেন। জেনে এসেছি, ভারত সবাইকে মিলিয়ে নেয় নিজের আত্মায়। পরে বুঝলাম, বাংলাদেশ থেকে আসা ‘অনুপ্রবেশকারী’দের হয়তো এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শনাক্ত করা হবে। পাঠানো হবে ডিটেনশন ক্যাম্পে। তার পর হয়তো ভারত থেকে তাঁরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবেন। ক্রমশ এসআইআর এ রাজ্যেও এসে পড়ল। এক বন্ধুর কথায় এক নতুন ভাবনা মনে খোঁচা দিল— “আমরা তো বাঙাল। অনেক আগে দাদু এসেছিলেন এ দেশে। আমাদের কত আত্মীয় ওখানে থাকতেন। কিছু জন এই বছর তিনেক আগে ভারতে পাকাপাকি এসেছেন। ওঁদের আধার কার্ড আছে। কিন্তু যদি লিস্টে নাম না আসে? ওঁদের কি ক্যাম্পে পাঠাবে?”

রিফিউজি। কথাটা আমাদের প্রজন্মের কাছে এমন একটা ট্রেনের ভেঁপু, প্ল্যাটফর্মে পা দেওয়ার সন্ধিক্ষণে যা স্টেশন ছেড়ে বেরিয়ে যায়। হাওয়ায় পড়ে থাকে তার অস্পষ্ট শব্দের জলছাপ। আমাদের আগের প্রজন্ম, তারও অনেক আগের প্রজন্ম ধরে সংগ্রাম চলেছে। ভাল থাকার সংগ্রাম। দু’বেলা দু’মুঠো পেটে দেওয়ার সংগ্রাম। অস্তিত্বের সংগ্রাম। দেশভাগ-স্বাধীনতা-উদ্বাস্তু এই পর্ব এখন অতীত। তবে একটা বড় অধ্যায়ের সংগ্রাম গত শতাব্দীর শেষের দশকের প্রজন্মের সিলেবাস থেকে বাদ পড়ে গিয়েছে— দেশমৃত্তিকা থেকে উচ্ছেদের সংগ্রাম। কী অপূর্ব ট্র্যাজেডি! যে দেশমাতাকে স্বাধীন করার স্বপ্নে ভারতবাসী বিভোর হয়েছিলেন, সেই স্বাধীনতা এল দেশত্যাগের এক অলিখিত ফরমান নিয়ে। গ্রামের পর গ্রাম, ঘরের পর ঘর ছেড়ে মানুষ পালাতে লাগলেন। কোন কর্মফলে? ক্যাম্পে ঢোকো। টিকে যাও। বাঁচা? ওটা এখন নতুন স্বপ্নের নাম।

এক সময় এ দেশের মাটিতে তাঁরা অভিযোজিত হতে থাকেন ক্রমশ। উদ্বাস্তুর পরিচয় নিয়ে বেঁচে থাকতে কে চায়? রিফিউজিদের পরের প্রজন্ম ‘বাঙাল’ কথাটিকে বেশি মান্যতা দিয়ে জড়িয়ে নিল নিজেদের জীবনের সঙ্গে। নেটনাগরিকরাও মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল, ইলিশ-চিংড়ি ইত্যাদি নিয়ে মিঠেকড়া ঝগড়া করতে বেশ ভালবাসে। এ বার এই এসআইআর-এর ঠেলায় কি আবার রিফিউজি আতঙ্ক ফিরে আসবে? শুনেছি পশ্চিমবঙ্গের অনেক এলাকা নাকি এসআইআর আতঙ্কে ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। এ ভাবে কি আস্তে আস্তে হারিয়ে যাবে চেনা কিছু মুখ? তাঁদের জায়গা হবে কোথায়? ডিটেনশন ক্যাম্পে? হতে পারে, তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ হয়তো মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী। এত দিন তারা ‘জীবনের প্রথম বড় পরীক্ষা’-র প্রস্তুতি নিয়েছে। তার পর এক দিন এসআইআর এসে পত্রপাঠ বিদায় করার ভয় দেখিয়ে হুইসল বাজিয়ে দিল।

১৯৪৭-এ দেশভাগের পরে ডিটেনশন ক্যাম্পের মানুষগুলোর মধ্যে ছিল প্রিয় দেশকে ছেড়ে আসার হতাশা। এই মানুষগুলোর মধ্যেও হয়তো হতাশা থাকবে। যে দেশের প্রতি একরাশ বিতৃষ্ণা নিয়ে তাঁরা এসেছিলেন, ভারত তাঁদের আবার সে দেশেই ফিরিয়ে দিতে চাইছে! নতুন করে আবার একটা দেশকে, ভারতকে ঘৃণা করবেন তাঁরা। যে পৃথিবী ভালবাসতে ভুলে যাওয়ার অসুখে ধুঁকছে, সে আরও এক ধাপ এগোবে বেরঙিন হয়ে ওঠার দিকে।

তিস্তা দে, শিবপুর, হাওড়া

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

BJP West Bengal Assembly Election 2026

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy