Advertisement
E-Paper

তিব্বত নিয়ে দেং অনেকটা এগিয়েছিলেন

আশির দশকের শেষেই দলাই লামা মধ্যপন্থা নিয়েছিলেন। দেংও তাঁকে বার্তা পাঠিয়েছিলেন, স্বাধীন তিব্বত ছাড়া সব বিষয়ে আলোচনায় তিনি রাজি। কিন্তু বাদ সাধল ভারত।চি নকে বিশ্বাস করবেন না, ওদের সঙ্গে বৈঠকে বসলে ঠকবেন— দিল্লিতে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ (রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিটিকাল উইং)-এর ডেপুটি ডিরেক্টর রঙ্গনাথম তাঁর সামনে বসে থাকা তিব্বতিদের সটান জানিয়ে দিয়েছেন। রয়েছেন দলাই লামার বড়দা গিয়ালো থোন্ডুপও।

গৌতম চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ১১ অগস্ট ২০১৫ ০০:০১
হাতছাড়া সুযোগ। বেজিঙে গিয়ালো থোন্ডুপ (বাদিকে) এবং দেং জিয়াও পিং।

হাতছাড়া সুযোগ। বেজিঙে গিয়ালো থোন্ডুপ (বাদিকে) এবং দেং জিয়াও পিং।

চি নকে বিশ্বাস করবেন না, ওদের সঙ্গে বৈঠকে বসলে ঠকবেন— দিল্লিতে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ (রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিটিকাল উইং)-এর ডেপুটি ডিরেক্টর রঙ্গনাথম তাঁর সামনে বসে থাকা তিব্বতিদের সটান জানিয়ে দিয়েছেন। রয়েছেন দলাই লামার বড়দা গিয়ালো থোন্ডুপও।

—১৯৮৮। ক’মাস আগে চতুর্দশ দলাই লামা ‘চিন দূর হঠো! তিব্বত স্বাধীন হোক!’ স্লোগান থেকে সরে মধ্যপন্থা নিয়েছেন। জানিয়েছেন, তিব্বতের বিদেশ নীতি চিনের হাতেই থাকুক, কিন্তু শিক্ষা, সংস্কৃতি, বাণিজ্য, ধর্ম, বিজ্ঞান, পর্যটন ইত্যাদি অরাজনৈতিক বিষয় তিব্বতের হাতে। তিব্বত হয়ে উঠুক ‘বাফার জোন’। সেখানে পারমাণবিক জঞ্জাল না জমিয়ে হিমালয়ের প্রকৃতি ও পরিবেশ অক্ষুণ্ণ রাখা হোক। ‘এ নিয়ে আমি আলোচনায় রাজি,’ বলেছেন তিনি। চিনও জানাল, আপত্তি নেই। কবে, কোথায় আলোচনা হবে, দলাই লামাই ঠিক করুন।

দিল্লিতে ‘র’-এর দফতরে গিয়ালো থোন্ডুপ রঙ্গনাথমের কথা শুনে হতবাক। চিনের সঙ্গে এই বৈঠকের অন্যতম উদ্যোক্তা তিনিই, তাঁর মাধ্যমেই চিনা রাষ্ট্রপ্রধান দেং জিয়াও পিং-এর প্রতিনিধি দলাই লামাকে বার্তা পাঠিয়েছেন। গিয়ালো ভিক্ষু নন, সপরিবার কালিম্পঙে বাস করেন। নুড্ল তৈরির কারখানা, হংকঙে অফিস।

গিয়ালোদের কাছে তখন পরিষ্কার, দলাই লামাকে চিনের সঙ্গে সরাসরি বৈঠকে বসতে দিতে নারাজ ভারত। হিমালয়ের ভূ-রাজনীতিতে নিজের প্রভাব অটুট রাখার তাগিদেই সে চায়, তিব্বত বরাবর চিনের বিরোধিতা করুক। বিরক্ত গিয়ালো হংকং ফিরলেন। পরের দিনই কাগজে দিল্লিতে দলাই লামার প্রতিনিধি তাশি ওয়াংদুর বিবৃতি: আগামী জানুয়ারি মাসে চিন জেনেভায় দলাই লামার প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকে বসুক। গিয়ালো প্রমাদ গুনলেন— চিনকে না জানিয়েই বৈঠকের দিনক্ষণ নির্ধারণ! কয়েক মিনিট পরেই বেজিঙের ফোন: এর পরও বলবেন দলাই লামা সস্তা আত্মপ্রচারে বিশ্বাসী নন? গিয়ালো দিন কয়েক পরে ধরমশালায় তাশি ওয়াংদুকে চেপে ধরতে তিনি ব্যাখ্যা দিলেন: ভারতীয় অফিসারেরা এই পরামর্শ দিয়েছিলেন।

দেঙের বাড়া ভাতে এটাই ভারতের প্রথম ছাই নয়। ১৯৭৯ থেকে তিনি বারংবার তিব্বত সমস্যা মেটানোর চেষ্টা করছেন, তাঁর অনুরোধেই দলাই লামা সে সময় তাঁর দাদা গিয়ালোকে বেজিং পাঠিয়েছিলেন। দু’জনের দেখা হতেই দেং-এর প্রথম প্রশ্ন: ‘দলাই লামা কেমন আছেন? শরীর ভাল?’ তার পরই বলেন, দলাই লামা ও তাঁর দেশছাড়া সঙ্গীরা সকলে স্বাগত। শর্ত একটিই: ‘শুধু স্বাধীনতা নিয়ে কথা চলবে না। তার বাইরে সব কিছু নিয়ে কথা বলতে পারি।’ গিয়ালো দেংকে কয়েকটি কথা জানিয়েছেন। এক, ভারত ও নেপালের বহু তিব্বতি তাঁদের পরিবারকে লাসা, আমদোয় ফেলে এসেছেন। সীমান্ত পেরোনোর অধিকার তাঁদের নেই। দেং পারবেন, তাঁদের তিব্বতে যাতায়াতের অনুমতি দিতে? দুই, তিব্বতি শিশুরা এখন শুধু চিনা ভাষা শেখে। নিজেদের ভাষা, সংস্কৃতি শেখানোর জন্য ধরমশালা থেকে কয়েক জন তিব্বতি শিক্ষককে যাওয়ার অনুমতি দেবে চিন? প্রতিটি শর্তেই রাজি চিনা রাষ্ট্রপ্রধান। এবং বললেন, ‘ফি বছর ৩০ জন শিক্ষককে ধরমশালা থেকে পাঠাবেন বলছেন, সংখ্যাটা বড় কম। বাড়িয়ে একশো করুন।’

জীবন গিয়েছে চলে... ১৯৫৯ সালে দলাই লামা তিব্বত ছেড়ে ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় নেন, তিব্বতে নামে চিনা ফৌজের অত্যাচার। সে দিনের অন্যতম সামরিক রূপকার ছিলেন দেং। আজ তিনি গিয়ালোদের বলছেন, ‘অতীত ভুলে যান। চিনের সাধারণ মানুষও ওই সময় কম অত্যাচার সহ্য করেনি। এ বার সামনে তাকানো যাক।’ দলাই লামা দেঙের কথায় ভিত্তি করে তথ্য সংগ্রহের জন্য ধরমশালা থেকে লাসায় পর পর তিনটি কমিটি পাঠান। দুই তরফে কথা হবে ঠিকঠাক, সেই সময় দলাই লামা ও স্বাধীন তিব্বতের সমর্থনে দলে দলে তিব্বতি ভিক্ষু লাসার মিছিল বের করে, কেউ কেউ আত্মাহুতিও দেয়। কিন্তু দলাই লামা নয়, ওটি ছিল তৃতীয় এক দেশের গুপ্তচরচক্রের কারিকুরি। চিন সরকারের নিজস্ব তদন্তেও সে তথ্য বেরিয়ে আসে। তার পরই ১৯৮৮, ফের চিনের আমন্ত্রণ, এবং দিল্লিতে ‘র’-এর বজ্রনির্ঘোষ।

এই ভাবেই কখনও নাম করে, কখনও না করে ভারতের বিরুদ্ধে অনুযোগ এনেছেন গিয়ালো থোন্ডুপ তাঁর সম্প্রতি প্রকাশিত ‘দ্য নুড্লমেকার অব কালিম্পং’ বইতে। পরিষ্কার বলেছেন, শুধু আমেরিকা এবং চিন নয়, ভারতও সমান তালে তিব্বতিদের বোকা বানিয়েছে। গিয়ালো নিজে ছিলেন সিআইএ-র বিশ্বস্ত চর। পঞ্চাশের দশকে কলকাতার আমেরিকান কনসুলেটে সিআইএ-র সঙ্গে বসে লাসায় গেরিলা আক্রমণের ছক কষেছেন। লেখাপড়া করেছেন চিনে, তখন চিয়াং কাইশেক ছিলেন তাঁর অন্যতম স্পনসর। মাতৃভাষা তিব্বতির পাশাপাশি চিনা ও ইংরেজি ভাষায় সমান দক্ষ। এমন মানুষের থেকে অনুযোগ এলে জাতীয়তাবাদী চশমা খুলে রাখতেই হয়।

তিব্বত হিমালয়ে ভারতীয় ভ্রান্তির শুরু দলাই লামা এ দেশে আসার ঢের আগে। ১৯৫০ সালের ১২ অগস্ট। বেজিঙে স্বাধীন ভারতের প্রথম রাষ্ট্রদূত, ইতিহাসবিদ কে এম পানিক্করকে চিন সরকার জানাল, তিব্বতের বিরুদ্ধে শীঘ্র সামরিক অভিযান শুরু হবে। পানিক্কর সেটি চেপে গেলেন, প্রধানমন্ত্রীকে জানালেন না। পরবর্তী কালে সব গবেষক বলেছেন, এ রকম ‘ড্রামাটিক ব্রিচ অব ডিপ্লোম্যাটিক প্র্যাকটিস’ দুর্লভ। এক ভারতীয় গোয়েন্দা অফিসার তখন কালিম্পঙের অভিবাসী গিয়ালোকে রোজ উৎসাহ দেন, ‘চরবৃত্তির জন্য প্রতি মাসে তিন জনকে তিব্বতে পাঠান। আমি অর্থসাহায্য করব।’ ভারতীয় ইন্টেলিজেন্সের তৎকালীন ডিরেক্টর বি এন মালিক কিন্তু তখন এই চরবৃত্তির বিরোধী। উপরমহলকে না জানিয়ে নিজেরা সিদ্ধান্ত নেওয়া, দলাদলি, এ রোগ তখনই ধরে গিয়েছিল।

৩১ ডিসেম্বর ১৯৫৬ রাতের ট্রেনে এর ফল টের পেলেন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী। ভাকরা বাঁধ উদ্বোধনশেষে ট্রেনে ফিরছেন চৌ এন লাই ও নেহরু। সোভিয়েত ব্লক ও চিনের সম্পর্ক জানতে আগ্রহী ভারতের প্রধানমন্ত্রী। চৌ বললেন, ‘আগে তিব্বতটা শুনুন।’ অতঃপর তিব্বতের ইতিহাস, বৌদ্ধ ধর্ম, সামন্ততন্ত্র নিয়ে কয়েক ঘণ্টার একান্তকথন। তাঁর অভিযোগ: ‘আপনাদের কালিম্পঙে লক্ষ লক্ষ চিনবিরোধী গুপ্তচর।’ কালিম্পঙের মতো অতটুকু শহরে লক্ষ লক্ষ চর? দলাই লামা যখন প্রথম বার কালিম্পং যাওয়ার অনুমতি চাইলেন, নেহরু নাকচ করে দিলেন। পরের দিন নিজেই বললেন, ‘এটা গণতান্ত্রিক দেশ। যেখানে খুশি যাবেন।’ রাষ্ট্রদূত খবর চেপে যান, গোয়েন্দা সংস্থায় এক এক জন এক এক সিদ্ধান্ত নেয়, তার মধ্যে চৌ এন লাইয়ের ভাষণ না মেনে ‘গণতান্ত্রিক দেশে যেখানে খুশি যাবেন’ বলার জন্য ৫৬ ইঞ্চি ছাতি লাগে না।

দেং সত্যি চেয়েছিলেন তিব্বতিদের ফেরাতে? না কি গোটাটাই অভিনয়? গিয়ালোর মতে, দেং জানতেন, কোথায় কী ভুল হয়েছিল। গণফৌজকে মাওয়ের প্রথম নির্দেশ ছিল, তিব্বতি সংস্কৃতি ও এথনিক সত্তাকে সম্মান করতে হবে। সেখান থেকেই তিব্বত নিজের সংস্কার ঘটাবে। দেং যে ভাবে তিব্বত সমস্যা মেটাতে আন্তরিক ছিলেন, তাঁর উত্তরসূরিদের সেই ধারণা ছিল না। জিয়াং জেমিন ক্ষমতায় এসেই বললেন, দলাই লামা ফিরতে পারেন, কিন্তু তাঁকে বলতে হবে তিব্বত ও তাইওয়ান চিনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। বাফার জোন, অস্ত্রমুক্ত অঞ্চল গোছের কথা চলবে না।

গিয়ালো থোন্ডুপদের কূটনৈতিক ভরসা এখন একটাই: এ দেশে পা রাখার পর দলাই লামার বিবৃতি। চিনা ফৌজের হাতে তিব্বতে বিপন্ন মানবাধিকার নিয়ে বলা হয়েছিল তাতে। স্বাধীন তিব্বত নিয়ে একটি শব্দও নয়। বৃদ্ধ গিয়ালোর মতে, ‘আজ বোঝা যায়, এই খসড়ায় কী কূটনৈতিক বুদ্ধিমত্তা ছিল! ভারতের প্রধানমন্ত্রী কেন বিবৃতি তৈরি করে দেবেন, আর দলাই লামা তা পড়ে শোনাবেন, তা নিয়ে সে দিন আমরা রেগে গিয়েছিলাম। কিন্তু এখন মনে হয়, ওই খসড়ার বিকল্প নেই।’ কূটনীতি মানে ফি হপ্তায় বিশ্বসফর নয়।

তিব্বত সমস্যা মেটাতে আজ ওই দুই মহীরুহের কাছে ফিরে যাওয়া ভাল। নেহরু এবং দেং। নিচু তলার গুপ্তচর থেকে ওপরের রাষ্ট্রনেতা, সকলে এই সারসত্য বুঝলেই মঙ্গল।

deng xiaoping dalai lama sino indian relation raw tibet tibet raw raw china tibet dalai lama india dalai lama raw china tibet meeting abp post editorial gautam chakraborty
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy