Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

সে ছিল নিভাননী থেকে চিত্রনিভা হয়ে ওঠার দিন

আলপনাই তাঁকে পৌঁছে দিয়েছিল শান্তিনিকেতনের আশ্রমে। তাঁর স্কেচের মাঝে রবীন্দ্রনাথ লিখে দিয়েছিলেন কবিতা। লিখছেন গৌতম সরকার পিতা ভগবানচন্দ্র বসু এবং মাতা শরৎকুমারী’র কনিষ্ঠ কন্যা’ নিভাননীর  জন্ম ১৯১৩ সালের ২৭শে নভেম্বর মুর্শিদাবাদের জিয়াগঞ্জে,  মাতুলালয়ে।

শেষ আপডেট: ১৭ অগস্ট ২০১৯ ০২:৪৫
Share: Save:

‘‘শান্তিনিকেতন ছেড়ে আসার পর হঠাৎ এক শ্রাবণ সন্ধ্যায় দুর্যোগের ভেতর দিয়ে খবর কানে এল, আমাদের দরদি কবি রবীন্দ্রনাথ এই সুন্দর ধরণী হতে চিরদিনের মতো বিদায় নিয়েছেন। এই খবর শোনা অবধি আমার নয়ন হতে শ্রাবণের ধারার মতো বারি ঝরতে লাগল’’— এ ভাবেই তাঁর ‘রবীন্দ্রস্মৃতি’ গ্রন্থের সূচনা। তিনি নিভাননী দেভী। তবে, তাঁর নাম বদলে দিয়েছিলেন, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। নিভাননী লিখেছেন, ‘‘এক দিন আমার সব ছবি দেখে খুশি হয়ে , তিনি আমার নাম রেখে দিলেন চিত্রনিভা। সেই থেকে তিনি আমায় চিত্রনিভা বলে ডাকতেন এবং প্রায়‌ই তিনি রসিকতা করে আমায় বলতেন-- ‘তোমার নামকরণ করলুম, এখন আমাদের বেশ ঘটা করে খাইয়ে দাও।’’ রান্না করতে জানতেন না বলে কবিগুরুর সেই ইচ্ছাকে পূরণ করতে পারেননি, তা আফশোস ছিল তাঁর।

পিতা ভগবানচন্দ্র বসু এবং মাতা শরৎকুমারী’র কনিষ্ঠ কন্যা’ নিভাননীর জন্ম ১৯১৩ সালের ২৭শে নভেম্বর মুর্শিদাবাদের জিয়াগঞ্জে, মাতুলালয়ে। বয়স যখন বছর সাতেক, তখন থেকে তিনি পিতৃহারা। তার পর থেকে নিভাননীর ছোটবেলা কাটে মা শরৎকুমারীর বাপেরবাড়ি জিয়াগঞ্জেই। নিভাননী’র মামাবাড়ি ছিল শিল্প ও সঙ্গীতের এক বিপুল চর্চাকেন্দ্র। এখানেই শিল্প ও সঙ্গীতের বীজ অঙ্কুরিত হয় নিভাননী। চক ও খড়ির সাহায্যে নানা ধরনের আলপনা আঁকা, সুরকি, কাঠকয়লা, চালের গুড়ো আর শুকনো বেলপাতার গুড়ো মিশিয়ে নানা ধরনের রঙের কাজে মেতে থাকতেন তিনি। জিয়াগঞ্জে অল্পবয়স থেকেই কনে সাজানো, বিয়ের তত্ত্ব সাজানোয় তাঁর সুনাম ছড়িয়ে পড়ে চারি দিকে। বিয়ের পিড়িতে আলপনা দেওয়ার মাধ্যেমেই ছোট্ট নিভাননীর শিল্পচর্চা শুরু হয়েছিল।

চিত্রনিভার বয়স তখন সবে ১৩, মা শরৎকুমারী দেবী পাঁচ কন্যা ও একমাত্র পুত্রসহ অধুনা বাংলাদেশের চাঁদপুরে শ্বশুরবাড়িতে এসে বসবাস করতে শুরু করেন। চিত্রনিভার বৈবাহিক জীবনের সূচনাও হয়েছিল চাঁদপুরে বিয়ের পিঁড়িতে আঁকা আলপনা শিল্পকলার মাধ্যমেই। এক দিন নোয়াখালির লামচর নিবাসী জমিদার ঈশ্বরচন্দ্র চৌধুরীর জেষ্ঠ্যপুত্র মনোরঞ্জন চৌধুরী, নিভাননীর আঁকা বিয়ের পিঁড়ি দেখে মোহিত হয়ে তৎক্ষণাৎ মেয়েটির খোঁজ করতে থাকেন। কিন্তু মেয়েটিকে তিনি পাবেন কোথায়, সে তো বন্ধুদের সঙ্গে খেলায় মত্ত। অবশেষে অনেক অনুসন্ধানের পর মেয়েটিকে হাজির করা হয়েছিলো জমিদার পুত্র মনোরঞ্জন চৌধুরীর সামনে। মেয়েটি ভাইয়ের সহধর্মিনী হবার উপযুক্ত কিনা তা পরখ করতে তিনি নিভাননীকে বলেছিলেন, ‘‘তুমি কি গান জানো?’’ উত্তরে ছোট্ট মেয়েটি বলে , ‘‘হ্যা রবিবাবু’র গান জানি।’’ তার পর, সুকন্ঠে গেয়েছিলেন, ‘তব সিংহাসনের আসন হতে এলে তুমি নেমে’। গান শুনে আপাত খুশি হলেও তিনি কিন্তু থেমে থাকেননি পরীক্ষা-নিরীক্ষায় । এরপর ‘চয়নিকা’ ব‌ই থেকে একটি কবিতা পাঠ করতে বলেন, তখনও ছোট্ট মেয়েটি ঘুণাক্ষরে জানত না, হবু ভাশুর মনোরঞ্জন চৌধুরীর গভীর অভিসন্ধিটি। তিনি পাঠ করেছিলেন, ‘কত অজানারে জানাইলে তুমি , কত ঘরে দিলে ঠাঁই।’

ছোট্ট মেয়েটির শিল্প, সঙ্গীত ও কাব্যচর্চায় আগ্রহ যাচাই করে মনোরঞ্জনবাবু তৎক্ষনাৎ কনিষ্ঠ ভ্রাতা নিরঞ্জন চৌধুরীর সঙ্গে বিয়ের দিনক্ষণ ধার্য করে ফেলেন। ফলে মাত্র ১৪ বছর বয়সে ১৯২৭ সালে নিভাননীর বিয়ে হয়। এর পর তাঁর শ্বশুরবাড়ির লোকজনই আটপৌরে গৃহকাজে তাঁকে বেঁধে না রেখে পাঠিয়েছিলেন কবিগুরুর আশ্রমে।১৯২৮ সাল। তখন ছিল শরৎকাল। সবে গুরুপল্লির কুটিরে সন্ধ‍্যাপ্রদীপ জ্বলে উঠেছে। প্রকৃতিদেবীও তাঁর অফুরন্ত ভান্ডার ছড়িয়ে রেখেছিলেন সারা আশ্রমে। শিউলি ফুলের গন্ধে আশ্রম হয়ে উঠেছিল মধুময়। সন্ধ‍্যের সময় স্বামী নিরঞ্জন চৌধুরীর সঙ্গে সুদূর নোয়াখালির লামচর থেকে নিভাননী পৌঁছোলেন আশ্রমে। তখন ছিল পূজার ছুটি। আশ্রমের স্কুল, বোর্ডিং সব‌ ছিল বন্ধ। তাই তাঁর থাকার ব‍্যবস্থা হয়েছিল উত্তরায়ণে ‘কোণার্কে’। কবির বাড়িতে একটি ছোট্ট ঘরে। ঋষি রবীন্দ্রনাথের চরণস্পর্শে নিভাননীর স্বপ্ন হলো সার্থক।

অচেনা দেশে পথঘাট , লোকজন সব‌ই ছিল তাঁর অপরিচিত। কাজেই রোজ প্রভাতে উঠে চুপচাপ বসে থাকতেন সিঁড়িতে, ভুগতেন নিঃসঙ্গতায়। তাঁর এই একাকীত্ব কবিমনকে ব‍্যথিত করে তুলত, তাই তিনি স্নেহভরে রোজ প্রভাতে এক বার তাঁর মাথায় হাত বুলিয়ে আশীর্বাদ করে যেতেন। তখন পূজার ছুটি চলছিল। কবির বাড়িতে পরিচারিকা ছাড়া কেউ নেই। কবিগুরু তাঁকে একজন পরিচারিকার সঙ্গে চিঠি লিখে পাঠিয়ে দিলেন নন্দলাল বসু ও দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে শিক্ষার জন‍্য। শিল্পাচার্য নন্দলাল বসুর প্রত‍্যক্ষ তত্ত্বাবধানে শুরু হলো নিভাননীর শিল্পজীবনে নতুন এক অধ‍্যায়ের।

হৃদয়ে-বাহিরে , স্বদেশে-বিদেশে , শোকে-আনন্দে চিত্রশিল্পী নিভাননীর জীবনে তখন শুধুই ঋষি রবীন্দ্রনাথ। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ তাঁকে ছাত্রী থাকাকালীন‌ আশ্রমের গন্ডি ছাড়িয়ে ভুবনডাঙার মাঠেঘাটে স্কেচ করে বেড়ানোর অনুমতিও দিয়েছিলেন।’ রবীন্দ্রস্মৃতি’ গ্রন্থে চিত্রলেখা লিখেছেন-‘‘দেখা হলেই তিনি আমায় বলতেন, তুমি কী কী ছবি আঁকলে? আমায় এনে দেখিও।’’ সে দিন ছিল ১৩৩৮ সালের ৬ই বৈশাখ। চিত্রনিভা তাঁর আঁকা কিছু ডিজাইন কবিকে দেখাতে গিয়েছিলেন। ডিজাইনের মাঝখানে বেশ কিছুটা ফাঁকা জায়গা নজরে পড়ায় কবি চিত্রনিভাকে বলেছিলেন,’ ‘‘তুমি এর মধ‍্যে একটা কবিতা লিখেই ফেলো না?’’ উত্তরে চিত্রনিভা বলেছিলেন, ‘‘আমি তো কবিতা লিখতে পারি না।’’ শুনে হেসে ফেলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। বলেছিলেন, ‘‘তবে কি আমাকেই লিখে দিতে হবে? তা হলে ডিজাইনটি টেবিলের ওপর রেখে যাও।’’ পর দিন চিত্রনিভা গিয়ে দেখলেন ডিজাইনের ফাঁকা জায়গায় লেখা রয়েছে, ‘‘যখন ছিলেম অন্ধ/ সুখের খেলায় বেলা গেছে পাইনি তো আনন্দ।/ খোলাঘরের দেওয়াল গেঁথে খেয়াল নিয়ে ছিলেম মেতে/ ভিত ভেঙে যেই এলে ঘরে ঘুচল আমার বন্ধ/ সুখের খেলায় আর রোচে না, পেয়েছি আনন্দ ...।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Chitraniva Chowdhury Santiniketan
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE