দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ দেশের জন্য ত্যাগ স্বীকার করতে শিখিয়েছিলেন। এই কারণেই মনে করি, ২০১৯ সালের ভারতে বসে, সঙ্কীর্ণ সাম্প্রদায়িক স্বার্থসিদ্ধির কার্যক্রম দেখতে দেখতে এই বাংলায় দেশবন্ধুর রাজনৈতিক উত্তরাধিকার পুনরুদ্ধার করা আমাদের জরুরি কর্তব্য।
১৮৭০-এর ৫ নভেম্বর ঢাকা বিক্রমপুর-বাসী পরিবারে চিত্তরঞ্জনের জন্ম। প্রেসিডেন্সি কলেজের কৃতী ছাত্র, আইসিএস পরীক্ষায় দু’বার অকৃতকার্য, মিডল টেম্পল থেকে ব্যারিস্টারি পাশ চিত্তরঞ্জন সক্রিয় রাজনীতি করেছিলেন মাত্র নয় বছর— ১৯১৭ থেকে ১৯২৫। তবে রাজনীতিতে তাঁর হাতেখড়ি অনেক আগে— বিলেতে দাদাভাই নওরোজির নির্বাচনী প্রচারে। স্বদেশি যুগে তাঁর ‘বন্দে মাতরম্’ পত্রিকা প্রতিষ্ঠায় অবদান এবং স্বদেশি নেতৃবৃন্দ বিপিনচন্দ্র পাল, ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় ও অরবিন্দ ঘোষের রাজনৈতিক মামলায় আদালতি নৈপুণ্যের জন্য খ্যাতি। ১৯০৯ সালের আলিপুর বোমা মামলায় চিত্তরঞ্জন অরবিন্দকে যে ভাষায় নন্দিত করেছিলেন— দেশপ্রেমের কবি, জাতীয়তাবাদের ভবিষ্যৎদ্রষ্টা, মানবিকতার প্রেমিক— তিনি সে দিন হয়তো বুঝতে পারেননি যে ঠিক এই কথাগুলিই তাঁর নিজের ক্ষেত্রেও সমান ভাবে প্রযোজ্য হয়ে উঠবে, এই ভাবেই পরবর্তী কালের ইতিহাস তাঁকে মনে রাখবে। বাস্তবিক, আজাদির সুমহৎ আদর্শের জন্য দেশবন্ধু যে ভাবে ত্যাগ ও দুঃখ স্বীকার করতে প্রস্তুত ছিলেন, তা আজ প্রায় কিংবদন্তিতে পরিণত।
১৯১৭ সালের এপ্রিলে কলকাতার ভবানীপুরে বঙ্গীয় প্রাদেশিক অধিবেশনে সভাপতি রূপে চিত্তরঞ্জনের সরাসরি রাজনৈতিক আত্মপ্রকাশ। সে বছর ‘মডার্ন রিভিউ’-তে রবীন্দ্রনাথের নেশন-বিরোধী বক্তৃতার বয়ান পড়ে চিত্তরঞ্জন প্রথম দিকে বিচলিত হয়েছিলেন। পরে তিনি কবির নেশন-চিন্তার মর্ম উপলব্ধি করে খানিকটা গ্রহণ করেছিলেন। চিত্তরঞ্জন স্বীকার করেন যে ‘‘জাতীয়তাবাদকে চরমে নিয়ে গেলে যে বাড়াবাড়ি ঘটে, তারই পরিণাম’’ প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। তিনি বিশ্বাস করতেন যে জাতীয় স্বাতন্ত্র্যকে মর্যাদা দিতে হবে। কিন্তু তিনি এও মনে করতেন যে ভবিষ্যতে বিশ্বমানবতার এমন একটা যুগ আসবে যখন ‘‘বিশ্বমণ্ডলের জন্য রাজারাজড়াদের মতই নেশন ও জাতীয়তারও আর কোনও প্রয়োজন থাকবে না।’’ আজকের দিনে জাতীয়তাবাদ শব্দটাকে যখন উত্তরোত্তর লঘু আর সারহীন করে ফেলা হচ্ছে, তখন তাঁদের এই সব ভাবনা মনে করার গুরুত্ব বিরাট।