Advertisement
E-Paper

ব্যক্তি বনাম রাষ্ট্র

ভারতের এই বহুত্বের সহিত নাগপুরের দীর্ঘ দিনের মোকদ্দমা। যে হিন্দুত্ববাদী ভারতের স্বপ্ন তাঁহারা দেখেন, সেই ভারতের ধর্ম হিন্দু, ভাষা হিন্দি, পোশাক সনাতন, খাদ্য উত্তর ভারতের হিন্দু উচ্চবর্ণের অভ্যাসের অনুরূপ।

শেষ আপডেট: ২৬ অগস্ট ২০১৭ ০০:০০

সুপ্রিম কোর্ট ব্যক্তিপরিসরের স্বাধীনতাকে মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি দেওয়ার পর নরেন্দ্র মোদীদের এখন অনেক কাজ। প্রথমত, তাঁহাদের বুঝাইয়া দিতে হইবে যে সরকার আগাগোড়া এই কথাটিই বলিতেছিল। দ্বিতীয়ত, এই রায়ের জন্য কৃতিত্ব যে তাঁহাদেরই, গণপরিসরে সেই সওয়ালও করিতে হইবে। এই ব্যস্ততার মধ্যেও তাঁহারা রায়টিকে নিবিড় ভাবে পড়িতে পারেন। দেখিবেন, রায়টিকে তাঁহাদের সরকারের কর্মপদ্ধতির কঠোরতম সমালোচনা হিসাবেও পাঠ করা সম্ভব। ব্যক্তিপরিসরের স্বাধীনতা যে দেশের বহুত্ববাদী চরিত্রের পক্ষে অপরিহার্য, আদালত স্মরণ করাইয়া দিয়াছে।

ভারতের এই বহুত্বের সহিত নাগপুরের দীর্ঘ দিনের মোকদ্দমা। যে হিন্দুত্ববাদী ভারতের স্বপ্ন তাঁহারা দেখেন, সেই ভারতের ধর্ম হিন্দু, ভাষা হিন্দি, পোশাক সনাতন, খাদ্য উত্তর ভারতের হিন্দু উচ্চবর্ণের অভ্যাসের অনুরূপ। আর কোনও ভারত তাঁহাদের নিকট অস্তিত্বহীন। দিল্লির মসনদে অধিষ্ঠিত হওয়া ইস্তক নাগপুর-কল্পিত হিন্দু-হিন্দি-হিন্দুস্থানের ভারতকে প্রতিষ্ঠা করাই নরেন্দ্র মোদীদের প্রধান কর্মসূচি হইয়াছে। মহম্মদ আখলাক হইতে জুনেইদ খানের হত্যামিছিল, এম এম কালবুর্গির খুন হইতে সুধীন্দ্র কুলকর্নির মুখে কালিমালেপন, অ্যান্টি রোমিও স্কোয়াড হইতে ‘লাভ জিহাদ’-এর প্রচার, কানহাইয়া কুমার-উমর খলিদদের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহের অভিযোগ দায়ের করা হইতে নন্দিনী সুন্দর-বেলা ভাটিয়াদের হেনস্তা, মাদ্রাসায় স্বাধীনতা দিবস উদ্‌যাপনের ভিডিয়ো সরকারের নিকট জমা করিবার ফতোয়া হইতে সর্ব স্তরে হিন্দি চাপাইয়া দেওয়ার গা-জোয়ারি— মোদীর শাসনকাল ভারতের বহুত্বের উপর নিরন্তর আক্রমণের আখ্যান। আদালতের রায় এই আক্রমণের বিপদের কথাটিই স্মরণ করাইয়া দিয়াছে।

ব্যক্তিপরিসরের অধিকার সর্বদাই জরুরি এবং গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু অতিকর্তৃত্ববাদী শাসনতন্ত্রের সম্মুখে এই অধিকারের মাহাত্ম্য তুলনাহীন। সুপ্রিম কোর্ট এই অধিকারটিকে মৌলিক অধিকারের পর্যায়ভুক্ত করিয়া রাষ্ট্রের সর্বগ্রাসী নিয়ন্ত্রণস্পৃহাকে প্রতিহত করিল। ব্যক্তিপরিসরের স্বাধীনতা আসলে রাষ্ট্রের ইচ্ছাকে অগ্রাহ্য করিয়া নিজের পছন্দে বাঁচিতে পারিবার স্বাধীনতা। খাদ্যাভ্যাস, যৌনতা, প্রণয়, পরিচ্ছদের স্বাধীনতা; নিজ নিজ বিশ্বাস, সংস্কৃতি, ধর্মের অনুশীলনের স্বাধীনতা— প্রয়োজনে ধর্ম পরিবর্তনের বা ত্যাগের স্বাধীনতাও বটে। কোনও প্রকৃত উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র এই প্রশ্নগুলি লইয়া ভাবিতই হইবে না। সেই রাষ্ট্র জানিবে, নাগরিক রাষ্ট্রের ভৌগোলিক ও প্রশাসনিক আওতায় থাকেন বটে, কিন্তু রাষ্ট্রের নিকট তাহার মালিকানা নাই। নাগরিকের সহিত রাষ্ট্রের সম্পর্কের নিজস্ব পরিসর আছে— তাহার বাহিরে নাগরিককে নিয়ন্ত্রণ করিবার অধিকার রাষ্ট্রের নাই। নিজের অধিকারের সীমাবদ্ধতা স্বীকার করিবার মতো জোর যে রাষ্ট্রের গণতন্ত্রে নাই, কিন্তু গণতন্ত্রের আব্রু রক্ষার একটি চেষ্টা আছে, সেখানেও স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে রাষ্ট্র নাগরিকের এই অধিকারগুলি লঙ্ঘন করে না। আর, অতিকর্তৃত্ববাদী শাসনতন্ত্রে ঘর ওয়াপসি ঘটে, ধর্ষণের ঘটনাকে নারীস্বাধীনতার অপব্যবহারের সহিত কার্যকারণ সম্পর্কে জুড়িয়া দেওয়া হয়। এই বাস্তবে সুপ্রিম কোর্টের রায়টি কী বিপুল তাৎপর্যপূর্ণ, অবসর পাইলে নরেন্দ্র মোদীরা ভাবিয়া দেখিতে পারেন।

Right to privacy Supreme Court Religion Fundamental Rights মৌলিক অধিকার
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy