শ্রীযুক্তা নুসরত জহান বিরক্ত হইয়াছেন। লোকসভায় যখন নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল লইয়া ভোট চলিতেছিল, তখন তৃণমূল কংগ্রেসের আট সাংসদ— যে তালিকায় নুসরত, দেব, মিমি চক্রবর্তীরা আছেন— অনুপস্থিত ছিলেন। তাহাতে স্বভাবতই প্রশ্ন উঠিয়াছে। নুসরত সেই প্রশ্নে বিরক্ত হইয়া বলিয়াছেন, মানুষ নিজের চরকায় তেল দিলে পৃথিবীটা কম বিরক্তিকর হয়। তাঁহাকে জানানো প্রয়োজন, মানুষ সম্পূর্ণত নিজেদের চরকাতেই তেল দিতেছেন। বস্তুত, ইহার অধিক গুরুত্বপূর্ণ এবং ব্যক্তিগত চরকার খোঁজ পাওয়া মুশকিল। মানুষ যাঁহাদের জনপ্রতিনিধি করিয়া সংসদে পাঠাইয়াছেন, তাঁহারা সংসদে আদৌ উপস্থিত আছেন কি না, এই খোঁজ লওয়া প্রত্যেক নাগরিকের গণতান্ত্রিক অধিকার এবং কর্তব্য। দুর্ভাগ্য, এক জন সাংসদকে এই কথাটি বলিয়া দিতে হইতেছে। আরও দুর্ভাগ্য, গণতন্ত্র সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা না থাকা লইয়া তিনি লজ্জিত নহেন— তিনি টুইট করিয়া নিজের বিরক্তি প্রকাশ করিতে পারেন। নুসরত লোকসভায় আলোচনার সময় ছিলেন, কিন্তু ভোটের সময় নহে। হয়তো বিষয়টিকে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ বোধ করেন নাই বলিয়াই। নিজের অনুপস্থিতির ব্যাখ্যা না দিলেও দেব এবং মিমি চক্রবর্তী সম্বন্ধে তিনি জানাইয়াছেন, তাঁহারা শুটিংয়ে ব্যস্ত ছিলেন— এবং, সেই কাজটি তাঁহাদের ‘বাড়তি দায়িত্বের মধ্যে খুব গুরুত্বপূর্ণ’। শুটিং করাকে যখন তাঁহারা ‘বাড়তি দায়িত্ব’ রূপেই জানেন, তখন সাংসদ হিসাবে তাঁহাদের মূল দায়িত্বটি কী? সংসদে উপস্থিত থাকা, দেশের নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে বিভিন্ন তর্কে অংশগ্রহণ করা ইত্যাদি তাঁহাদের দায়িত্বের কোন শ্রেণিতে পড়ে?
যে কোনও সাংসদের প্রথম এবং প্রধান দায়িত্ব, অধিবেশন চলাকালীন সংসদে উপস্থিত থাকা, তর্কে অংশগ্রহণ করা। তাঁহাদের মাধ্যমেই জনসাধারণ দেশের নীতিনির্ধারণের প্রক্রিয়ায় সংযুক্ত হন। কাজেই, অধিবেশন চলাকালীন আর অন্য কোনও কাজই ‘খুব গুরুত্বপূর্ণ’ বিবেচিত হইতে পারে না। শুটিং-ও নহে, মুখ্যমন্ত্রীর অনুষ্ঠানের আয়োজন করাও নহে। বিশেষত, সংসদে যখন নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলের ন্যায় বিষয় লইয়া তর্ক চলিতেছে, তখন। এই বিলটি যে ভারতের মৌলিক চরিত্র বদলাইয়া দিতে চলিয়াছে, এবং সেই বদলের বিপক্ষে (বা, পক্ষে) অবস্থান গ্রহণ করা এক জন জনপ্রতিনিধির কর্তব্য— বিশেষত, তাঁহার দল যখন সংসদের ভিতরে ও বাহিরে এই বিলের তীব্র বিরোধিতা করিতেছে— এই কথাগুলি প্রত্যেক সাংসদেরই জানা কর্তব্য। ইহা রাজনীতির প্রশ্ন নহে— গণতন্ত্রের প্রশ্ন। তাঁহারা শুধুমাত্র দলের প্রতিনিধি নহেন, মানুষের প্রতিনিধি। কাজেই, অধিবেশনে উপস্থিত না থাকিয়া, এই বিপুল গুরুত্বপূর্ণ তর্ক হইতে সম্পূর্ণ বিযুক্ত থাকিয়া তাঁহারা মানুষের ভরসার অমর্যাদা করিলেন। শুটিংয়ের সহিত যুক্ত তিনশত মানুষের তুলনায় অনেক, অনেক বেশি মানুষের ভরসার অমর্যাদা। কে কোন কাজটিকে গুরুত্ব দিবেন, তাহা নিতান্তই ব্যক্তির নিজস্ব সিদ্ধান্তের প্রশ্ন। কাহারও মনে হইতেই পারে যে সংসদের নীরস আলোচনার তুলনায় শুটিং অনেক বেশি আকর্ষক। তাঁহারা নির্দ্বিধায় শুটিং করুন, কিন্তু সে ক্ষেত্রে তাঁহাদের সাংসদ থাকিবার অধিকার নাই। দল যেমনই ভাবুক না কেন, গণতন্ত্র বস্তুটি ছেলেখেলার নহে। মানুষের প্রতিনিধিত্বের প্রশ্নটিকে এই রকম খেলো করিবার অধিকার কাহারও নাই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy