E-Paper

ফল-আনাজের বিদেশি বাজার

এর অন্যতম কারণ নীতির রূপায়ণে সরকারের অনাগ্রহ। কেন্দ্রীয় সরকার কৃষি রফতানি নীতি (২০১৮) প্রকাশ করার পরে রাজ্যগুলিকে নির্দেশ দেয় নিজস্ব নীতি রূপায়নের।

অঙ্কুশ সাহা

শেষ আপডেট: ১৭ ডিসেম্বর ২০২৫ ০৭:৪২

পশ্চিমবঙ্গ সরকারের খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, শিল্প ও উদ্যান পালন দফতর ‘এগিয়ে বাংলা’ ওয়েবসাইটে মাশরুম চাষে প্রশিক্ষণের আবেদন আহ্বান করে জানিয়েছে, এটি লাভজনক উদ্যোগ। অনেকে আগ্রহও প্রকাশ করেছেন। বাস্তব পরিস্থিতি অবশ্য অন্য রকম। বাঁকুড়া, মেদিনীপুর, বীরভূম, নদিয়া, দক্ষিণ ২৪ পরগনা প্রভৃতি জেলার বহু চাষির অভিযোগ যে, তাঁদের মাশরুম, ড্রাগন ফল স্থানীয় বাজারে দাম পাচ্ছে না। বিশ্বে মাশরুমের বাজার দখল করেছে চিন, আর ড্রাগন ফলের বাজার ধরে রেখেছে তাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম।

অভিজ্ঞতা বলে যে, বাজার না জেনে-বুঝেই সরকারি আমলারা বিশেষ বিশেষ ফসল ফলানোর পরামর্শ দেন। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চাষির ফসল বাজার ধরবে কী ভাবে, তার কোনও পথ দেখান না। বিশেষ করে রফতানির প্রতি যেন বিপুল অনাগ্রহ সরকারের। পশ্চিমবঙ্গ আনাজ উৎপাদনে ভারতে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে, উত্তরপ্রদেশের পরেই। আম উৎপাদনে ষষ্ঠ। অথচ, এগুলির রফতানিতে সব রাজ্যের মধ্যে শেষের দিক থেকে দ্বিতীয় বা তৃতীয় স্থানে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ।

এর অন্যতম কারণ নীতির রূপায়ণে সরকারের অনাগ্রহ। কেন্দ্রীয় সরকার কৃষি রফতানি নীতি (২০১৮) প্রকাশ করার পরে রাজ্যগুলিকে নির্দেশ দেয় নিজস্ব নীতি রূপায়নের। ২০২২ সালে বিশ্ব বাণিজ্য সম্মেলনে পশ্চিমবঙ্গের কৃষি রফতানি নীতি প্রকাশ করে কৃষি বিপণন দফতর। আজও সে নীতি বলবৎ হয়নি। এ নিয়ে কৃষি বিপণন দফতরের সঙ্গে লাগাতার আলোচনার পর ২০২৪ সালের শেষে রফতানিকারীরা জানতে পারেন যে, অনেক আগেই (অক্টোবর, ২০২৩) রাজ্য সরকার বিজ্ঞপ্তি জারি করে কৃষিপণ্য রফতানির দায়িত্ব দিয়েছে শিল্প, বাণিজ্য ও উদ্যোগ দফতরকে। ওই বিভাগের ‘নোডাল অফিসার’ জানান, রফতানিতে আগ্রহী চাষিদের নথিভুক্তি করবে উদ্যান পালন দফতর; ফসলের মান পরীক্ষা, প্যাকেজিং প্রভৃতি পরিকাঠামোর ব্যবস্থা করবে কৃষি বিপণন দফতর। ব্যবসায়ীরা কোনও সমস্যা নিয়ে এলে তিনি কেবল সেটি নির্দিষ্ট বিভাগে পাঠিয়ে দেবেন।

উদ্যান পালন দফতর প্রথমে আগ্রহ দেখালেও পরে জানিয়ে দেয় যে, রফতানির সঙ্গে যুক্ত দু’টি কেন্দ্রীয় সংস্থার (শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রকের অধীন ‘এগ্রিকালচারাল অ্যান্ড প্রসেসড ফুড প্রোডাক্টস এক্সপোর্ট ডেভলপমেন্ট অথরিটি’ এবং কৃষি মন্ত্রকের অধীন ‘ডিরেক্টরেট অব প্লান্ট প্রোটেকশন কোয়ারেন্টাইন অ্যান্ড স্টোরেজ’) পক্ষ থেকে কোনও সহযোগিতা করা হচ্ছে না রাজ্য সরকারের সঙ্গে। আজ অবধি রাজ্য সরকার তার নিজের নীতি কার্যকর করতে পারেনি। ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, নির্দিষ্ট নীতি না থাকায় রফতানি নিয়ামক কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলি যথেচ্ছ শর্ত দেখিয়ে পশ্চিমবঙ্গের আনাজ, ফল ইউরোপে রফতানিতে বাধা দিচ্ছে। অথচ, এ রাজ্যের কাঁকরোল, লঙ্কা, করলা অন্য রাজ্য থেকে রফতানি হচ্ছে বিনা বাধায়।

কৃষি বিপণন দফতরের রফতানি সংক্রান্ত নীতিতে বলা হয়েছে যে, কৃষকদের সচেতন করা হবে যাতে কীটনাশকের প্রয়োগ বিধিসম্মত ভাবে হয়। ফসল-ভিত্তিক তথ্যভান্ডার তৈরি করা হবে কৃষক নথিভুক্তির মাধ্যমে, যাতে বোঝা যায় পাতের ফসল কোন খেতে তৈরি হয়েছে। ফসল নিরাপত্তার মানপত্রের (ফাইটোস্যানিটারি সার্টিফিকেট) ব্যবস্থাও করবে রাজ্য। উন্নত মানের ল্যাবরেটরি, জেলা-ভিত্তিক ‘এক্সপোর্ট ক্লাস্টার’ গঠন, ব্যবসায়ী, চাষি ও সরকারি আধিকারিকদের সংযোগ দ্রুত ও তৎপর করতে ব্লক, জেলা ও রাজ্যস্তরে বিশেষ ‘সেল’ গঠন, এ সবই ছিল নীতিতে। এই নীতি কার্যকর হলে পশ্চিমবঙ্গের কৃষিজ রফতানি এক লাফে অনেকটা বেড়ে যেতে পারত। তাতে চাষির লাভ বাড়ার পাশাপাশি তৈরি হত অনেক নতুন কাজ— পণ্যবাহী গাড়ি, নানা ধরনের প্যাকেজিং তৈরি ও সরবরাহ, দফতরের নিয়মিত কর্মী প্রভৃতি।

রাজ্য সরকার চাষির আয় বাড়ানোর জন্য নতুন নতুন ফসল উৎপাদনে উৎসাহ দিচ্ছে। কিন্তু ভারতের কৃষি-সঙ্কট থেকে এত দিনে স্পষ্ট যে, ফসল ফলালেই কৃষকের লাভ হয় না। সেই ফসলকে যথাযথ ভাবে বাজারজাত করার ব্যবস্থা করা দরকার। তার দায় রাজ্যেরও। যদিও রফতানির ব্যবস্থাপনা করা কেন্দ্রীয় সরকারের দায়, কিন্তু কৃষিপণ্যের ক্ষেত্রে সেটা রাজ্য সরকারেরও দায় হয়ে ওঠে। কারণ আমাদের দেশের সংবিধান অনুযায়ী সঠিক গুণমানের ফসল উৎপাদনের বিষয়টি রাজ্য সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন।

পশ্চিমবঙ্গ থেকে আনাজ ও ফলের নিয়মিত রফতানি করতে চাইলে প্রয়োজন ফসলে কীটনাশকের পরিমাণ মাপার জন্য উন্নত মানের ল্যাবরেটরি। ফলের মধ্যে ঢুকে থাকা কীট প্রভৃতি নির্মূল করার জন্য ‘ইররেডিয়েশন ট্রিটমেন্ট প্লান্ট’, যা আমেরিকা, নিউ জ়িল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া প্রভৃতি দেশে কৃষি পণ্য পাঠানোর জন্য আবশ্যক। জাপানের বাজার ধরতে হলে চাই ‘ভেপার হিট ট্রিটমেন্ট প্লান্ট’। নানা ধরনের পণ্যের প্যাকেজিং করা যায়, এমন প্যাক হাউস। এই সব পরিকাঠামো তৈরির পাশাপাশি চাষিদের প্রশিক্ষণও জরুরি। ওড়িশায় চাষিরা প্রশিক্ষণ পেয়েছেন বলে আম তোলার পর এমন ভাবে বাখারির উপর রাখেন যাতে কষ ঝরে যায়, আমের গায়ে দাগ হয় না। আমাদের চাষিরা এখনও সে প্রশিক্ষণ পাননি, তাই বাংলার আমের গায়ে কালো কালো দাগ হয়ে যায়।

চাষ লাভজনক অবশ্যই হতে পারে, তার অন্যতম উপায় রফতানি নীতিকে কার্যকর করা। তার জন্য নানা দফতরের যে সমন্বয় ও তৎপরতা প্রয়োজন, তা এখনও দেখা যাচ্ছে না।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

China Vietnam

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy