Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

অবিমৃশ্যকারিতা

আশিস অবশ্য ব্যতিক্রম নহেন। বন্যহাতির সামনে পড়িয়া প্রাণ হারাইয়াছেন, এমন অত্যুৎসাহীর সংখ্যা বড় কম নহে। সমস্যা হইল, বন্যপ্রাণীর ছবি তুলিবার ক্ষেত্রে শুধুমাত্র শখই যথেষ্ট নহে। জঙ্গলে সেই শখ পূরণ করিতে হইলে কিছু নিয়মকানুন মানিতে হয়।

—ফাইল ছবি

—ফাইল ছবি

শেষ আপডেট: ০৭ নভেম্বর ২০১৯ ০০:০১
Share: Save:

বন্যেরা বনে সুন্দর। কিন্তু থাকিতে দিতেছে কে? বন্যপ্রাণীর নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে মানুষের নিত্য আনাগোনা। কখনও পেশার প্রয়োজনে, কখনও শুধুই নেশার কারণে। স্বাভাবিক ভাবেই সংঘাত অনিবার্য হইতেছে বন্যপ্রাণীদের সঙ্গে। আইন করিয়া, সংরক্ষিত বনাঞ্চল নির্মাণ করিয়াও প্রাণিহত্যা বন্ধ হয় নাই। আবার, অবাঞ্ছিত অনুপ্রবেশে তিতিবিরক্ত পশুরা আক্রমণ করিতেছে মানুষকে। যেমন, আশিস শীট আতাডিহার জঙ্গলে ঢুকিয়াছিলেন হাতির ছবি তুলিতে। সেই অবিমৃশ্যকারিতার চরম মূল্য দিতে হইয়াছে তাঁহাকে। ছবি তুলিবার সময় দাঁতালের আক্রমণে প্রাণ হারাইয়াছেন আশিস।

আশিস অবশ্য ব্যতিক্রম নহেন। বন্যহাতির সামনে পড়িয়া প্রাণ হারাইয়াছেন, এমন অত্যুৎসাহীর সংখ্যা বড় কম নহে। সমস্যা হইল, বন্যপ্রাণীর ছবি তুলিবার ক্ষেত্রে শুধুমাত্র শখই যথেষ্ট নহে। জঙ্গলে সেই শখ পূরণ করিতে হইলে কিছু নিয়মকানুন মানিতে হয়। অরণ্যের নিজস্ব নিয়ম। মানিতে না চাহিলে চিড়িয়াখানায় যাওয়াই শ্রেয়। সেখানে আবদ্ধ জায়গায় যথেচ্ছ ছবি তুলিবার, পশুপাখিদের আচরণ লক্ষ করিবার সুযোগ পাওয়া যায়। প্রতি-আক্রমণের ভয় থাকে না। কিন্তু জঙ্গলে, যাহা বন্যপ্রাণীদের নিজস্ব এলাকা, সেখানে যে কোনও সময় প্রবেশ করা, প্রাণীদের বিরক্ত করিবার মতো কাজগুলি বন্যপ্রাণীদের নিকট আক্রমণের সমান। আত্মরক্ষার প্রয়োজনে তাহারা তখন প্রতি-আক্রমণের পথ লয়। সেই কারণে সুন্দরবনের গভীরে মাছ, কাঁকড়া ধরিতে যাওয়া, মধু আহরণে যাওয়া মানুষদের বাঘে টানিয়া লইয়া যাইবার খবর প্রায়শই শুনা যায়। জঙ্গলে যাইবার অনুমতিপত্রটুকুও অনেকের থাকে না বলিয়া সরকারি ভাবে নিহতের খাতায় নাম উঠে না, ক্ষতিপূরণটুকুও জুটে না। দৈবাৎ গ্রামে ঢুকিয়া আসা চিতাবাঘ দেখিতে যাইবার সময় সেই বাঘেরই আক্রমণে জখম হইবার সংখ্যাটিও তুচ্ছ নহে। প্রাত্যহিক জীবনে বন্যহাতির সঙ্গে সাধারণ মানুষের সাক্ষাতের সম্ভাবনা অন্য প্রাণীদের তুলনায় বেশি। সুতরাং, উভয়ের মধ্যে সংঘাতের ঘটনাও অধিক। ফসল বাঁচাইতে গ্রামবাসীরা নানা ভাবে হাতিদের উপর অত্যাচার করিয়া থাকেন। ক্যামেরার ফ্ল্যাশ ব্যবহার করিয়া ছবি তুলিতে ব্যস্ত আশিসকে হাতির দল হয়তো আক্রমণকারীই ভাবিয়াছিল।

আশিসের পরিণতি নিঃসন্দেহে মর্মান্তিক। কিন্তু এই পরিণতি ঠেকাইতে হইলে নিজ দায়িত্ববোধটুকুও জাগাইয়া তোলা প্রয়োজন। দায়িত্ব ইহাই যে, শখ থাকিলেও কাণ্ডজ্ঞান বিসর্জন দেওয়া চলিবে না। বিশেষত যে প্রাণীর ব্যবহার সম্পর্কে সাধারণ জ্ঞানের ভাণ্ডারটি বৃহৎ নহে, সেখানে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখাই বুদ্ধিমানের কাজ। নিজ নিরাপত্তার খাতিরেই। আশিস সেই দায়িত্ববোধের পরিচয় দেন নাই। দায়িত্বের পরিচয় পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কাজের মধ্যেও দেখা যায় না। অরণ্য এবং মানুষের বাসস্থানের মধ্যের সীমারেখাটি যে ক্রমেই অন্তর্হিত হইতেছে, তাহা দেখিয়াও সরকারি তরফে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা করা হয় নাই! জনবসতি ক্রমশ জঙ্গলের ‘কোর এরিয়া’র দিকে ধাবমান। গভীর অরণ্যের প্রাণীরাও মানুষের লোভ এবং আগ্রাসনের মুখে অসহায়, আত্মরক্ষার্থে মরিয়া। এই লড়াই বড় অসম লড়াই। বন্যপ্রাণীদের সংখ্যা যে-রূপে হ্রাস পাইতেছে, তাহাতে মানুষের সঙ্গে লড়িয়া জিতিবার সম্ভাবনা তাহাদের প্রায় নাই। সেই দুর্দিন এত শীঘ্র না আসিলেই ভাল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Elephant Environment Wild Life Wild Animal
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE