মহাত্মা গাঁধীর জন্মের দেড়শো বছর পরেও তাঁর চিন্তার প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে কোনও প্রশ্ন উঠতে পারে। তবে কিনা, সাধারণত প্রাসঙ্গিকতার প্রশ্নে গাঁধীচিন্তার যে সব দিকের ওপর নজর পড়ে, তার মধ্যে তাঁর অহিংসা ভাবনা, পরিবেশ চিন্তা কিংবা ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ বিষয়ক মতামতই বেশি গুরুত্ব পেয়ে থাকে। জাত বিষয়ে গাঁধীর চিন্তার আলোচনা হলেও তাকে বিশেষ প্রাসঙ্গিক মনে করা হয় না। সম্ভবত এর কারণ, অম্বেডকর এবং জাতের প্রশ্নে তাঁর সমালোচনার ঐতিহাসিক ‘প্রস্থান’। অর্থাৎ গত পঞ্চাশ বছরে অম্বেডকরের চিন্তাসূত্র অনেকের বিশ্লেষণে পুষ্ট হয়েছে, এবং সঙ্গত কারণেই আমাদের দৃষ্টি সেই দিকে পড়েছে— অথচ নানা বৈপরীত্য সত্ত্বেও গাঁধী ও অম্বেডকরের জাতবিষয়ক চিন্তায় যে সাদৃশ্য আছে, সমকালীন ভারতে তার একটা ঐতিহাসিক তাৎপর্য থাকা সত্ত্বেও সেই তুলনামূলক আলোচনা হয়েছে কম।
সাম্প্রতিক একটি ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এই আলোচনা শুরু করা যেতে পারে। সম্প্রতি তথাকথিত উচ্চবর্ণের সংরক্ষণের আইন তৈরি হল। বিষয়টি এখন সুপ্রিম কোর্টের বিচারাধীন। প্রসঙ্গত লোকসভায় এ বিষয়ে যখন বিতর্ক হয়, তাতে অম্বেডকর কয়েক বার উল্লিখিত হয়েছেন, কিন্তু গাঁধী এক বারও হননি। সরকার ও বিরোধী পক্ষের সব দলই (তামিলনাড়ুর দু’টি দল ছাড়া) শেষ পর্যন্ত ওই সংরক্ষণ সমর্থন করেছে। জাত-অবস্থানের ভিত্তি কি শুধুই সামাজিক-সাংস্কৃতিক, না কি অর্থনৈতিকও— সেই প্রসঙ্গও বার বার উঠেছে। লোকসভা টিভিতে ওই বিতর্কের অংশবিশেষ দেখলাম, এআইএডিএমকে-র নেতা তাম্বিদুরাই-এর ভাষণও শুনলাম। আইনের বিরোধিতায় তাম্বিদুরাই বলেছিলেন, ‘‘অর্থনৈতিক অবস্থান পাল্টাতে পারে, কিন্তু জাতপাত একই জায়গায় থাকবে, আজ থেকে পাঁচ হাজার বছর পরেও।’’ তাম্বিদুরাইকে চিনতাম সত্তরের দশকের মাঝামাঝি চেন্নাইয়ে তাঁর ছাত্রাবস্থা থেকে। বুঝলাম ওঁর মতামত, ওঁর দলের মতামত সেই সময় থেকে একটুও পাল্টায়নি। কিন্তু গাঁধী ও অম্বেডকরও কি তা-ই বিশ্বাস করতেন? জাত-অবস্থানকে একটা অপরিবর্তনশীল ঐতিহাসিক ঘটনা হিসেবে দেখতেন?
প্রথমেই গাঁধীর কথায় আসা যাক। যে হেতু গাঁধী প্রচুর লিখেছেন (শতাধিক খণ্ডে বিধৃত তাঁর রচনাবলি), তাঁর মতের মধ্যে ভিন্নতাও প্রায়শ লক্ষিত হয়। এই বিষয়ে তাঁর মন্তব্য ছিল, কোনও ভিন্নতা কিংবা অস্পষ্টতার নিরসনে তাঁর পরবর্তী কালের রচনাটিই দ্রষ্টব্য হওয়া উচিত। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে, জাত-প্রশ্নে গাঁধীর মতামত নাটকীয় ভাবে পাল্টেছে। এক সময় তাঁকে হিন্দুধর্মের বর্ণাশ্রম প্রথার সমর্থক হিসেবে এবং ভিন্ন জাত বা ভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে বিবাহের সমালোচক হিসেবে দেখা গিয়েছিল। কিন্তু ১৯৩০-এর পরে তাঁর এই মতের আমূল রূপান্তর ঘটে। বর্ণাশ্রম আর তাঁর কাছে কোনও মৌলিক বিষয় হিসেবে থাকে না। তিনি ভিন্ন জাত ও ভিন্ন ধর্মের বিবাহের সমর্থক হয়ে ওঠেন। নিশিকান্ত কোলগে অবশ্য গাঁধীর জাতপাত চিন্তায় এক কৌশলী অবস্থান লক্ষ করেন, রাজনীতির এক সদর্থক অবস্থান হিসেবে। ফলে এই কৌশল বা স্ট্র্যাটেজিকে কোলগে নিন্দার্থে দেখেন না। গাঁধীর জাতীয়তাবাদী চিন্তার অংশ হিসেবেই উপস্থাপিত করেন।