Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
স্বার্থপরতা না থাকলে যে ভোগবাদের বাঁচা কঠিন

যা চাই, তা কিনতে পারার নামই নিজেকে ভালবাসা

কালীপুজো এলেই যেমন চকলেট বোমা কিনতে ইচ্ছে করে। শব্দবাজি নিষিদ্ধ, কিন্তু তাতে কী? নিজেকে কষ্ট দিতে নেই। অতএব, বাজির দোকানে গিয়ে মৃদু হেসে ‘আছে না কি?’ জিজ্ঞেস করলেই হয়।

বিষ-আনন্দ: রংমশালের ধোঁয়ায় দূষিত হচ্ছে পরিবেশ, জানার পরও আমরা সন্তানের হাতে তুলে দিই এমন বাজি।

বিষ-আনন্দ: রংমশালের ধোঁয়ায় দূষিত হচ্ছে পরিবেশ, জানার পরও আমরা সন্তানের হাতে তুলে দিই এমন বাজি।

অমিতাভ গুপ্ত
শেষ আপডেট: ২১ অক্টোবর ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

কনজিউমারিজম শিক্ষাগুরু। সেই মোকামেই যাত্রা শুরু। কাজেই, কী ভাবে ভালবাসতে হয়, সেই পাঠটিও আমরা বিলক্ষণ ভোগবাদের পাঠশালাতেই শিখেছি। ভালবাসার প্রধানতম— সম্ভবত একমাত্র— প্রকাশ হল কিনে দিতে পারা। বউকে হিরের আংটি, বৃদ্ধ বাপ-মাকে ডিসনিল্যান্ডের টিকিট, বাচ্চাকে টুথপেস্ট থেকে স্পেসশিপ, সব কিছু। টিভির যে কোনও চ্যানেল চালিয়ে আধ ঘণ্টাটাক দেখলেই দিব্যজ্ঞান লাভ হবে। বাপ মা ভাই বোন বেয়াই বোনাই জগাই মাধাই, সবার চেয়ে মানুষ যাকে বেশি ভালবাসে, সেই নিজেকে ভালবাসার পথটিও অতএব কিনে দিতে পারা দিয়েই যায়। নিজের যা চাই, যখন চাই, সেটা কিনে দিতে পারলেই ভালবাসা যায় নিজেকে।

কালীপুজো এলেই যেমন চকলেট বোমা কিনতে ইচ্ছে করে। শব্দবাজি নিষিদ্ধ, কিন্তু তাতে কী? নিজেকে কষ্ট দিতে নেই। অতএব, বাজির দোকানে গিয়ে মৃদু হেসে ‘আছে না কি?’ জিজ্ঞেস করলেই হয়। আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে বোমা, শেল, কালীপটকা। তার পর পাড়া কাঁপিয়ে আনন্দ চলবে। গভীর রাতের পিলে চমকানো আওয়াজে কেঁদে উঠবে পাশের বাড়ির সদ্যোজাত, আঁতকে উঠবেন হৃদরোগী, কিন্তু ফুর্তি হবে খুব। আর, ফুর্তি মানেই তো ভাল থাকা, নিজেকে ভালবাসা।

যদি বলেন, বোধের অভাব, পাল্টা বলব, এ এক অন্য বোধ। ভোগবাদের বোধ। ভোগবাদের দর্শনে ক্রেতাই সব। তার ভাল থাকাই শেষ কথা, তার পছন্দই শ্রেষ্ঠ। এই দর্শন শুধু নিজেকে নিয়ে ভাবতে শেখায়। না হলে যে মুশকিল। মানুষ যদি নিজেকে ছাপিয়ে ভাবতে আরম্ভ করে পরিবেশ নিয়ে, তা হলে কি বিক্রি হবে কোটি কোটি গাড়ি আর এয়ার কন্ডিশনার? ক্রেতা যদি মার্বেলের মেঝেতে দেখতে পান সিলিকোসিসে ভোগা শ্রমিকদের মুখচ্ছবি, হাতের মুঠোয় ধরা মোবাইল ফোনে ভেসে ওঠে চিনের কোনও এক সোয়েটশপে অমানুষিক পরিশ্রম করতে থাকা মানুষের চেহারা, যদি ঠান্ডা পানীয়র বোতল খোলার সঙ্গে সঙ্গে জলের অভাবে ফুটিফাটা খেত আর হেরে যাওয়া কৃষকের গল্প ভসভসিয়ে বেরিয়ে আসতে থাকে, ধাক্কা খাবে না ভোগবাদ? কাজেই, নিজের বাইরে দেখতে পারার ক্ষমতাটাকে একেবারে পিষে মেরে ফেলা ভোগবাদের বেঁচে থাকার জন্য খুব জরুরি। ভাল থাকা মানে যে শুধু নিজে ভাল থাকা, এই কথাটা তাই আধুনিক সভ্যতার মনে গেঁথে দিয়েছে পুঁজি। বিপণন। আর, মানুন অথবা না-ই মানুন, স্বার্থপরতা মানুষের মৌলিক ধর্ম। সমাজ যদি সেই ধর্মটাকে স্বীকৃতি দেয়, তা হলে আর পিছন ফিরে দেখার দরকার পড়ে না। স্বার্থপর হওয়া ভাল, তাতে কোনও লজ্জা নেই— পুঁজিবাদ নিজের স্বার্থে এই কথাটা শিখিয়েছিল। আর, এই কথাটার জন্যই তা গোটা দুনিয়ার সার্বভৌম দর্শন হয়ে উঠতে পেরেছে।

চকলেট বোমা ফাটাতে ভোগবাদের শিবের গীত কেন, জিজ্ঞেস করতে পারেন। সহজ উত্তর— স্বার্থপরতার দর্শনটি শুধু বাজারের পরিসরে আটকে থাকে না। শুধু নিজের কথা ভাবতে পারার স্বাধীনতার এমনই টান যে তাতে ঢুকে যায় গোটা দুনিয়া। আমার ভাল লাগার চেয়ে, বস্তুত আমার চেয়ে, গুরুত্বপূর্ণ যে আর কিছু হতে পারে, সে কথাটাই উবে যায় মন থেকে। অবশ্য, রাষ্ট্রের একটা দায় থেকে যায় এখানে। এই বেলাগাম আত্মসর্বস্বতাকে যে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, আর যে রাষ্ট্র পারে না— দুটো ভিন্ন পথে চলতে থাকে। গুরুত্বপূর্ণ পথ। যে রাষ্ট্র মানুষকে অন্যের কথা ভাবতে বাধ্য করতে পারে, সেখানে এক সময় আর বাধ্যতার প্রয়োজন থাকে না, মানুষ নিজের অভ্যাসেই গাড়ি থামিয়ে রাস্তা ছেড়ে দেয় পথচারীকে, ময়লা ফেলার জন্য নির্দিষ্ট গা়ড়ি আসার অপেক্ষা করে।

সামাজিক পরিসরে স্বার্থপরতা কি তৃতীয় বিশ্বের কিছু দেশের নিজস্ব গল্প? যেখানে, অন্যের কথা না ভাবার মধ্যে নিজের ক্ষমতা জাহির করার আখ্যানও লুকিয়ে থাকে? প্রশ্নটা ভেবে দেখাই যায়। পশ্চিমবঙ্গে তো শব্দবাজি নিষিদ্ধ। তবুও যাঁরা রাত কাঁপিয়ে বাজি ফাটিয়েছেন, তাঁদের আনন্দ কি শুধু সেই শব্দটুকুতেই? না কি, তার পিছনে থাকা অন্য এক প্রদর্শনীতে— আমি এতটাই ক্ষমতাবান যে পুলিশের, প্রশাসনের সাধ্য নেই আমায় নিয়ম মানতে বাধ্য করতে পারার? পুলিশ আমায় শাসন করতে এলে আমার ক্ষমতা আছে থানার বড়বাবুকে সেই ফোনটা করানোর, যার পরে আমার দিকে চোখ তুলে কথা বলার সাহস পুলিশের থাকবে না। অথবা, আমার বাড়ির আবর্জনা পাশের বাড়ির দরজায় ফেলে এলে সেই পড়শির ক্ষমতা হবে না আমায় প্রশ্ন করার। নিজেকে ভালবাসার সম্ভবত এটাও একটা উপায়— প্রতি মুহূর্তে নিজেকে মুগ্ধ করে রাখা নিজের ক্ষমতায়।

নিজেকে ভালবাসা আর সম্মান করা কি এক? লোকের সমীহ অথবা ভীতি আদায় করে নেওয়া নয়, একান্ত মুহূর্তে নিজের চোখে চোখ রাখতে পারার ক্ষমতাটুকু কি এই পথে অর্জন করা যায়? না কি, বাজির দোকানদারের সঙ্গে সান্ধ্য ভাষার আদানপ্রদানে, বাতাসে তীব্র কার্বন মনোক্সাইড মিশিয়ে দেওয়া গাড়িতে লং ড্রাইভে যাওয়ার পথে, ব্যবহার করা পলিথিনের প্যাকেট নর্দমার মুখে জমা হওয়ার সময়, প্রতি মুহূর্তে, সেই আত্মসম্মান ক্ষয়ে যেতে থাকে? শেষ অবধি তার অস্তিত্ব মিলিয়ে যায় হাওয়ায়? কারণ, নিজেদের তুমুল ভালবাসতে বাসতেও আমরা জানি, কোনও একটা চোখে আমার জন্য ঘৃণা রয়েছে। কোনও এক অসহায় বৃদ্ধ কানে বালিশ চাপা দেওয়ার ব্যর্থ প্রচেষ্টার পর আমায় প্রশ্ন করছেন নিজের মনে। যে পথশিশুটিকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে পার্কে নিজের সন্তানের জন্য দোলনা খালি করে দিয়েছি, সেই শিশুটির চোখ আমায় দেখছে। বলছে, তোমার ক্ষমতা থাকতে পারে, কিন্তু সম্মানের যোগ্য তুমি নও।

সামাজিক পরিসরে, যেখানে এই মানুষগুলোর মুখ দেখা যায় প্রত্যক্ষ ভাবে, সেখানে তবুও দ্রুত দেখতে পাওয়া যায় আহত চোখগুলোকে। কিন্তু, যেখানে বাজার আড়াল তৈরি করে রাখে? যেখানে চমৎকার জামা হাতে নিলেও দেখতে পাওয়া যায় না তার পিছনে থাকা ভিয়েতনাম বা লাও-এর দিনে আঠারো ঘণ্টা পরিশ্রম করতে বাধ্য হওয়া শ্রমিকের মুখ? তার সপ্রশ্ন দৃষ্টি?

প্রশ্নগুলো থাকবে। কিন্তু আমরা ভাবব না। ভাবতে আরম্ভ করলেই নিজেকে ভালবাসার কাজটা জটিল হয়ে যাবে, শুধু সে কারণে নয়। এই কথাগুলো ভাবার ক্ষমতা বেশির ভাগই হারিয়ে ফেলেছি, সেই কারণে। ‘এ-পলিটিকাল’ হওয়ার তাগিদে এই প্রশ্নগুলো করার মতো রাজনীতিকে মনে ঠাঁই দিইনি। সেই কারণে। নিজেকে অতিক্রম করে ভাবার প্রয়োজনের কথা আমরা শিখিনি, সে কারণেও।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Consumerism selfishness
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE