তাণ্ডব: পুলিশকর্মীর উর্দি ধরে টানাটানি করছেন মহিলারা। রবিবার রাতে, টালিগঞ্জ থানায়। নিজস্ব চিত্র
প্রথম বার ঘটিলে যাহা দুঃখজনক, পুনরাবৃত্তি ঘটিতে থাকিলে তাহাই প্রহসন হইয়া দাঁড়ায়। থানায় ঢুকিয়া পুলিশ নিগ্রহ যেমন। কয়েক বৎসর পূর্বে আলিপুর থানায় মারের ভয়ে টেবিলের নীচে লুকাইয়া থাকা পুলিশকর্মীর ছবি দেখিয়া রাজ্যবাসী উদ্বিগ্ন হইয়াছিলেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষার গুরুদায়িত্ব যাহাদের উপর ন্যস্ত, তাহাদের এই অসহায় মূর্তি সাধারণ মানুষকে স্বভাবতই বিচলিত করিয়াছিল। তাহার পর আদিগঙ্গাতেও কিছু জল বহিয়াছে, দুষ্কৃতীদের হাতে পুলিশের হেনস্থা বন্ধ হয় নাই। টালিগঞ্জ থানায় একই কুনাট্যের পুনরাবৃত্তিতে— অনুমান করা চলে— রাজ্যবাসী মুখ টিপিয়া হাসিলেন। আমোদের হাসি নহে, বিরক্তির হাসি। রাজনৈতিক বরাভয় থাকিলে দুষ্কৃতীরা যে বিলক্ষণ পুলিশ পিটাইতে পারে, এই কথাটি রাজ্যের প্রাত্যহিকতার অঙ্গ হইয়া গিয়াছে। সংবাদে প্রকাশ, টালিগঞ্জ থানায় গণ্ডগোলের হোতাটিরও রাজনৈতিক সংযোগ ছিল। অতএব, সে এবং তাহার অনুগামীরা ধরিয়া লইয়াছিল, পুলিশের কার্যকলাপ পছন্দ না হইলে উত্তমমধ্যম দেওয়াই যায়। সত্য বলিতে, রাজ্যবাসীও এই কথাটিতে বিশ্বাস করিয়া ফেলিয়াছেন। ফলে, টালিগঞ্জ থানার ঘটনাক্রম দেখিয়া সাধারণ মানুষ বিস্মিত হন নাই, দুঃখিতও নহেন— রাজ্যের ভবিতব্য ভাবিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়াছেন মাত্র। এই পরিস্থিতি যে বদলাইতে পারে, এমনকি ‘দিদি’কে বলিলেও, সেই বিশ্বাস কাহারও নাই। সম্ভবত, পুলিশকর্মীদেরও বিশ্বাসটি নাই। দুর্বৃত্তরাজ দমন করিয়া আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করিতে হইলে যে আত্মবিশ্বাস থাকা প্রয়োজন, দুর্ভাগ্যক্রমে রাজ্যের পুলিশবাহিনী তাহা খোয়াইয়াছে।
দোষের দায়ভাগ বিচার করিতে বসিলে রাজনৈতিক নেতৃত্বের দিকে যেমন আঙুল উঠিবে, পুলিশের দিকেও তেমনই। অনুগামী দুর্বৃত্ত গ্রেফতার হইলে তাহাকে ছাড়াইতে নেতার ফোন আসে। এবং, সেই ফোন আসিবার পূর্বেই পুলিশ তাহাকে ছাড়িয়া দিতে প্রস্তুত হইয়া থাকে। কেন, সেই কারণ ব্যাখ্যা করা বাহুল্য হইবে। বাম আমলের অভ্যাস, মজ্জাগত। এই প্রক্রিয়াটির পুনরাবৃত্তি হইতে হইতে একটি কথা প্রতিষ্ঠিত হইয়া গিয়াছে— কাহারও মাথায় রাজনৈতিক ছাতা থাকিলে এই রাজ্যে তাহার সাত খুন না হউক, যথেচ্ছ বেয়াদপি মাফ। পুলিশ তাহাকে ধরিবে না, ধরিলেও দ্রুত ছাড়িয়া দিবে। নিতান্তই যদি কোনও মামলা দিতে হয়, লঘুতম ধারার খোঁজ পড়িবে। ইহাতে দুর্বৃত্তদের সুবিধা হইয়াছে বিলক্ষণ। তাহারা বুক ফুলাইয়া বেয়াদপি করিয়া বেড়ায়। মুশকিলে পড়িয়াছে পুলিশ— দুষ্কৃতী দমন না করিতে করিতে তাহারা সম্ভবত আর বিশ্বাসই করিতে পারে না যে দমন করিবার অধিকার ও সামর্থ্য তাহাদের আছে। এবং, বাহিনীর এই আত্মবিশ্বাসের অভাবের কথাটি বিভিন্ন ঘটনায় বারে বারেই প্রকাশ হইয়া পড়ে। তাহাই সর্বাপেক্ষা মারাত্মক। কারণ, পুলিশের পক্ষে বন্দুকের জোরে শাসন করা অসম্ভব। তাহাদের একটিমাত্র শক্তি— আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় তাহাদের কর্তৃত্ব বিষয়ে জনমানসে বিশ্বাস। পুলিশের কথা শুনিতে হয়, পুলিশকে মান্য করিতে হয়, কারণ পুলিশ নিরপেক্ষ ভাবে আইনের পথে চলে— সমাজে যত দিন এই বিশ্বাসটি থাকে, তত দিনই পুলিশ কার্যকর। ঔপনিবেশিক আমলের লাল পাগড়ি আঁটা পুলিশের উপর মানুষের এই বিশ্বাসটি ছিল বলিয়াই যৎসামান্য বাহিনী লইয়াও শাসন সম্ভব হইয়াছিল। রাজনীতির অলিগলিতে বিশ্বাসটি খোয়াইয়া পুলিশ নিজের উপকার করে নাই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy