Advertisement
E-Paper

জীবন এবং অধিকার

নৈতিকতার বিষয়টি অবশ্য সর্বদাই পরিস্থিতিসাপেক্ষ। উপরের যুক্তিটি এই ভাবে উপস্থাপিত করিলে যে সিদ্ধান্ত স্বাভাবিক বলিয়া ঠেকে, ভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে দেখিলে সিদ্ধান্তটি ভিন্ন হইতে পারে। প্রযুক্তি বস্তুটি মানবজীবনের কল্যাণের কাজে লাগানো যায়, উচ্চতর জীবনমানের লক্ষ্যেও ব্যবহৃত হয়।

শেষ আপডেট: ৩১ জানুয়ারি ২০১৯ ২৩:১৯

গর্ভপাতের প্রশ্নে জীবনের অধিকার আগে, না কি জীবনযাপন বিষয়ে পথচয়নের অধিকার আগে? উত্তরটি সহজ নহে। কলিকাতা হাইকোর্ট মঙ্গলবার গর্ভপাতের মামলায় একটি উত্তর দিয়াছে যদিও, সেই উত্তর সর্বসম্মত হইবার আশা কম। বিশেষত গর্ভস্থ শিশুর ডাউন সিনড্রোম প্রমাণিত হইবার পর কোন পথটি অধিক বাঞ্ছিত, সেই নৈতিক তর্কটি অতি জটিল ও বহুস্তরীয়। আদালতের যুক্তি: একটি জীবন্ত ভ্রূণ কুড়ি সপ্তাহ পার হইবার পর কেবলমাত্র অসুস্থ বলিয়া তাহার জীবনের অধিকার কাড়িয়া লওয়া যায় না। যুক্তিটিকে আগাইয়া সংশ্লিষ্ট হাসপাতালের মেডিক্যাল বোর্ড বলিয়াছে: এই ক্ষেত্রে গর্ভপাতে সম্মতি দিবার অর্থ বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের বাঁচিয়া থাকিবার অধিকার বিষয়েই প্রশ্ন তোলা। একটি অতিরিক্ত যুক্তিও এখানে কল্পনা করা যায়। ভ্রূণের অধিকারপন্থীরা বলিতেই পারেন যে, এই একবিংশ শতকে না হয় আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে জানা যাইতেছে যে ভাবী সন্তান একটি অসুস্থতা লইয়া আসিতেছে— কিছু দশক পূর্বে হইলে তো এই পূর্ব-জ্ঞান সম্ভব হইত না, সন্তান স্বাভাবিক ভাবেই জন্ম লইত, এবং পিতামাতাকে রূঢ় হইলেও সেই বাস্তব মানিয়া লইতে হইত। কেবল প্রযুক্তি আসিয়াছে বলিয়াই কি কিছু অসুস্থ জীবনের অধিকার লুপ্ত হইতে পারে? তাহা কি নৈতিক ভাবে সমর্থনীয়?

নৈতিকতার বিষয়টি অবশ্য সর্বদাই পরিস্থিতিসাপেক্ষ। উপরের যুক্তিটি এই ভাবে উপস্থাপিত করিলে যে সিদ্ধান্ত স্বাভাবিক বলিয়া ঠেকে, ভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে দেখিলে সিদ্ধান্তটি ভিন্ন হইতে পারে। প্রযুক্তি বস্তুটি মানবজীবনের কল্যাণের কাজে লাগানো যায়, উচ্চতর জীবনমানের লক্ষ্যেও ব্যবহৃত হয়। সেই ক্ষেত্রে মাতা জ্ঞাতসারে শিশুকে একটি দুঃসহ জীবন দান করিতে এবং তাহার মাধ্যমে নিজের জীবনও দুর্বিষহ করিয়া তুলিতে অসম্মত হইলে তাঁহার উপর অন্যের সিদ্ধান্ত চাপাইয়া দেওয়া কি ঠিক? শিশুজীবন তো একক ও অন্যনিরপেক্ষ ভাবে ভাবিবার নয়, মাতার মনের ইচ্ছাটি এখানে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। যাঁহারা বলিতেছেন, শিশুর হাত পা-সহ দেহ স্বাভাবিক থাকিলে ডাউন সিনড্রোম গর্ভপাতের কারণ হইতে পারে না, তাঁহারা হয়তো খেয়াল রাখিতেছেন না যে হাত-পা না থাকিলেও জীবনধারণ সুস্থ স্বাভাবিক হইতে পারে, কিন্তু ডাউন সিনড্রোম অর্থাৎ মস্তিষ্কের গুরুতর অসম্পূর্ণতা লইয়া কোনও স্বাভাবিক জীবন বাঁচা অসম্ভব। আদালতে প্রশ্ন উঠিয়াছে, কেন মাতা আরও আগে আদালতের দ্বারস্থ হন নাই। অথচ ভ্রূণের সুস্থতার পরীক্ষা এই ক্ষেত্রে কুড়ি সপ্তাহের আগে অসম্ভব এবং তাহার পর আদালত অবধি পৌঁছাইতেই কয়েক সপ্তাহ লাগিয়া যাইতে পারে। সম্ভবত ভারতীয় সংস্কৃতি এখনও ডাউন সিনড্রোমের অর্থ ও ব্যঞ্জনা বিষয়ে যথেষ্ট সংবেদনশীল নয়। কিন্তু মাতা কোন শিশুকে পালনের জন্য প্রস্তুত আছেন, সেইটুকু মান্য করিবার সংবেদনশীলতাটি তো ভুলিবার কারণ নাই।

অসম্পূর্ণ-মস্তিষ্ক শিশু পালনের আরও একটি গুরুতর দিক আছে। তাহা অর্থনৈতিক। যে দেশে রাষ্ট্র বা সমাজ বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু বড় করিবার কোনও দায়িত্বই লয় না, সেখানে পরিবারের উপর এত কঠিন একটি আর্থিক ভার চাপাইয়া দেওয়া কি নৈতিক ভাবে সিদ্ধ? বিশ্বের উন্নত দেশগুলিতে শিশুর জীবনের অধিকারকে বড় করিয়া দেখিবার সঙ্গে সঙ্গে পরিকাঠামোগত সহায়তারও বিস্তর বন্দোবস্ত থাকে। এই দেশে তাহা নাই। অর্থাৎ সমাজসংসার দূর হইতে জীবনের অধিকারের যুক্তিটি দিয়াই ক্ষান্ত, শেষ পর্যন্ত অসুস্থ শিশুর দায় ও দায়িত্ব পুরোটাই মাতা ও পিতা বহন করিবেন, উপদেশ-বিতরণকারী সমাজ বা রাষ্ট্র কেবল দূর হইতে অবলোকন করিবে। অর্থাৎ, পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তিগুলি পরীক্ষা করিতে বসিলে, মাতার অধিকার বিষয়ে প্রশ্ন তোলার নৈতিকতাটি লইয়াই সংশয় জাগিবার কথা।

Abortion Calcutta High Court
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy