E-Paper

সম্পাদক সমীপেষু: আলো ও আঁধার

অর্থনীতি নিয়ে যতই বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের ঢক্কানিনাদ চলতে থাকুক, পরিসংখ্যানে কিন্তু আমাদের আশঙ্কিত হওয়ার যথেষ্টই কারণ আছে।

শেষ আপডেট: ৩১ ডিসেম্বর ২০২৫ ০৬:৫৫

অশোক কুমার লাহিড়ীর ‘পিছন দিকে এগিয়ে যান’ (১-১২) প্রবন্ধ প্রসঙ্গে কিছু কথা। প্রশাসনের তরফে ২০১১-১২ সালকে ভিত্তিবর্ষ ধরে ২০২৫ সালে সেই মূল্যায়নের হিসাব সাধারণ মানুষকে যে ভাবে বিভ্রান্তির দিকে ঠেলে দিচ্ছে, তা নিন্দনীয়, দেশের অগ্রগতির পক্ষে ক্ষতিকরও বটে। বর্তমানে ভারতীয় পণ্য রফতানিতে আমেরিকার চড়া হারে শুল্ক চাপানোর ফলে দেশের উৎপাদনে তার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে, যা ব্যাহত করবে আগামী দিনে বৃদ্ধির গতি। এই অবস্থা কিন্তু পরনির্ভরশীল হওয়ারই ফল, যার দায় এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয় বর্তমান প্রশাসনের। সে জন্যই কি মানুষকে চুপ রাখার জন্য আজ থেকে ২২ বছর বাদে ২০৪৭ সালে আত্মনির্ভর ভারতের স্বপ্ন দেখানো হয়?

অগ্রণী রাজ্য বলে রাজ্যের শাসক দলও অবশ্য দাবি করে না। তবে যে সময়পর্বের পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে প্রবন্ধকার বিস্তৃত সমালোচনায় অবতীর্ণ হয়েছেন, সেই তথ্য অনুযায়ীই চাল ও আনাজ উৎপাদনে এই রাজ্য দেশের মধ্যে প্রথম এবং আলু ও মাছ উৎপাদনে দ্বিতীয়। দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প আছে এই বঙ্গে। পাটশিল্প ও চা উৎপাদন এবং ইস্পাত ও চর্ম প্রক্রিয়াকরণ শিল্পে পূর্বাঞ্চলে অগ্রণী ভূমিকাতেই বাংলার অবস্থান। বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণেও বাংলা দেশের মধ্যে দ্বিতীয়, জাতীয় পরিসংখ্যান তাই বলে। প্রবন্ধে অবশ্য যথার্থই বলা হয়েছে, ভিন প্রদেশ থেকে পশ্চিমবঙ্গে মানুষ কাজ করতে আসার চেয়েও, পশ্চিমবঙ্গ থেকে অন্যান্য রাজ্যে যাওয়ার অনুপাত কম। কিন্তু পরিসংখ্যান এটাও বলে যাঁরা এই রাজ্যে কাজের জন্য আসছেন, তাঁদের বেশির ভাগই এখানকার স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে গিয়েছেন, যাঁদের সংখ্যা শিল্পাঞ্চল বা বিশেষ কিছু অঞ্চলে স্থানীয় মানুষের চেয়েও বেশি। এমন চলতে থাকলে এখানে স্থানীয়রাই সংখ্যালঘুতে পরিণত হবেন।

তবে এটা ঠিক যে, নির্বাচনী কৌশলে বিচক্ষণতা দেখাতে গিয়ে, প্রকৃত দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের কোনও পরিকল্পনার ছাপ আমরা দেখতে পাই না রাজ্য সরকারের কাজকর্মের মধ্যে। অনুদানের ক্ষেত্রে যদি বাছবিচার না থাকে, সেটা তখন শুধুমাত্র রাজনৈতিক উদ্দেশ্য বলেই মনে হয়। তেমনই পুজোয় ক্লাবগুলোকে দেওয়া অনুদানকে শুধুমাত্র রাজনৈতিক কারণ হিসাবেই বর্ণনা করা যেতে পারে, যা রাজ্যের আর্থিক সঙ্কটে সম্পূর্ণ অনুচিত বলেই মনে হয়। ঋণের বোঝা বৃদ্ধির ফলে রাজকোষে সঙ্কট অবধারিত হয়ে পড়বে, প্রবন্ধে আলোচিত এই বক্তব্য পুরোপুরি ঠিক। অপর দিকে, অর্থনীতি নিয়ে যতই বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের ঢক্কানিনাদ চলতে থাকুক, পরিসংখ্যানে কিন্তু আমাদের আশঙ্কিত হওয়ার যথেষ্টই কারণ আছে। বর্তমান কেন্দ্রীয় শাসক দল দায়িত্বভার গ্রহণ করার সময় ২০১৪-১৫ সালে অর্থনৈতিক ঘাটতি ছিল জিডিপি’র ৪% অর্থাৎ পাঁচ লক্ষ দু’হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি, সেটা ২০২৪-২৫ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে জিডিপি’র ৪.৮% অর্থাৎ প্রায় ষোলো লক্ষ কোটি টাকার কাছাকাছি। আবার ভারতীয় অর্থ মন্ত্রকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ সালে দেশের ঋণ ২০১৪-১৫ সাল থেকে তিন গুণের কাছাকাছি বেড়েছে। প্রশ্ন, এ সবও কি এগিয়ে যাওয়া কিংবা আত্মনির্ভরতার লক্ষণ?

অশোক দাশ, রিষড়া, হুগলি

পশ্চাতে চলেছে

অশোক কুমার লাহিড়ীর লেখা ‘পিছন দিকে এগিয়ে যান’ প্রবন্ধটি সময়োপযোগী। এক সময় বিহারে নির্বাচনে খুন, জখম, বুথ দখল এবং অসংখ্য মানুষের মৃত্যু মিছিল ছিল প্রায় স্বাভাবিক ঘটনা। সেই বিহারেই আজ এসআইআর প্রক্রিয়া ও বিভিন্ন নির্বাচনের মতো সদ্য অনুষ্ঠিত বিধানসভা নির্বাচন নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হয়েছে। অথচ বাংলায় যে কোনও নির্বাচনে দলের একাধিপত্য, খুন ও জখম এখন যেন নৈমিত্তিক ঘটনা। প্রশ্ন, বাঙালি আর কবে জাগবে?

নিকুঞ্জবিহারী ঘোড়াই, কলকাতা-৯৯

ইতিহাসের নামে

রাজকুমার চক্রবর্তীর লেখা ‘সবাই এখন ইতিহাসবোদ্ধা’ (১৯-১১) একটি সুচিন্তিত ও সুলিখিত প্রবন্ধ। তিনি ঠিকই বলেছেন যে, সামাজিক স্মৃতি এবং আধুনিক ইতিহাসবিদ্যা এক নয়। কিন্তু ইতিহাস গবেষণার বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করে যে ভাবে অতীতের পুনর্গঠন করেন পেশাদার ইতিহাসবিদরা, তার তুলনায় জনমানসে সামাজিক স্মৃতির প্রভাব অনেক বেশি। স্থান-কাল ও পাত্রের নিরিখে তার ব্যাপ্তি বহু দূর। এর বিপ্রতীপে প্রাতিষ্ঠানিক ইতিহাসবিদ সীমাবদ্ধ থাকেন শিক্ষালয়ের গণ্ডিতে। ফলত, প্রাতিষ্ঠানিক ইতিহাসবিদ সংখ্যালঘুতে রূপান্তরিত হন।

বৈজ্ঞানিক ইতিহাসচর্চার পদ্ধতিতে সাক্ষ্য প্রমাণের নিবিষ্ট বিশ্লেষণ এবং তথ্যসূত্রের উল্লেখ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ওয়টস্যাপ বিশ্ববিদ্যালয়ে যাঁরা অতীত চর্চা করেন, তাঁরা ইতিহাসচর্চার বৈজ্ঞানিক পন্থা অনুসরণ করেন না। কিন্তু মনে হয় সমস্যার শিকড় আরও গভীরে। সমাজমাধ্যমের ‘ইতিহাসবোদ্ধা’রা বোধ হয় এই অভিযোগ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। সেই জন্য অনেকেই আজকাল তথ্যসূত্র উল্লেখ করে নিজের বক্তব্য পেশ করছেন। কিন্তু বিবেচনা করে দেখছেন না যে-সব গ্রন্থ থেকে রসদ সংগ্রহ করছেন, সেইগুলি কতটা যথার্থ বা সেই মূল গ্রন্থগুলিও ইতিহাস রচনার বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি মেনে রচিত হয়েছে কি না।‌ ইতিহাসের ছাত্রমাত্রেই ডোনেশন অব কনস্টানটাইন-এর মতো জাল নথির অস্তিত্ব সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। কিন্তু সাধারণ মানুষের সেই সম্পর্কে অভিজ্ঞতা কম। কাজেই ওয়টস্যাপ বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর কুশীলবরা অনেক সময়েই তথ্যসূত্র, পাদটীকা, গ্রন্থপঞ্জি ইত্যাদি দিয়ে এমন করে তাঁদের বক্তব্য পেশ করছেন যে খালি চোখে মনে হচ্ছে, ইতিহাস রচনার বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিটিই তাঁরা অনুসরণ করে লিখেছেন।

ইতিহাসচর্চা হবে তথ্যনিষ্ঠ, নির্মোহ, নৈর্ব্যক্তিক। কিন্তু ইতিহাসবিদের মনস্তত্ত্ব অনেক সময়েই প্রভাব বিস্তার করে। ইতিহাস পরিপূর্ণ ভাবে এই ব্যক্তিনিষ্ঠতাকে বাদ দিতে পারেনি বলেই ওয়টস্যাপ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসচর্চাকারীরা নিজের বিশ্বাসকে তথ্য দিয়ে সাজিয়ে ইতিহাসের সত্যনিষ্ঠ বয়ান বলে চালিয়ে দিচ্ছেন। সেই তথ্যসূত্রগুলিকে বাদ রাখছেন, যা তাঁর বক্তব্যের বিপরীত। কিন্তু জনমানসে সেই প্রতারণা ধরা পড়ছে না। ফলে, ব্যক্তিগত স্মৃতিগুলি বহুল প্রচলিত হতে হতেই এক সময় সামাজিক স্মৃতিতে রূপান্তরিত হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে।

শ্রাবণী বিশ্বাস, হাবড়া, উত্তর ২৪ পরগনা

বাড়ছে বিপদ

‘দূষণ-রোগ’ সম্পাদকীয় (২৮-১১) প্রসঙ্গে কিছু কথা। অধূমপায়ী মহিলা ও পুরুষদের মধ্যেও ফুসফুসের ক্যানসার ছড়িয়ে পড়ছে, যা যথেষ্ট উদ্বেগের। মহিলারা রান্না করেন, প্রতি দিন ধোঁয়ার মধ্যে বেশি সময় থাকতে বাধ্য হন। গ্যাস কেনার সামর্থ্য না থাকায় রান্নাঘরের দমবন্ধ করা পরিবেশে উনুন ধরাতে কাঠকুটো, শুকনো পাতা বা কারখানার ছাঁটের কাঠ ব্যবহার করছেন। যানবাহন ও কারখানার ধোঁয়া, বাজি কিংবা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে যুদ্ধে নানা ধরনের বারুদযুক্ত অস্ত্রের ব্যবহার বৃদ্ধি ইত্যাদি বহু কারণেই বাতাসে বিষাক্ত গ্যাস ও ধূলিকণার পরিমাণ বাড়ছে।

হাঁপানি, ব্রঙ্কাইটিস, হৃদ্‌রোগ, নিউমোনিয়া ইত্যাদি নানা ধরনের জটিল রোগ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনাও বেড়েছে। দিল্লি-সহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলি যে অসহনীয় বায়ুদূষণের শিকার হল, তার কারণ মানুষের অবিবেচনা। বিত্তবানেরা কোটি কোটি টাকার বাজি পোড়াতে দ্বিধা করছেন না। হরিয়ানা, পঞ্জাবের কৃষকদের খেতে আগাছা পোড়ানোর ধোঁয়া ছড়িয়েছে বিস্তীর্ণ অঞ্চলে। প্রতিটি দেশকেই বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সঙ্গতিহীনদের রান্নার গ্যাস কিনতে সাহায্য করার বিশেষ ব্যবস্থা করতে হবে। বাজি পোড়ানো-সহ অন্য যে সকল কারণে বায়ুদূষণ ছড়াচ্ছে, তার বিরুদ্ধে আন্দোলনের সময় হয়েছে।

রতন রায়চৌধুরী, পানিহাটি, উত্তর ২৪ পরগনা

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Economy Development

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy