Advertisement
১১ মে ২০২৪
summer vacation

বৈশাখী আঁচে শিক্ষার ছুটি পড়ে গেল তা হলে

নিরবচ্ছিন্ন এক ছুটি-সংস্কৃতির মধ্যে দিয়ে চলেছি আমরা। এ বার স্কুলগুলিতেও সেই ছুটির ছায়া পড়ল, মনে করিয়ে দিচ্ছেন চন্দ্রপ্রকাশ সরকার

 টানা ছুটি বাতিলের দাবিতে বহরমপুরের বলরামপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ।

টানা ছুটি বাতিলের দাবিতে বহরমপুরের বলরামপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ।

শেষ আপডেট: ১১ মে ২০১৯ ১২:২৮
Share: Save:

গরমের অজুহাতে টানা দু’মাসের জন্য রাজ্যের সমস্ত সরকারি ও সরকার পোষিত স্কুলগুলিতে ছুটি ঘোষণা করেছে রাজ্য সরকার। সরকারের এই নজিরবিহীন সিদ্ধান্তে অবাক হওয়ার পাশাপাশি শাসকদলের অতি অনুগত শিক্ষক নামধারী দু’চারজন ব্যক্তি ছাড়া কেউই এই সরকারি সিদ্ধান্তে খুশি নন।

ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবক সকলেই বরং উদ্বিগ্ন। সকলেই বুঝতে পারছেন অতিরিক্ত ছুটির ফলে লেখাপড়ার প্রভূত ক্ষতি হবে। ক্ষতি যে হবে তা সহজবোধ্য। কিন্তু আরও উদ্বেগের বিষয় হল, সরকারের এমন সিদ্ধান্তের ফলে ভবিষ্যতে সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থারই পঞ্চত্বপ্রাপ্তি ঘটবে। এমনিতেই পরিকাঠামোহীন, পাশ-ফেল বিহীন শিক্ষা ব্যবস্থায় কারওরই আস্থা নেই। যাদের সামান্যতম সঙ্গতি আছে, তারাই বেসরকারি শিক্ষাব্যবস্থার দ্বারস্থ হচ্ছেন। ফলে শহরাঞ্চল তো বটেই, প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেও ক্রমাগত গজিয়ে উঠছে নতুন নতুন বেসরকারি স্কুল। সরকারি স্কুলে বই-খাতা, জামা, জুতো, সাইকেল সবই পাওয়া যায় বিনা পয়সায়, মায় দুপুরের আহার পর্যন্ত। বেতনও লাগে না এক পয়সা। তা সত্ত্বেও লোকে ঘরের দুয়ারের সরকারি স্কুল এড়িয়ে কিছুটা দূরের বেসরকারি স্কুলে পাঠাচ্ছেন সন্তান-সন্ততিদের। কেন পাঠাচ্ছেন? পাঠাচ্ছেন এ জন্যই যে, সরকারি স্কুলে সবই আছে, নেই কেবল পড়াশোনার পরিস্থিতি।

সঙ্গত কারণেই সরকারি স্কুলের প্রতি জনসাধারণের আস্থা কমছে। ফলত ছাত্রাল্পতায় ভুগছে বহু সরকারি স্কুল। এই অবস্থায় সরকার এই মর্মে সুচিন্তিত (!) সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, কোনও স্কুলে ছাত্র সংখ্যা কুড়ি জনের কম হলে সেই স্কুলটি বন্ধ করে দেওয়া হবে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী খোদ কলকাতায় গত বছর বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে ৭৫টি স্কুল। এ বছর বন্ধ হওয়ার কথা আরও ৫০টি। কলকাতায় সরকার পোষিত মাধ্যমিক স্কুল ৫৩২টি। তার মধ্যে দু'বছরেই বন্ধ হয়ে গেছে বা যেতে বসেছে ১২৫ স্কুল অর্থাৎ ২৪ শতাংশ। শুধুমাত্র কলকাতা নয়, মফসসল শহরগুলিতে জেলার আনাচ কানাচে অবস্থাও যথেষ্ট শোচনীয়। গত বছর ডিসেম্বরের শেষ পর্বে মুর্শিদাবাদ জেলা স্কুল পরিদর্শক (প্রাথমিক) নীহারকান্তি ভট্টাচার্য জানিয়েছিলেন, ‘‘২০ জনের কম পড়ুয়া আছে জেলায় এমন বিদ্যালয়ের সংখ্যা ২০টি। তার মধ্যে ৬টি বিদ্যালয়ে পড়ুয়া বাড়ার সম্ভাবনা নেই। তাই ওই বিদ্যালয়গুলি বন্ধ করে কাছাকাছি অন্য প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত করার বিষয়ে সুপারিশ করা হয়েছে (আনন্দবাজার পত্রিকা,২৭.১২.১৮)।’’ ছাত্রাভাবে সরকারি স্কুল অবলুপ্তির অভাবনীয় ঘটনা আজকের এই তথাকথিত পরিবর্তনের জমানাতেই ঘটছে এমনটা নয়। পূর্বতন গরিবদরদী সরকার যে দিন প্রাথমিক স্তর থেকে ইংরেজি এবং পাশ-ফেল তুলে দিয়েছিল, বস্তুত সে দিনই সূচনা হয়েছিল এই সর্বনাশের। পরবর্তী কালে দফায় দফায় কলকাতায় উঠে যায় বেশ কিছু প্রাথমিক স্কুল। সরকার যখন ২০০৭ সালে সাড়ম্বরে ৩০ বছর পূর্তির অনুষ্ঠান করছে, তখন কলকাতায় সরকারি প্রাথমিক স্কুলের সংখ্যা ছিল ১২১৭টি। তার মধ্যে ২০০টি স্কুল ভুগছিল চরম ছাত্রাভাবে। ওই ২০০টি স্কুলের মধ্যে ১৫০টিতে লালবাতি জ্বালানোর পরিকল্পনা পাকা হয়েছিল সে বছরই। শুধুমাত্র কলকাতা নয়, রাজ্যের সমস্ত জেলাতেই ক্রমাগত সরকারি স্কুলগুলি অবলুপ্তির দিকে এগিয়ে এগিয়ে গিয়েছিল উন্নত থেকে উন্নততর হয়ে ওঠা বামফ্রন্ট আমলেই! ২০০৫ সাল থেকে ২০০৮ সাল, অর্থাৎ মাত্র তিন বছরে শুধুমাত্র বহরমপুর পৌর এলাকায় অবলুপ্ত হয় ১৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয়। তার ঠিক পূর্ববর্তী কয়েক বছরে অবলুপ্ত হয়েছিল আরও অন্তত চারটি বিদ্যালয়।

আরও পড়ুন: ফলেন পরিচীয়তে?​

আরও পড়ুন: ইউরো-নাগরিক​

যে-সময়কালে বহরমপুর শহরে ১৭টি প্রাথমিক বিদ্যালয় অবলুপ্ত হয়েছে, সেই সময়কালে শহরে গজিয়ে উঠেছে দ্বিগুণেরও বেশি বেসরকারি বিদ্যালয়। এই চিত্রই কম বেশি সারা রাজ্যের। সেই ট্রাডিশন সমানে চলছে। তাতে আরও গতি সঞ্চার করবে বর্তমান রাজ্য সরকারের এই ছুটি-প্রীতি।ছাত্র, শিক্ষক ও অভিভাবকদের অধিকাংশই সরকারের এই সর্বনাশা ছুটি সংস্কৃতিতে পঠন-পাঠন বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কায় উদ্বেগ প্রকাশ করলেও কেউ কেউ গরমের সরকারি যুক্তিকে শিরোধার্য করে সাফাই গাওয়ার চেষ্টা করছেন। যেমন, ৬মে আনন্দবাজার পত্রিকায় দেখলাম, জনৈক প্রধান শিক্ষক ‘বিতর্কের তো কিছু নেই’ নিদান দিয়ে বলেছেন, ‘‘পড়াশোনার বিষয় সরকার দেখবে।’’ কিন্তু কী ভাবে দেখবে তার ব্যাখ্যা যদি তিনি দিতেন! যে গ্রামীণ এলাকায় তিনি শিক্ষকতা করেন, বোঝা যাচ্ছে, সেই এলাকার আর্থ-সামাজিক অবস্থা সম্পর্কে তিনি বিন্দুমাত্র অবহিত নন। এই অস্বাভাবিক ছুটির ফলে স্বাভাবিক ভাবে কারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন তা বোঝার জন্য আমাদের বাড়ির পরিচারিকা শেফালি মণ্ডলের উক্তি এখানে উদ্ধৃত করতে চাই। গ্রাম থেকে প্রতি দিন শহরে কাজ করতে আসে। আক্ষরিক অর্থেই পাঁচ বাড়িতে কাজ করে। সাতসকালে আসে আর সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরে সে। তার ছেলেটি নবম শ্রেণীতে এবং মেয়েটি ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ে। ছুটির পরের দিন সে বলছিল, “প্রথমে তো বিশ্বাস করতেই পারিনি, টানা দু’মাস ছুটি কখনও হয় নাকি! ছেলে-মেয়েকে টিউশনি দিতে পারি না, স্কুলে যা হয় সেটুকুই। দুপুরে দুটো খেতে পাচ্ছিল, সেটাও বন্ধ। আর কিছু না হোক, দুপুরে বাধ্য হত স্কুলের ঘরে থাকতে। এখন তো মুক্ত,স্বাধীন! সারাদিন রোদে টো টো করে ঘুরে বেড়াবে!’’ মমতাময়ী মুখ্যমন্ত্রীর এই ছুটি-নীতি যে সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থার শবাধারে শেষ পেরেকটি ঠুকে দিতে যাচ্ছে তা সামান্য এক পরিচারিকার উদ্বেগের মধ্যে দিয়েও প্রকাশ পাচ্ছে।

একদা মহামতি গোখেল বলে ছিলেন— বাংলা আজ যা ভাবে, ভারত তা ভাবে আগামী কাল! কথাটা ভিন্ন অর্থে এখনও সত্য। শিক্ষা সংহারের পথ দেখায় বাংলা, আর তা অনুসরণ করে সারা দেশ। প্রাথমিক শিক্ষাস্তর থেকে পাশ-ফেল প্রথা তুলে দিয়ে সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থার পরিকল্পিত ধ্বংসায়ন শুরু হয়েছিল পূর্বতন স্বঘোষিত জনদরদি সরকারের আমলে। পরবর্তী কালে ২০০৯ সালে শিক্ষার অধিকার আইনের নামে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকার সেই নীতিরই সম্প্রসারণ ঘটায়। পাশ-ফেল তুলে দেয় অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত। সেই নীতির প্রয়োগে অবিচল থাকে পরবর্তী ‘আচ্ছে দিন’-এর সরকারও। তাতেও সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থাকে শেষ করা যায়নি। রাজ্যে পাতা হল নতুন ফাঁদ। যার নাম ছুটি। আশঙ্কা হয়, এই ছুটি নামক মহৌষধ অতঃপর সারা দেশের শাসকরা শিক্ষা সংহাররকল্পে প্রয়োগ করবেন! তাতে শিক্ষা-ব্যবসার প্রসার দ্রুততর হবে। ২০০৪-এ দেশে প্রাথমিক শিক্ষায় অসরকারি অংশ ছিল শতকরা ২০, এক দশকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৫ (আবাপ ১৩.৯.১৮)। এত কম বৃদ্ধিতে কি শিক্ষা-ব্যবসার পোষায়, আপনারাই বলুন!

(সঙ্গের ছবিতে টানা ছুটি বাতিলের দাবিতে বহরমপুরের বলরামপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE