ছবি: সংগৃহীত
দেবীমাহাত্ম্যের দেশে নূতন এক দেবী আবির্ভূত হইয়াছেন, প্রত্যাশিত ভাবেই। করোনা দেবী তাঁহার নাম। গত শতকে প্লেগ দেবী এই কলকাতা শহরে আবির্ভূত হইয়াছিলেন, প্রেমাঙ্কুর আতর্থীর ‘মহাস্থবির জাতক’ উপন্যাসে তাহার বর্ণনা রহিয়াছে। মুম্বই হইতে ট্রেনে আসিয়া হাওড়া স্টেশনে ঘোড়ার গাড়িতে উঠিয়াছিলেন, অতঃপর হ্যারিসন রোডে গাড়োয়ানকে দিব্যদর্শন দিয়া ‘আমাকে চিনিতে পারিলি না? প্লেগ দেবী’ বলিয়াই অন্তর্হিত হইয়াছিলেন। করোনা দেবী এখনও এই ভাবে কাহাকেও শহরের রাজপথে দর্শন দেন নাই, কিন্তু বাংলা, বিহার ও অসমের বিভিন্ন স্থানে তাঁহার পূজা চলিতেছে। দেবীর কোনও মূর্তি নাই, কোথাও পটচিত্র, কোথাও বা তাহাও অনুপস্থিত। মুখ্যত নারীরাই অনেকে মিলিয়া তাঁহাকে কোনও প্রান্তরে বা পুষ্করিণীর তিরে প্রাতঃকালে ধূপ-দীপ-নৈবেদ্যসহ পূজা করিতেছেন। তাঁহাদের বিশ্বাস, দেবী প্রীত হইলে এলাকা পরিত্যাগ করিবেন, অতিমারি বিদায় লইবে। কুসংস্কার, নিশ্চয়ই। বিশ্বব্যাপী ছড়াইয়া পড়া একটি আণুবীক্ষণিক জীবাণু কী ভাবে দেবত্ব অর্জন করিবে? তবে এই অবকাশে লোকবিশ্বাসের কয়েকটি দিক উজ্জ্বল হয়। যে কোনও ব্রতকথার ন্যায় এই ক্ষেত্রেও মহিলারা নিঃশব্দে প্রধান ভূমিকা লইয়াছেন। চাঁদা তুলিয়া ও মাইক বাজাইয়া, মণ্ডপ তুলিয়া বীর পুরুষসিংহগণের ন্যায় উৎপাত করেন নাই। করোনাকালের প্রারম্ভে হিন্দুত্ববাদী পুরুষদের কোথাও কোথাও ‘গো করোনা গো’ বলিয়া ষোড়শোপচারে যজ্ঞ করিতে দেখা গিয়াছিল। তাহাও সংস্কারই ছিল। কিন্তু বৈদিক যজ্ঞের সহিত পুণ্যিপুকুরের তিরে মেয়েলি ব্রতের তফাত আছে। ব্রতপার্বণ গ্রামদেবতার উদ্দেশে স্থানীয় দেশাচার। সংস্কারাচ্ছন্ন মহিলারা যদি সংস্কারাচ্ছন্ন পুরুষের অর্গল ভাঙিয়া করোনাকে নারীর ব্রতাচারে পরিণত করেন, ক্ষতি কী? প্রসঙ্গত, শীতলা হইতে ওলাবিবি, মনসা, পাঁচু ঠাকুর সকলেই মেয়েলি ব্রতের উদ্যাপনে সৃষ্ট। পাঁচু ঠাকুর বা পঞ্চাননের কোপে একদা শিশুরা খোস-পাঁচড়ায় পীড়িত হইত। মারিতে শিশুমৃত্যু এখন কম, তবু শহর-মফস্সলের মানচিত্রে বিভিন্ন পঞ্চাননতলা এখনও সেই লোকস্মৃতি ধারণ করিয়া রহিয়াছে।
ঘটনা হইল, মহামারিতে মানুষ অসহায় হইয়া কখনও কখনও দুই-একটি বিজাতীয় দেবীর জন্ম দিতে পারে ঠিকই, কিন্তু শেষ অবধি তাঁহারা কেহ দীর্ঘস্থায়ী হন না। প্রাচীন লোকদেবীরা কখনও এই ভাবে এক কল্পে, একটি নিদান হাঁকিতেই আসিতেন না। একটি উদাহরণেই বিষয়টি পরিষ্কার হইবে। করোনা ও প্লেগ দুইয়ের প্রাথমিক লক্ষণ জ্বর। বসন্ত এবং বিসূচিকা রোগেও তাই। অতএব, শীতলার সঙ্গে তাঁর প্রধান সেনাপতি হিসাবে আসেন তিন পা, তিন মাথা, নয় চোখ ও ছয় পা বিশিষ্ট জ্বরাসুর। আসেন চামুণ্ডাল, ত্বকে চুলকানি ও প্রদাহ দিতে। সঙ্গে আসেন বিষ-বসন্ত। মধ্যযুগে মহামারির দেবীরা অনেক সৈন্যসামন্ত লইয়া আসতেন। হাল আমলের প্লেগ, করোনা দেবীরা সেই তুলনায় দুর্বল, তাঁদের ওই সেনাসম্ভার অনুপস্থিত। এই সেনাদের প্রত্যেককে নিজস্ব মন্ত্র ও উপচারে তুষ্ট করিতে হয়। যেমন জ্বরাসুরের মন্ত্র, ‘কৃশপিঙ্গললোমক্ষং কৃষ্ণাঞ্জনচয়োপমম্’ ইত্যাদি। পাঁচু ঠাকুরকে আবার বলিতে হইবে ‘দ্বিভুজং জটিলং শান্তং করুণাসাগরং।’ করোনাদেবীর প্রধান অসুবিধা এই স্থলে। তাঁহার ন্যায় রূপকায়াহীন শূন্যময়, মন্ত্র ও উপচারহীন কোনও লোকদেবী ধোপে টিকিবেন বলিয়া ভরসা হয় না। জীবাণু ও দেবীকল্পনা একাকার হইলে এই রূপ জগাখিচুড়িই সৃষ্টি হয়। বিজ্ঞান ও লোকাচার দুই জগৎ হইতেই তাহার নির্বাসন ঘটে।
প্রশ্ন এই: এই বিশাল বৈশ্বিক অসহায়তার সামনে দাঁড়াইয়া লোকাচার বা বিজ্ঞান, কাহাকেও দায়ী করিয়া লাভ আছে কি? এই বঙ্গে শীতলা ও জ্বরাসুরের বর্ণনার অধিকাংশ পুঁথিই অষ্টাদশ ও উনিশ শতকের। তখন ম্যালেরিয়া, কলেরা কোনও আধিব্যাধি লইয়াই যথাযথ জ্ঞান হয় নাই। ১৮৭২ সনে প্রথম লোকগণনার আগে ইংরাজ সরকারও দিশাহারা। সে ম্যালেরিয়াকে কখনও বলিতেছে ‘রংপুর জ্বর’, কখনও ‘হুগলির জ্বর’, কখনও বা ‘বর্ধমান জ্বর’। স্ত্রী অ্যানোফিলিস মশা ম্যালেরিয়ার জীবাণু ছড়ায়, রোনাল্ড রসের এই আবিষ্কার তখনও ভবিষ্যতের গর্ভে। দূষিত বাতাস হইতে সংক্রমণ ইত্যাদি শতেক ধারণা, কোনটি যে সত্য, তাহা ‘সাহেব’রাও জানেন না। আজিকার করোনা-পরিস্থিতির ন্যায়। সংস্কার এবং বিজ্ঞানের অসহায়তা, দুই মিলিয়াই দেবতার জন্ম। সে দিনও। আজিও।
যৎকিঞ্চিৎ
সবাই আজ বিশ্বজনীন ভাবে একা। ‘একাকী গায়কের নহে তো গান’ বললে চলবে না, ‘মিলিতে হবে দুই জনে’ বললে সংক্রমণের ভয়। ‘ওকি ও অপর্ণা, দূরে দাঁড়াইয়া কেন!’— জয়সিংহের সংলাপ বদলাতে হবে। গানের তরী একাই ভাসাতে হবে। একাই নাচ, গান, টিফিন খাওয়া। একাই প্রেম। অনলাইন যতটুকু, বাকি সব স্পর্শরহিত। কিন্তু চাষের কী হবে? শিল্পের? মিছিলের? কালিয়াবঁধুর সনে নবপরিচয়ের? এই অন্য ‘একলা চলো’ সময়ে আমরা সবাই একা একাই রাজা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy