Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪
Coronavirus

স্তব্ধ সময়ে লেখো অনুভূতির ইতিহাস, রোখো গুজব

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে চলছে লকডাউন। খুব ক্ষতিকর পরিস্থিতি। এই সময়ে মানসিকভাবে দৃঢ় এবং সক্রিয় থাকা প্রয়োজন। সেই সঙ্গে দরকার হঠাৎ পাওয়া সুযোগে নিজেকে তৈরি করা। কে কী করছে? কী করা যেতে পারে এখন? খোঁজে আনন্দবাজারএই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনাও বহু পুরনো। কিন্তু সবই যেন নতুন করে প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে বর্তমান পরিস্থিতিতে।

 উদ্যোগ: যত্ন নিলে প্রকৃতি ফেরায় না। অবসরে প্রকৃতির যত্ন নেওয়া শিখতে পারে পড়ুয়ারা। ছবি: দেবরাজ ঘোষ

উদ্যোগ: যত্ন নিলে প্রকৃতি ফেরায় না। অবসরে প্রকৃতির যত্ন নেওয়া শিখতে পারে পড়ুয়ারা। ছবি: দেবরাজ ঘোষ

শেষ আপডেট: ২৬ মার্চ ২০২০ ০০:৫০
Share: Save:

সময়কে বলা হয় সবচেয়ে ভাল চিকিৎসক। কিন্তু সময় সবচেয়ে ভাল শিক্ষকও। সে বিষয়েও কোনও দ্বিমত নেই। আর একটি বিষয়ও খুব ভাল শিক্ষক। তা হল পরিস্থিতি। শিক্ষা জগতে একটা কথা খুব চালু, হাতে কলমে শিক্ষা। পুথিগত বিদ্যা আর অভিজ্ঞতায় অর্জিত জ্ঞানের মধ্যে দ্বন্দ্ব বহু পুরনো বিষয়।

এই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনাও বহু পুরনো। কিন্তু সবই যেন নতুন করে প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে বর্তমান পরিস্থিতিতে। নোভেল করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়া আটকাতে আগেই স্কুল বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তার পর সুরক্ষা এবং সতর্কতামূলক নানা পর্ব পেরিয়ে ২১ দিনের লকডাউন ঘোষণা হয়েছে। ফলে ছাত্র ছাত্রীদের কাছে অখণ্ড সময়। এতদিন তারা নানা ভাবে ব্যস্ত ছিল। স্কুল, কলেজ, টিউশন, গ্যাজেট, আড্ডা এবং দু’চাকা নির্ভর দুনিয়া। এখন শুধু গ্যাজেটে সক্রিয়। বাকি সময়টা বেঁচে যাচ্ছে। অনেকটা সময়। এই সময়ে তো অনেক কিছুই করা যায়।

করোনার প্রভাবের আগে পর্যন্ত বিশ্বের কাছে দু’টো বিষয় খুবই চিন্তার ছিল। এক পরিবেশ আর দুই অর্থনীতি। দ্বিতীয় বিষয়টি বড়দের। কিন্তু প্রথম বিষয়টি নিয়ে ছোটরা বা তুলনায় কম অভিজ্ঞরাও চিন্তা করতে পারেন। বিশেষ করে বাইরে মানুষের চলাচল কমায় প্রকৃতি একটু হাঁফ ছেড়ে বাঁচছে বলে খবর। উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বাতাসও যেন দূষণের বোঝা বওয়া থেকে কিছুটা মুক্তি পেয়েছে। এই সময়ে পরিবেশ নিয়ে ভাবনার সুযোগ এবং প্রকৃতিকে চেনার সুযোগও তো বেড়েছে। সে কথাই বলছিলেন বিশ্বরূপ মণ্ডল। পেশায় চিল্কিগড় ঈশ্বরচন্দ্র ইনস্টিটিউশনের শিক্ষক। কিন্তু নেশায় পাখি পর্যবেক্ষক। তিনি এমন একাধিক পাখির ছবি তুলেছেন যা মেদিনীপুরে প্রথম দেখা গিয়েছে বলে দাবি।

বিশ্বরূপ বলছেন, ‘‘সত্যিই এবার একটু অন্য রকম ভাবতে হবে। আমাদের অভ্যাসটা পাল্টাতে হবে নিজেদের প্রয়োজনেই। ভালবাসতে হবে প্রকৃতিকে, আমাদের চারপাশের জীববৈচিত্রকে। টানা ছুটিতে ব্যালকনিতে বা জানালার পাশে বসে, বাড়ির উঠোনে বা ছাদে দাঁড়িয়ে চোখ মেলে প্রজাপতি, পাখি দেখার এই তো সুযোগ। চোখ মেললেই দেখা যাবে প্রজাপতিরা কেমন এলাকা দখলের লড়াই করে, বাড়ির চারপাশে কত রকমের পাখি আছে, গিরগিটি, টিকটিকি, হরেক রকমের পোকা-মাকড়। দূর থেকেই শোনা যাবে বসন্তবৌরি, কোকিল, দোয়েলের ডাক। দেখা যাবে হাঁড়িচাচার পেঁপে পাকা খাওয়া, আকাশে চিলের চক্কর কাটা, বুলবুল, বেনেবউদের এক গাছ থেকে আরেক গাছে উড়ে যাওয়া।’’ বিশ্বরূপ জানাচ্ছেন, স্কুল খোলা থাকলে, পড়াশোনার চাপ থাকলে প্রকৃতির দিকে তাকানোর ফুরসত থাকে না অনেকের। গরম পড়তে শুরু করেছে। বিশ্বরূপের পরামর্শ, ব্যালকনিতে বা ছাদে পাখিদের জন্য একটু খাবার আর জল রাখলে ক’দিনের মধ্যেই কিছু কিছু পাখি আসতে শুরু করবে। বাড়তে থাকবে প্রকৃতির প্রতি প্রেম। প্রকৃতিপ্রেমী শিক্ষকের কথায়, ‘‘পরিস্থিতির কারণে গড়ে ওঠা এই প্রকৃতি শিক্ষায় আগামী দিনে প্রকৃতিকে এবং আগামী প্রজন্মকে সুস্থ রাখবে।’’

প্রকৃতি পাঠের পরে বাকি সময়টা? মৃন্ময় হোতা জানালেন, যার যা শখ, সময়ের অভাবে যা পূরণ করতে পারেনি সেগুলি পূরণ করতে পারে এই সময়ে। দহিজুড়ি মহাত্মা বিদ্যাপীঠের এই শিক্ষক বললেন, ‘‘আমার দুই ছেলে। একজন কলেজে পড়ে। আরেকজন সপ্তম শ্রেণিতে। অভিভাবক হিসাবে ওদের বলেছি, বই পড়তে। ছোটছেলের গিটারের নেশা। অনলাইনে বিদেশে গিটারের যেসব পাঠ পাওয়া যায় সেগুলি নিচ্ছে। বড়ছেলের আঁকার শখ ছিল। আবার আঁকা শুরু করেছে। আরেকটা পরামর্শও দিয়েছি। লিখতে বলেছি। সভ্যতার গতি প্রায় স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে। এই সময়ের অনুভূতিটা লিখে রাখা দরকার। না হলে পরে এই অনুভূতি থাকবে না।’’ তিনি জানালেন, অন্য বিপর্যয়ে ছাত্র ছাত্রীদেরও ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখা যায়। কিন্তু ভাইরাসের বিপর্যয়ে তা সম্ভব নয়। কিন্তু অন্যভাবেও সামাজিক দায় পালন করা যায় বলে মত তাঁর। যেমন আতঙ্ক না ছড়ানো। তিনি উদাহরণ দিয়ে বললেন, ‘‘দু’একদিনের মধ্যে একটা গুজব খুব ছড়াচ্ছে। চিন নাকি দিনে তিনবার করে চা খাইয়ে ভাইরাস রুখেছে। এর কোনও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। চা কি ফুসফুসে যায়? এই গুজবগুলো পড়ুয়ারা রুখতে পারে। তাতে আতঙ্ক কমবে।’’

জঙ্গলমহলের স্কুল শালবনির মৌপাল দেশপ্রাণ বিদ্যাপীঠ। প্রধান শিক্ষক প্রসূনকুমার পড়িয়া। তিনি বললেন, ‘‘পড়ুয়াদের অভিভাবক এবং পরিচালন সমিতির সদস্যদের সঙ্গে ফোনে কথা হচ্ছে। জানত পারছি সিরিয়াস পড়ুয়ারা বাড়িতে বসে পড়াশোনাটা করছে। এক ছাত্রের সঙ্গে কথা হল। মাধ্যমিক দেবে আগামী বছর। সে রসায়নে একটু পিছিয়ে। বলল, স্যার আমি কেমিস্ট্রিটা এগিয়ে রাখার সুযোগ পাচ্ছি। তবে আমাদের স্কুলের পড়ুয়াদের অনেকেরই আর্থিক অবস্থা ভাল নয়। তাদের বাবা-মা জঙ্গলের উপরে নির্ভরশীল। আর তারা গবাদি পশু, হাঁস, মুরগি সামলাত। ওরা এখন সেই কাজই করতে বাধ্য হচ্ছে হয়তো।’’

কিছু পড়ুয়া সৃষ্টিশীল। কেউ ছবি আঁকে। কেউ গল্প, কবিতা লেখে। তারা এই সময়ে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সময় কাটিয়ে পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় করবে। সেই সঙ্গে সৃষ্টিশীলতার সদ্য অঙ্কুরিত বীজকেও লালন করবে। কী ভাবে? বললেন অচিন্ত মারিক। তিনি একটি পত্রিকার সম্পাদক, সাহিত্যকর্মী এবং প্রকাশক। তাঁর প্রথম পরামর্শ, ‘‘এই সময়ে বাচ্চাদের স্কুলে পড়ানো হয় না এমন বই পড়া দরকার। ঠাকুরমার ঝুলি থেকে সুকুমার রায়। তবেই বাংলা সাহিত্য সম্পর্কে জানবে। যারা আরেকটু বড়, বিশেষ করে কলেজ পড়ুয়া তাঁরা ধ্রুপদী সাহিত্যগুলো পড়ুন এই সময়ে। ‘গোরা’, ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’, ‘গঙ্গা’, ‘অন্তর্জলী যাত্রা’, ‘লাল শালু’, ‘ঢোঁড়াই চরিত মানস’ ইত্যাদি। বিশ্ব সাহিত্য নিয়ে খোঁজ করা যেতে পারে। জেমস জয়েসের ইউলিসিস পড়ে ফেলুন। বাংলা অনুবাদেই পড়ুন। লিখতে গেলে পড়াশোনাটা জরুরি।’’ আর যাঁরা ছবি আঁকতে চায়, ভালবাসে তাদের জন্য অচিন্ত মারিকের পরামর্শ, বাংলার পুরনো শিল্পীদের শিল্পকলা সম্পর্কে পরিচিত হোক তারা। খোঁজ রাখুক স্থানীয় শিল্পকলার। মেদিনীপুরে যেমন রয়েছে পটশিল্প। এসব নিয়ে বইও রয়েছে।

লকডাউন পর্ব একটা বিষয় পরিষ্কার করে দিয়েছে। প্রবল ব্যস্ততা, জেট গতির জীবন আসলে কোনও অত্যাবশ্যক উপাদান নয়। সব কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েও মানুষ বেঁচে থাকে। কিছু আর্থিক সমস্যা অবশ্যই থাকে। সেটা গভীরই। তাতে মানুষের হয়রানি হয়। সেই বিপদ কাটাতে প্রশাসনের উপরে ভরসা রাখা আর মানবিক হাত বাড়ানো যেতে পারে। কিন্তু এই সময়ে মানুষ নতুন করে নিজেকে নিয়ে ভাবার অবকাশ পায়। সময় আর পরিস্থিতি হাতে কলমে সেই সুযোগ তুলে দিয়েছে। আমরা সুযোগ কাছে লাগাব কিনা সেটা নির্ভর করছে আমাদের ভাবনার উপরেই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Coronavirus Health
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE