Advertisement
E-Paper

মানুষ বুঝে নিক, সবাই পোষ মানার জন্য জন্মায় না

আসলে কথাটা হল, প্রকৃতি-পরিবেশ-ইতিহাস-ভূগোল নিয়ে এদের জ্ঞানগম্যি এত কম, এবং সেই নিপাট মূর্খামিকে এরা যে ভাবে উদ্‌যাপন করে, ভাবা যায় না।

সৈকত বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২০ ০০:০১

এই মাস ছয় পৃথিবীতে বসবাস করে, আর বাপ-ঠাকুদ্দাদের ইতিহাস পড়ে, আমরা একটা জিনিস বিলক্ষণ বুঝেছি যে, মানুষের দু’নম্বরির কোনও শেষ নেই। এরা স্যালুট মারে উর্দি দেখে, ভালবাসে ফিগার দেখে, আর মানবিকতা দেখায় সাইজ় অনুযায়ী। যত ভাল ফিগার, তত বেশি প্রেম; যত বড় সাইজ়, তত বেশি মানবিকতা। এরা রাস্তার কুকুরের দুঃখে মিছিল বার করে, গর্তে পড়া হাতির কান্না দেখে নাকের জলে চোখের জলে হয়, বাঘ মারলে জেলে দেয়, কারণ কী? না, এদের চেহারা বড়। আর ছোট আকারের জীবরা বানের জলে ভেসে এসেছে, তাই ইঁদুরকে হাসতে হাসতে বিষ খাওয়ায়, আরশোলা পেলেই গেলে পোঁটা বার করে দেয়, নিরপরাধ মশাকে খালি-হাতে পিটিয়ে খুন করে রক্তে-রাঙা হাতে নির্বিকারে ভাত-মাংস সাঁটায়। আমাদের ফৌত করার জন্য তো গণবিধ্বংসী অস্ত্রের কারখানা বানিয়ে ফেলল, যার নাম ভ্যাকসিন। এই আদিখ্যেতার নাম প্রকৃতি প্রেম। মস্তিষ্ক কতটা নিরেট হলে ভাবা যায় যে, সাইজে একটু বড় হলে তবেই প্রকৃতির মাসতুতো ভাই, আর মশা-আরশোলা-অ্যামিবা-ব্যাকটিরিয়া-ভাইরাস সব ভিন্গ্রহের জীব, সেটা এই দু’পেয়েদের দেখেই টের পাওয়া যায়।

ছোটখাটো জীবদের নিয়ে এদের অভিযোগ কী? না, এরা মানুষের ক্ষতি করে। হ্যাঁ, নিঃসন্দেহে মশা কামড়ায়, ইঁদুর কাগজ কেটে কুটিকুটি করে, ভাইরাসে জ্বর হয়। সত্যি কথা। কিন্তু বাঘ কি মাথায় হাত বুলিয়ে ছেড়ে দেয়, না কুমির দাঁত দেখিয়ে বলে “প্লিজ়, একটু মেজে দিয়ে যাও?” বরং উল্টোটাই। সিংহরা যুগে যুগে থাবা মেরে মানুষের মুন্ডু ছিঁড়ে নিয়েছে, হাতি পায়ে চেপ্টে চিঁড়েচ্যাপ্টা করে দিয়েছে, গন্ডারে গুঁতিয়ে নাড়িভুঁড়ি বার করে দিয়েছে। অথচ দেখবেন, আজ পর্যন্ত এমন কোনও মশা দেখা যায়নি, যে মানুষকে কামড়ে খেয়ে ফেলেছে। জঙ্গলে বাঘও থাকে, মশাও থাকে; কিন্তু কোনও মশাকে নিয়ে ‘ম্যানইটার্স অব কুমায়ুন’ লেখা হয়নি। এমন কোনও গঙ্গাফড়িং পাওয়া যাবে না, যারা মানুষের হাত-পা ছিঁড়ে নেয়। এবং আমরা করোনারা গোটা ভাইরাস সমাজের পক্ষ থেকে শপথ নিয়ে বলতে পারি, শুধু ভাইরাস কেন, আজ পর্যন্ত এমন কোনও আণুবীক্ষণিক জীব জন্মায়নি, যারা কখনও ধরে মানুষের ঘাড় মটকে দিয়েছে। আমরা নিপাট অহিংস, গাঁধীবাদী বললেও দোষের কিছু নেই। অথচ বাঘের জন্য অভয়ারণ্যের রেঞ্জার, আর আমাদের মারার জন্য প্রায় নাথুরাম গডসের ডেঞ্জার। এর বেলা প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট হয় না, যেন আমরা পৃথিবীর সন্তান নই, বাইরে থেকে টপকেছি।

আসলে কথাটা হল, প্রকৃতি-পরিবেশ-ইতিহাস-ভূগোল নিয়ে এদের জ্ঞানগম্যি এত কম, এবং সেই নিপাট মূর্খামিকে এরা যে ভাবে উদ্‌যাপন করে, ভাবা যায় না। এই মানুষরা আসলে কী? পৃথিবীর বুকে নেহাতই নয়া চিড়িয়া, বয়স লাখে মাপা যায়। এমনকি হাজার দশেক বছর আগেও এদের কোনও ঠিক-ঠিকানা ছিল না। পৃথিবীর দু’-চারটে জায়গায় পঞ্চাশ-একশো জনের গুষ্টি বানিয়ে থাকত। ও দিকে আমাদের চতুর্দশ কোটি পুরুষের হিসেব নিতে গেলে বয়স কোটিতে মাপতে হবে। সে সব এদের জানার কথা নয়, কিন্তু ইতিহাসটা অন্তত যদি পড়ত, তো এইটুকু জানত যে, আমাদের বাপ-ঠাকুদ্দা-প্রপিতামহরা কেউ কিন্তু ভুলেও মানুষের শরীরে বাসা বাঁধতে যায়নি। কারণ, আমাদের একটা কাণ্ডজ্ঞান আছে, বিবর্তনবোধ আছে। অভিজ্ঞতার আছে দাম। মানুষের বসতি বলতে তখন কী, এক একটা বিরাট এলাকায় জনাপঞ্চাশ লোক। তার মধ্যে ধরা যাক উনপঞ্চাশ জনেরই শরীরে জলবসন্তজ্যাঠা ঢুকে পড়ল, কিন্তু তার পর? তার পর জেঠু যাবে কোথায়? যাদের কমিউনিটিই নেই তাদের আবার কমিউনিটি স্প্রেড! এইটুকু একটা জনবসতির জন্য কষ্ট করে অভিযোজন আমাদের পড়তায় পোষায়নি। আমরা জন্তু-জানোয়ারের মধ্যেই সুখে ছিলাম।

কিন্তু মানুষের যা হয়, সুখে থাকতে ভূতে কিলোয়। চাষ-বাস-শিল্প-গ্রাম-শহর করে একাক্কার। লম্ফঝম্প করে গোটা দুনিয়া ভরে ফেলল। তাতে উপকার কী হল কে জানে, সে ওদের ব্যাপার ওরা বুঝে নিক, কিন্তু এর পরেও আমরা মানুষের সভ্যতাকে যথেষ্ট সাহায্য করেছি। এই তো কয়েকশো বছরও হয়নি, ইউরোপ কী একটা অদ্ভুত জিনিস করল, যার নাম শিল্প বিপ্লব। সে এমনই বিপ্লব, এমনই এনলাইটেনমেন্টের চোট যে, দলে-দলে লোক ইউরোপ ছেড়ে আমেরিকা আর অস্ট্রেলিয়া পালিয়ে যেতে পথ পায় না। তখন, আর কোনও বান্দা নয়, আমাদের জলবসন্ত আর ইনফ্লুয়েঞ্জাতুতো ঠাকুদ্দারাই নেটিভদের ঝাড়েবংশে সাফ করে ওই সব মহাদেশে সাদাদের জন্য জায়গা বানিয়ে দিয়েছিল। আমরা না থাকলে কোথায় থাকত এই আমেরিকা, কোথায় থাকত সভ্যতার ডান্ডাবাজি? আমেরিকান আদি বাসিন্দাদের হাতে চিঁড়েচ্যাপ্টা হয়ে সাদাদের থোঁতামুখ ভোঁতা হয়ে ফিরতে হত।

সেটা হয়নি, কারণ, সোজা কথায় বললে, পশ্চিমি সভ্যতার ইতিহাস, এক কথায়, ভাইরাসের জয়যাত্রার ইতিহাস। কিন্তু তার জন্য আমরা কখনও কৃতিত্ব চাইনি। কী চেয়েছিলাম? মানবসমাজের সঙ্গে একটা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। হ্যাঁ, তাতে সামান্য ক’টা মানুষ একটু আগে মরত বটে, কিন্তু সে কি আর ওদের অ্যান্টিবডির হাতে আমাদের তরতাজা ছেলেমেয়েরা মরে না? আমরা কি অনুযোগ করি? প্রকৃতির বুকে একসঙ্গে থাকতে গেলে ও রকম একটু হবেই। এ ওকে লেঙ্গি দেবে, সে তার ভাজা-মাছ উল্টে খেয়ে নেবে। ডারউইন একেই বলেছেন, প্রাকৃতিক নির্বাচন। ব্যাটারা এত গণ্ডমূর্খ, ডারউইনও পড়ে না; এতটাই অকৃতজ্ঞ যে, সভ্যতার প্রতি আমাদের অবদান স্বীকার করে না; এতটাই বালখিল্য যে, নিজেদের ইতিহাসই ভুলে যায়।

আসলে, এটাই এদের স্বভাব। থাকত তো পঞ্চাশ জনের একটা দলে। সেই সঙ্কীর্ণতা যাবে কোথায়? এই বিশালতা, এই ভূমা, অখণ্ড প্রকৃতি, কোটি কোটি বছরের ধ্রুপদী ভাইরাস-সমাজ, বিবর্তনের চলন, এ সবই এদের আওতার বাইরে। এরা ছোট-ছোট দল পাকিয়ে এলাকার রাজা হয়ে বসে, আর কিছু দেখে পিলে চমকে গেলেই ‘বাইরে থেকে এসেছে রে, অ্যান্টিবডি লাও’ বলে চিল্লায়। যেখানে সমস্যা যত, সবের মূলে বহিরাগত। অসমে বাঙালি বহিরাগত, বিশ্বভারতীতে রবীন্দ্রনাথ। সিঙ্গুরে চাষারা বহিরাগত, যাদবপুরে ছাত্ররা। আমেরিকায় মেক্সিকানরা আর সুপ্রিম কোর্টে প্রশান্ত ভূষণ। আসলে ধান্দাটা পরিষ্কার। ছোট-বড় স্রেফ চোখে ধুলো দেওয়া, সবার জন্যই এদের একই ওষুধ। নিজেদের যা পছন্দ নয়, সুযোগ পেলেই তাদের সব ক’টাকে ধরে নিকেশ করে ফেলে। তার পর অল্প ক’টা অবশিষ্টকে ধরে চিড়িয়াখানায় পুরে অপরাধবোধ ঢাকে। এরা গোটা আমেরিকার প্রায় সব জনজাতি খতম হয়ে যাওয়ার পর তাদের জন্য নাকি রিজ়ার্ভ তৈরি করেছে। গোটা ভারতবর্ষ থেকে সব বাঘ মেরে ফেলে, তার পর সুন্দরবনে বানিয়েছে একটা পুঁচকে অভয়ারণ্য। এর নাম নাকি পরিবেশপ্রেম। নেহাত মূর্খ না হলে সবাই জানে, সেটা আত্মপ্রবঞ্চনা, নিজের পিঠ নিজে চাপড়ানোর অজুহাত। পৃথিবীর এক কোণে চারশো বাঘ বাঁচল না মরল, তাতে প্রকৃতির নতুন করে কিস্যু এসে যায় না।

আমাদের নিয়েও ওদের ইচ্ছেটা মূলত একই। আমরা যে খোলা হাওয়ায় ঘুরছি, তাতে ওদের খুবই অসুবিধে। দাবিটা হল, আমরা ল্যাবের চিড়িয়াখানায় পোষা হয়ে থাকব, আর রোব্বারের পিকনিকে যেমন লোকে দঙ্গল বেঁধে মজা দেখতে এসে ম্যাদামারা সিংহকে খোঁচায়, খাঁচার সামনে দাঁড়িয়ে সেল্‌ফি তোলে, সে রকম মাইক্রোস্কোপ দিয়ে আমাদেরও দেখে বলবে, “উফ, প্রকৃতির কী অপূর্ব সৃষ্টি।” তার পর “আমরাই এদের রক্ষা করেছি” বলে নিজেদের পিঠ নিজেরাই চাপড়াবে। যখন খুশি রাখব, আর যখন খুশি মারব, এর নাম ‘রক্ষা করা’ হলে অবশ্য আঙ্কল টমকেও আমেরিকানরা রক্ষা করেছিল, স্পার্টাকাসকে বুকে আগলে রেখেছিল রোমানরা। এই টুপিটা ওরা নিজেদের কয়েকশো বছর ধরেই দিয়ে আসছে।

সে দিক, কিন্তু সঙ্গে এইটাও এ বার বুঝে নেওয়ার সময় হয়েছে যে, সবাই পোষ মানার জন্য জন্মায় না। এই সব বালখিল্যপনায় আমাদের টাইট দেওয়া যাবে না। আমরা কাঁটাতার মানি না। দেশভাগে আমাদের ঘণ্টা; ৩৭০ ধারা থাকল কি থাকল না, তাতে কিসুই এসে যায় না। আমাদের ভিসা-পাসপোর্ট লাগে না। আমরা কোটি-কোটি বছরের পুরনো সমাজ। মানুষ যত সীমান্ত বানাবে, আমরা ততই প্লেনের প্রথম শ্রেণিতে ভ্রমণ করে সব লন্ডভন্ড করে করে দেব। হাড়ে-হাড়ে টের পাইয়ে দেব, প্রকৃতি স্রেফ মানুষের না, বড়সড় জন্তুদেরও না। ম্যামথের মামা এই করোনাভাইরাস, এক এক বাঘে তার এক এক গ্রাস। মানুষ থাক বা না থাক, আমরা ছিলাম, আছি, থাকব।

Covid-19 Coronavirus in India Coronavirus
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy