প্রতীকী ছবি।
যুদ্ধ, সন্ত্রাস, মহামারি যেমন ব্যাপক প্রাণহানি করিয়া থাকে, তেমনই করিতে পারে ভ্রান্ত নীতি। কোভিড-১৯ প্রতিরোধের নীতি ইহার উদাহরণ। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রকাশ্যে বিবৃতি দিয়াছেন, শিশুরা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হইবার সম্ভাবনা কম, তাহাদের রোগ ছড়াইবার সম্ভাবনাও কম। অপর দিকে, বয়স যত বেশি, কোভিডে মৃত্যুহারও ততই বেশি— এই ধারণা হইতে সকল দেশই বৃদ্ধদের গতিবিধির উপর নিয়ন্ত্রণ করিয়াছে। কাহার ঝুঁকি অধিক, কোন আচরণ অধিক ঝুঁকিপূর্ণ, সে সম্পর্কে এমন কিছু এলোমেলো ভাসিয়া বেড়ানো ধারণার ভিত্তিতে ভারতেও কোভিড-প্রতিরোধের নীতি স্থির হইতেছে। অথচ সমীক্ষালব্ধ, বৈজ্ঞানিক উপায়ে পরীক্ষিত তথ্য এই সবের বিপরীত সাক্ষ্য দিতেছে। অন্ধ্রপ্রদেশ এবং তামিলনাড়ু, এই দুইটি রাজ্য হইতে প্রাপ্ত রোগ সংক্রমণ-সম্পর্কিত তথ্যের বিশ্লেষণ করিয়া বিজ্ঞানীরা এমন অনেক অপ্রত্যাশিত তথ্য পাইয়াছেন। যেমন, শিশুদের মধ্যে আক্রান্ত হইবার হার যথেষ্ট। তাহাদের মধ্যে রোগলক্ষণের প্রকাশ না ঘটিলেও তাহারা সহজেই একে অপরকে, এবং পরিবারের সদস্যদের সংক্রমিত করিতেছে। স্কুল বন্ধ থাকা সত্ত্বেও শিশুদের মধ্যে সংক্রমণ ঘটিবার এবং তাহা ছড়াইবার উচ্চহার বিজ্ঞানীদের বিস্মিত করিয়াছে। স্পেনের মতো কিছু দেশ শিশুদের বাহির হইবার বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা শিথিল করিয়াছে, তামিলনাড়ু স্কুল খুলিবে বলিয়া ঘোষণা করিয়াছে। নূতন তথ্যের ভিত্তিতে তাহার পুনর্বিবেচনা প্রয়োজন নহে কি?
তামিলনাড়ু এবং অন্ধ্রপ্রদেশ, এই দুইটি রাজ্যের সরকারি কর্তারা তথ্য-পরিসংখ্যান সংগ্রহের গুরুত্ব বুঝিয়াছেন, তাহার জন্য কর্মী ও অর্থ বিনিয়োগ করিয়াছেন, এবং কোনও ভাবে সেই তথ্য গোপন না করিয়া এক মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীদের হাতে তাহা তুলিয়া দিয়াছেন। বস্তুত, কোন পথে সংক্রমণ ছড়াইতেছে, সেই বিষয়ে বিশ্বে অদ্যাবধি যত সমীক্ষা (কনট্যাক্ট ট্রেসিং) হইয়াছে, তাহার মধ্যে এটি বৃহত্তম। প্রায় ৮৫ হাজার সংক্রমিত ব্যক্তি, এবং তাঁহাদের সংস্পর্শে আসিয়াছেন এমন পাঁচ লক্ষেরও অধিক মানুষের পরীক্ষা হইয়াছে। সরকারের এই দায়বদ্ধতা, তৎপরতা ও স্বচ্ছতা হইতে বহু রাজ্য শিক্ষা লাভ করিতে পারে। বস্তুত স্বচ্ছতার গুরুত্ব বুঝিবার একটি উত্তম সুযোগ দিল এই সমীক্ষা। করোনাভাইরাসের গতি-প্রকৃতি সম্পর্কে প্রচলিত ধারণার বিপরীতে বহু সাক্ষ্য মিলিয়াছে। যেমন, ৮৫ বৎসরের পর বৃদ্ধদের মৃত্যুহার কমিয়াছে। অর্থাৎ, তাঁহাদের ঝুঁকি তুলনায় কম। সর্বোচ্চ মৃত্যুহার মিলিয়াছে ৫০-৬৪ বৎসরের মধ্যে, এবং মোট সংক্রমণের এক-তৃতীয়াংশ ঘটিয়াছে ত্রিশ-অনূর্ধ্বদের মধ্যে। অর্থাৎ, কেবল ষাটোর্ধ্বদের বাহির হইবার কড়াকড়ি ভারতে মৃত্যুহার কমাইবে না। এই পার্থক্যের কারণ হইতে পারে জিনগত গঠন, পরিবেশ, অথবা দীর্ঘ দিনের অপুষ্টি, যাহা স্বাস্থ্যে অকালবার্ধক্য আনিতেছে। ডায়াবিটিস প্রভৃতি অপর রোগের আধিক্যও কারণ হইতে পারে।
কারণ যাহাই হউক, ইহা আপাতত স্পষ্ট যে, কোভিড-মৃত্যু এড়াইতে সকল দেশে একই নীতি কাজ করিবে না। অনেক বিজ্ঞানী মনে করিতেছেন, এমনকি ভারতেরও নানা অঞ্চলে সংক্রমণ ও মৃত্যুহারের ভিন্ন ভিন্ন নকশা মিলিতে পারে। তাহার ভিত্তিতে সূচিমুখ প্রতিরোধ নীতি গড়িতে হইবে। রাশ টানিতে হইবে সাধারণের আচরণেও। যেমন, হাসপাতাল এড়াইয়া গণপরিবহণে চাপিলে ঝুঁকি কমিবে না, কারণ দ্বিতীয়টি হইতে সংক্রমণ ছড়াইয়াছে অধিক, তাহার সাক্ষ্য মিলিয়াছে। উৎসবে মাতিয়া উঠিলেও বিপদ বাড়িবে। এই বৃহৎ সমীক্ষায় এমন যে সকল তথ্য প্রকাশিত হইয়াছে, সেইগুলি নীতি নির্ধারণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। বৈজ্ঞানিক উপায়ে তথ্য সংগ্রহ ও প্রকাশের প্রয়োজনটিও ফের প্রতিষ্ঠিত হইল। শাসকবর্গ খেয়াল করিতেছেন কি?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy