Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
Coronavirus

বন্দি শৈশব

যাহা আমাদের এক কূট প্রশ্নের মুখে আনিয়া ফেলে, করোনা-পূর্ব যুগে, মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত বাঙালির শিশুসন্তানেরা বহির্বিশ্বে হাসিয়া-খেলিয়া বড় হইতেছিল কি?

নিজস্ব প্রতিবেদন
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৫ মে ২০২০ ০০:০১
Share: Save:

লকডাউন স্পেনে শুরু হইয়াছিল ১৪ মার্চ হইতে, সে সময়ে বাহিরে কুকুরের পায়চারির অনুমোদন ছিল, প্রাপ্তবয়স্করা আবশ্যক দ্রব্য সংগ্রহার্থে বাহিরে যাইতে পারিতেন, কিন্তু শিশুদের বাহিরে যাওয়া ছিল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। ২৬ এপ্রিল হইতে, শিশুদের এক ঘণ্টা বাহিরে যাইবার অনুমতি মিলিল। প্রায় ছয় সপ্তাহ গৃহবন্দি থাকিবার পর, বহু শিশুরই মানসিক সমস্যা জন্মিয়াছে। মিগুয়েল হার্নান্দেজ় বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সমীক্ষা জানাইতেছে, বহু অভিভাবক লক্ষ করিয়াছেন, সন্তানের মনোযোগ কমিয়াছে, বাড়িয়াছে বিরক্তি ও আতঙ্ক। স্পেনের ভ্যালেন্সিয়া নগরীতে হেলিকপ্টার টহল দিতেছে সর্ব ক্ষণ, রাত্রেও, তাহার কড়া আলোয় ঘুম ভাঙিয়া যাইতেছে শিশুদের। প্রথম যে দিন শিশুদের বাহিরে যাইবার ছাড় দেওয়া হয়, পার্ক বা সমুদ্রসৈকতের উপর পুলিশের হেলিকপ্টার উড়িতে উড়িতে প্রবল স্বরে ঘোষণা করিতে থাকে, নিয়ম মানিয়া চলুন। বাড়ি হইতে বাহির হইবার লোভ যাহাও শিশুদের জাগিয়াছিল, পুলিশের ক্রমাগত নজরদারি ও ধমকের ভয়ে তাহা উড়িয়া গিয়াছে। বহু শিশুর নূতন মুদ্রাদোষ জন্মাইতেছে, অনেকে অনিদ্রা, কাশি ও উদরপীড়ায় ভুগিতেছে, যেগুলি সম্ভবত তাহাদের অশান্তি ও ভীতিরই প্রকাশ। স্পেনের এক শিশু-অধিকার সংগঠন, জার্মানি, ফিনল্যান্ড, স্পেন, আমেরিকা ও ব্রিটেনের ৬,০০০ মানুষের সহিত কথা বলিয়া জানাইয়াছে, বহু শিশুর চিরস্থায়ী মানসিক অসুখ জন্মাইয়া যাইতে পারে এই অতিমারির কালে। মরোক্কোর এক অভিভাবক বলিয়াছেন, তাঁহার শিশু ভাবিতেছে, বাড়ি হইতে বাহির হইলেই সে অসুস্থ হইয়া পড়িবে এবং মৃত্যু নিশ্চিত। বহু মনোবিদের মতে, বহির্বিশ্বে নিয়মিত বেড়াইলে মানুষের নেতিবাচক চিন্তা কম থাকে, শিশুদের ক্ষেত্রেও তাহা সত্য। ফলে অতিমারি হইতে বাঁচিতে যে লকডাউন হইল, তাহা বহু শিশুর মনের স্বাভাবিক ভারসাম্যে চিড় ধরাইয়া দিল।

যাহা আমাদের এক কূট প্রশ্নের মুখে আনিয়া ফেলে, করোনা-পূর্ব যুগে, মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত বাঙালির শিশুসন্তানেরা বহির্বিশ্বে হাসিয়া-খেলিয়া বড় হইতেছিল কি? বৈকালে মাঠে খেলিতে যাইবার প্রথা তো বিলুপ্ত, কারণ প্রায় কোনও পাড়ায় মাঠই আর নাই। ভোরে উঠিয়া শিশুরা বিদ্যালয়ে যায়, সেখানে টিফিন খাইয়া সামান্য সময় বারান্দায় হুটাপুটি করিতে পায় (কারণ স্কুল-সংলগ্ন মাঠটিতে নূতন বিল্ডিং নির্মাণ চলিতেছে, সেখানে আরও ছাত্র পড়িবে), তাহার পর দ্বিপ্রহরে বাড়ি আসিয়া খাইতে না খাইতে আসিয়া পড়েন গৃহশিক্ষক, হোমওয়ার্ক করাইবেন। শিক্ষক উঠিতে উঠিতে সন্ধ্যা গড়াইয়া যায়, তাহা না হইলেও সন্ধ্যায় যাইতে হয় নাটক শিখিতে, অথবা নৃত্য। মাঠেঘাটে গিয়া নিতান্ত নিজের মনে হাসিয়া ছুটিয়া লুটাপুটি খাইবার অভ্যাস তো নিতান্ত নির্বোধ ও অলাভজনক, উহাতে পরীক্ষার নম্বরও বাড়ে না, রিয়েলিটি শো-তেও যাওয়া ঘটে না, তাই তাহার সকল অবকাশ কি ‘সচেতন’ গুরুজনেরা বহু দিনই শিশুদের জীবন হইতে উপড়াইয়া লন নাই? ফলে, বাঙালি শিশুদের জীবনে বন্দিত্ব বহু পূর্ব হইতেই আয়োজিত ও প্রযুক্ত। লকডাউন উঠিয়া স্বাভাবিক জীবন যদি ফিরিয়াও আসে, প্রাপ্তবয়স্করা হাঁপ ছাড়িয়া বাঁচিবেন নিশ্চয়, কিন্তু তখন স্পেনের শিশুদের জীবনের তুলনায় বঙ্গীয় শিশুদের জীবন দেখিলে মনে হইতে পারে, বাংলায় শৈশবের লকডাউন চিরস্থায়ী।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Coronavirus Health Coronavirus Lockdown Spain
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE