Advertisement
১৯ মে ২০২৪
Coronavirus

হৃদয় ও মস্তিষ্ক

শেষ আপডেট: ১৩ এপ্রিল ২০২০ ০০:৩৫
Share: Save:

যে মানুষের উপর বহু লোকের শুভাশুভের দায়িত্ব, সঙ্কটের মুহূর্তে তাঁহাকে বড় পরীক্ষা দিতে হয়। পরীক্ষা তাঁহার বিচারবুদ্ধির, বাস্তববোধের, এবং মানবিকতার। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সুরঞ্জন দাস সম্প্রতি এমনই এক পরীক্ষায় আপন হৃদয় এবং মস্তিষ্কের যে প্রমাণ দিয়াছেন, তাহা কেবল অভিনন্দনযোগ্য নহে, দৃষ্টান্তস্বরূপ। নোভেল করোনাভাইরাসের মোকাবিলায় ঘরবন্দির ফলে স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পঠনপাঠনে বড় রকমের ব্যাঘাত ঘটিতেছে। বিশ্ব জুড়িয়াই এই সমস্যার মোকাবিলায় ডিজিটাল মাধ্যমকে ব্যবহার করিবার নানা উদ্যোগ শুরু হইয়াছে। বিশেষত, শিক্ষকরা আপন গৃহে বসিয়া ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করিয়া ‘ক্লাস’ লইতেছেন, ছাত্রছাত্রীরা যে যাহার গৃহে বসিয়া সেই ক্লাস করিতেছে। শারীরিক দূরত্বের বাধা অতিক্রম করিয়া, অন্য বহু কাজকর্মের মতোই, লেখাপড়া চালাইয়া যাইবার এই প্রক্রিয়া প্রযুক্তি-বিপ্লবের এক অসামান্য দৃষ্টান্ত। স্বভাবতই, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আপাতত বেশ কিছু কাল এই পথে বিদ্যাচর্চার কাজ চালাইয়া যাইবার প্রস্তাব উঠিতেছে, প্রস্তুতি চলিতেছে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে ‘ই-লার্নিং’ শুরুও হইয়াছে। ছাত্রছাত্রীরা শিক্ষায় অগ্রগতির সুযোগ পাইতেছে।

সব ছাত্রছাত্রী সুযোগ পাইতেছে কি? সমান সুযোগ? সুরঞ্জনবাবুর বক্তব্য, অনলাইন ক্লাস মারফত পঠনপাঠন চালাইবার ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ‘সতর্ক’ থাকা আবশ্যক, কারণ ‘অনেক শিক্ষার্থীরই স্বগৃহে ডেস্কটপ কম্পিউটার বা ল্যাপটপ ব্যবহারের সঙ্গতি নাই, অথবা তাহারা হয়তো সুদূরবর্তী গ্রামে বাস করে, যেখানে ইন্টারনেট সংযোগ সীমিত অথবা অনুপস্থিত।’ বলা বাহুল্য, ভারতের মতো দেশে ইহাই সাধারণ বা সামগ্রিক বাস্তব। অন্য বিভিন্ন বিষয়ের মতোই তথ্যপ্রযুক্তির সংসাধনের ক্ষেত্রেও এ দেশে বিপুল বৈষম্য। ‘ডিজিটাল ডিভাইড’-এর সেই রূঢ় বাস্তব মনে না রাখিলে ই-লার্নিংয়ের আয়োজন একটি প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীদের একাংশের সুবিধা করিয়া দিলেও অন্যদের আপেক্ষিক বঞ্চনা আরও বাড়াইয়া তুলিবে। দায়িত্বশীল শিক্ষক ও শিক্ষাব্রতীরা এই বিষয়ে সতর্ক থাকিবার পরামর্শ দিতেছেন, ইহা আশার কথা। লক্ষণীয়, প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যও বৈষম্যের সমস্যাকে গুরুত্ব দিয়াছেন। এবং, কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকও এই বিষয়ে উপাচার্যদের মতামত চাহিয়াছে।

তবে কি প্রযুক্তির সুযোগ কাজে লাগানো হইবে না? যাহারা সেই প্রযুক্তি কাজে লাগাইতে সমর্থ, তাহারা কেন বঞ্চিত থাকিবে? প্রশ্নটি সহজ নহে। বস্তুত, এমন অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, বিশেষত বেসরকারি স্কুলকলেজে ইতিমধ্যেই পুরোদস্তুর ডিজিটাল শিক্ষণ শুরু হইয়া গিয়াছে। সেখানে অধিকাংশ বা সমস্ত শিক্ষার্থীই বাড়িতে বসিয়া তাহার সুযোগ লইতে সক্ষম, কেহই কোনও বঞ্চনার শিকার নহে। স্পষ্টতই, এই বৈষম্যহীনতা এক বৃহত্তর ও গভীরতর বৈষম্যের পরিণাম— যাহারা সামাজিক ও অর্থনৈতিক ভাবে পশ্চাৎপদ, তাহারা ওই সব স্কুলকলেজে প্রবেশই করিতে পারে না। ভারতে শিক্ষার পরিসরে বৈষম্যের মাত্রা গত দুই দশকে বিপুল ভাবে বাড়িয়াছে। যে সব (প্রধানত সরকারি) শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এখনও বিভিন্ন সামাজিক শ্রেণির ছাত্রছাত্রীরা লেখাপড়ার সুযোগ পায়, সেগুলির উপরেও চাপ পড়িতেছে— শিক্ষাকে বাণিজ্যের পণ্যে পরিণত করিবার চাপ। এই পরিপ্রেক্ষিতেই শিক্ষার ক্ষেত্রে ডিজিটাল বিভাজন দূর করিবার সমস্ত ধরনের আয়োজন জরুরি। পশ্চিমবঙ্গ সহ একাধিক রাজ্যে টেলিভিশন চ্যানেলগুলিকে দূর-শিক্ষার কাজে ব্যবহার করিবার যে নূতন চেষ্টা চলিতেছে, তাহা এই পথে অনেক দূর যাইতে পারে। কিন্তু সমাধানের জন্য আগে প্রয়োজন বৈষম্যের সমস্যাটিকে স্বীকার করা। তাহা কেবল হৃদয়ের দায় নহে, মস্তিষ্কেরও দায়িত্ব।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Coronavirus Health Coronavirus Lockdown
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE